২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

অভিজিৎ রায়রা হারলে যে হেরে যাবে বাংলাদেশ

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:৪৮ অপরাহ্ণ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

২৬ ফেব্রুয়ারি। প্রতিবছরই ঘুরেফিরে আসে দিনটি জেসাস ক্রাইস্টের জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত ২০১৮ বার। যেভাবে এসেছিলো ২০১৫ তে। সাথে নিয়ে আসে এক ভয়াল কালসর্পের মরণ ছোবল। বাংলাভাষায় যুক্ত হয় আরেকটি নতুন শব্দ “চাপাতি-বাহিনী”! বঙ্গীয় ঠগি বাহিনী বা মধ্যপ্রাচ্যের হ্যাসাসিনদের মতোই গোপনে সংগঠিত এই গুপ্তঘাতকের দল এদেশের মুক্তচিন্তার জগতে সবচেয়ে ভয়াবহ মরণ ছোবলটি হানে আজ থেকে তিনবছর আগে এই দিনেই। আর তার নির্মম শিকার হন মুক্তমনা বাংলা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়, আমাদের অভিদা। দেশ আর মাটির টানে সকলের সাবধান বাণী উপেক্ষা করে বইমেলা উপলক্ষে মাতৃভূমিতে ছুটে এসেছিলেন এই জ্ঞানতাপস মানুষটি। আর তার প্রতিদান পেলেন প্রকাশ্য রাস্তায় লাশ হয়ে পড়ে থেকে। পাষাণে গড়া মাতৃভূমির মাটি রক্তে রঞ্জিত হয় তার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানের রুধিরে।

দেখতে দেখতে তিনটি বছর অতিক্রান্ত হলো। কিন্তু আজও বিচারের বাণী কেঁদে চলে নীরবে। উপরন্তু বেড়ে চলে মৃত্যুর মিছিল। একে একে অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর বাবু, নিলয় নীল, প্রকাশক দীপন ভাই, জুলহাস মান্নানের মতো আরও কিছু সীমার বাইরে অসীমের স্বপ্ন দেখা ব্যতিক্রমী মানুষ হন গুপ্তঘাতকদের নির্মম শিকার। ক্রমেই বেড়ে চলে মৃত্যুর মিছিল। লেখক, প্রকাশক, অনলাইন এক্টিভিস্ট, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার পাদ্রী, ইসলামী চিন্তাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লালন গবেষক অর্থাৎ ভিন্নমতের চর্চাকারী মাত্রেই একের পর এক ফলেন কমরেডদের কাফেলা বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্রমাগত। আতংক ছড়িয়ে পড়ে এক্টিভিস্টদের মাঝে। ২০১৫-২০১৭ পর্যন্ত সময়কালে প্রতি মূহুর্তে আতংকিত থেকেছেন দেশে থাকা এক্টিভিস্টরা। কেউ কেউ লেখালেখি জগতকে জানিয়েছেন চিরবিদায়, আর কেউ কেউ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে হয়েছেন দেশান্তরী। হচ্ছেন আজও। রাস্তায় বের হলেই বারবার মনে ভাসতো,”আজ কি আসলেই বাড়ি ফেরা যাবে অক্ষতদেহে?”

একদিকে চাপাতি-বাহিনী, অন্যদিকে ৫৭ ধারার পেষণে দুঃসহ হয়ে ওঠে জীবন। অস্থির সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে অজানা শিহরণে। তার ওপর এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী এক্টিভিস্টরা নেমে পড়েন ভিকটিম ব্লেইমিং গেমে। দিবানিশি গুগল, উইকিপিডিয়া ঘেঁটে খাড়া করতে থাকেন উদ্ভট সব থিউরি। দিবারাত্রি করে যেতে থাকেন ভিকটিমের ছিদ্রান্বেষণ যাতে জাস্টিফাই করা যায় হত্যাকাণ্ডগুলোকে। আজও সমানেই চলেছে সেই প্রপাগণ্ডা।

এদেশের মুক্তচিন্তার মানুষদের উপরে আক্রমণ নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পরপরই কবি দাউদ হায়দারের দেশত্যাগের মাধ্যমে শুরু এই পদযাত্রা। ক্রমেই প্রতিক্রিয়াশীলতার অশুভ ছায়া ঢেকে দিতে থাকে স্বাধীন দেশের আলোকিত আকাশ। লেখার অপরাধে (!) দেশত্যাগে বাধ্য হন তসলিমা নাসরিন। তোলা হয় ড. আহমদ শরীফের ফাঁসির দাবি। আক্রান্ত হন কবি শামসুর রাহমান, নিষ্ঠুরভাবে চাপাতি হামলা হয় প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের উপরে। পালিয়ে জীবন বাঁচাতে হয় কার্টুনিস্ট আরিফকে। মৌলবাদ আর ধর্মান্ধতার আস্ফালন আর হুংকারে রীতিমতো ঘাবড়ে ওঠেন শাসক শ্রেণি পর্যন্ত।

শাহবাগের রেনেসাঁকে ছাপিয়ে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে শাপলা চত্বরের পশ্চাতপদতা। বদলে যায় পাঠ্যপুস্তক, স্থানান্তরিত হতে হয় জাস্টিসিয়াকে। ভোটের রাজনীতির হিসাব মেলাতে মশগুল রাজনীতিবিদদের ক্যালকুলাস মিলাতে গিয়ে জন্ম নেয়া ফ্রাঙ্কেস্টাইন আজ বাসুকির নাগপাশে বন্ধন করে ঘাড়ের কাছে ফেলে চলেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। যে নিঃশ্বাসের বিষে নীল হয়ে উঠেছে পুরো জাতির ভবিষ্যৎ! বোতলের দৈত্যকে মুক্ত করার আগে তাকে পুনরায় বোতলবন্দি করার মন্ত্রটি যে জেনে নিতে ভুলে গিয়েছিলেন জাদুকররা! আর তাই আজ দৈত্যের হাতে বন্দি হয়ে খুঁজে পাচ্ছেনা মুক্তির নিশানা।

পাকিস্তানের বর্বরতার অর্গল ভেঙে ৩০ লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্তস্নানে পবিত্র হয়ে শোষণ আর দারিদ্র্যমুক্ত যে স্যাকুলার রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল একাত্তরে ৯ মাসের গর্ভ-যাতনা শেষে, পেছল পথের মসীলিপ্ত যাত্রা আজ তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে খাদের প্রান্তে পতনের শেষ সীমান্তে। যা একেবারেই ওয়ান-ওয়ে টিকেট। ওয়ান্স ফলেন, দের ইজ নো কামিং ব্যাক।

লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাটিকে আবারও রক্তে রাঙিয়ে আমাদের এই ‘ফলেন কমরেডরা’ চেয়েছিলেন জঞ্জালমুক্ত একটি বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী প্রজন্ম গড়ে তুলতে। প্রচলিত সংস্কারময় জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে দূরে ঠেলে যে প্রজন্ম যুক্তির আকাশে ওড়াবে মুক্তির বারতা। গুপ্তঘাতকদের চাপাতির নির্মমতা যে স্বপ্ন পূরণ করার সময়টুকু দেয়নি তাঁদের। আর সেই অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার দায়িত্ব আপনার, আমার, আমাদের সবার। তবেই সফল হবে এই কলমযোদ্ধাদের আত্মবলিদান। কোনমতেই প্রতিক্রিয়াশীলতার হুংকারে ভীত হয়ে পরাজিত হতে দেয়া যাবেনা তাদের।

কারণ,অভিজিৎ রায়রা হারলে যে হেরে যাবে বাংলাদেশ।

রাজেশ পাল, আইনজীবী, ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন