২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

অভুক্ত শিশু, বরিশাল ট্রাফিক অফিসে মায়ের আত্মহুতির হুমকি

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৭:১০ অপরাহ্ণ, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একটি অঘোষিত আইন এবং তা বাস্তবায়নে বৈষম্যমূলক ভুমিকা বা পদক্ষেপে নগরজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। কোনরুপ ঘোষণা না দিয়ে চলছে হলুদ রঙয়ের ব্যাটালিচালিত হলুদ অটোরিকশা আটক। গত দেড় মাস যাবত চলমান এই অভিযানে আটকের ক্ষেত্রে বৈধ-অবৈধতার কোন বাদ-বিচার নেই। বেছে বেছে আটকে দিচ্ছে ব্যাটারিচালিত ছোট্ট এই যাত্রীবাহি পরিবহন। ইতিমধ্যে অন্তত ৮০টি গাড়ি আটক করে বিভিন্ন স্থানে অরক্ষিত অবস্থান ফেলে রেখে দিয়েছে। অথচ বৃহৎ অংশ গাড়ি এখনও প্রকাশ্যে চলমান।

মাঠে থাকা ট্রাফিক পুলিশ ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের আটক হলুদ অটোরিকশাগুলো নিয়ে বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। এমনকি আটকের সংখ্যা নিয়েও দায়িত্বশীল কারও কোন কথার মিল নেই। অবার রহস্যময় পদক্ষেপ হচ্ছে- আটক গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে পরিবহন নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগ দিয়ে জরিমানা বসিয়ে তা আবার আদায় করে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বৈধ কাগজপত্র দেখালেও রেহাই মিলছে না, ছাড়ছেও না। আদালতেও পাঠাচ্ছে না জব্দ দেখিয়ে। এমতাবস্থায় হতদরিদ্র গাড়ি চালকরা মালিকদের চাপে পড়ে ট্রাফিক অফিসে দিনের পর দিন ঘুরেও শুধু প্রতিশ্রুতি শুনছেন।

এখন অতিষ্ঠ হয়ে কেউ কেউ আত্মহুতির হুমকিও দিয়েছেন। ট্রাফিক অফিসে গেলে এখন দেখা যায় অনেকটা রহিঙ্গাদের ন্যায় মালিক ও শ্রমিক বা তাদের স্বজনেরা সেখানে যে ভাবে অবস্থান করছে তার বর্ণনা অতীত। ট্রাফিক পুলিশদের প্রথম ভাষ্য ছিল ত্রুটিপূর্ণ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আটকে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের নিদের্শনা এসেছে। হঠাৎ করে এভাবে গাড়ি আটক গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে জরিমানাও বসিয়ে দেওয়া হয়। মালিক চালকরা নিয়মানুযায়ী জরিমানা ও বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে গাড়ি চাইতে গেলেই শুরু হয় নাটকীয়তা। এই ঘটনার রহস্য জানতে চাইলে বলা হয় ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) উত্তর কুমার পাল এই বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন। তার কাছে গেলে উচ্চ আদালত থেকে হলুদ অটোরিকশা আটকের নির্দেশনা এসেছে।

এক্ষেত্রে হাইকোর্টের একটি কাগজ প্রদর্শন করেন। কিন্তু হাইকোর্টের ওই কাগজের নির্দেশানার এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অটোরিকশা মালিক শ্রমিকদের ভাষায়- হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়ে তা হচ্ছে মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের বিষয়। একপর্যায়ে তিনি এই নির্দেশনার চেয়ে গাড়িগুলোর কোন শোরুম পেপার নেই, স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরির কথা তোলেন। তহালে সিটি কর্পোরেশন থেকে ২হাজার ৬১০টি গাড়ির বৈধতা কী ভাবে দিল সে প্রশ্নে তিনি কোন সদুত্তোর দিতে পারছেন না। পরে অনুসন্ধানে জানা গেছে- সিটি কর্পোরেশনের সাথে ট্রাফিক পুলিশের একটি চুক্তি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে গাড়ি আটকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আবার অপর একটি সূত্র বলছে- নগরীতে গ্যাসচালিত দু’ধরনের গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের একটি সমঝোতা হওয়ায় হলুদ অটোরিকশা বন্ধের কৌশল নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রথম ধাপে সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা অথবা ত্র“টিপূর্ণ অভিযোগ তুলে আটক করে নিয়ে যায়। সেই সাথে জরিমানার টাকার অঙ্ক বসিয়ে দেয় মামলার নথিতে। এভাবে অন্তত ৮০টি গাড়ি আটক করে শহরের পুলিশ লাইনস ও পুলিশ ফাঁড়িগুলো অরক্ষিতভাবে ফেলে রাখা হয়।

ট্রাফিক পুলিশের একেকজন কর্মকর্তার বক্তাব্য আটক গাড়ির সংখ্যার সাথে কোন মিল নেই। কখনো বলা হয় ১৫০ টি গাড়ি আটক রয়েছে। যদি গাড়িগুলো বরিশাল শহরে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকে তাহলে কোনরুপ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়নি কেন তারও কোন সঠিক উত্তর নেই। আবার গাড়ি আটকের ক্ষেত্রে বৈষম্য কেন তার জবাবও বে-মিল।

খোঁজবর নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে- গত ১ নভেম্বর থেকে ট্রাফিক পুলিশের এই অভিযান চলছে। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে- গাড়িগুলো নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত থাকে তাহলে কেন মামলা দিয়ে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। আবার বলা হচ্ছেÑ পরবর্তীতে গাড়িগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আটক গাড়ির চালক ও মালিক দরিদ্রতার কষাঘাতে একটাই আর্থিক দুর্বলতার মুখে পড়েছে যে অনেক পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। আজ গাড়ি ছেড়ে দিতে পারে এমন প্রতিশ্র“তিতে প্রতিদিন গাড়ি মালিক ও চালকসহ পরিবারের সদস্যরা বিএম স্কুল সংলগ্ন ট্রাফিক অফিসের চারপাশসহ বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছে। থাকছে সকাল থেকে গভীর অবধি বসে। কিন্তু কোন ফল না এখন ধর্য্যরে সীমানা ভেঙে পড়েছে।

গত মঙ্গলবারের একটি ঘটনা এতটাই মর্মস্পর্শ যে বর্ণনা করতে গেলেও যে কারও চোখের জল ধরে রাখা সম্ভব না। নগরীর সোবাহান মিয়ারপোল এলাকার ভাড়াটিয়া বাসিন্দা পলাশের নিজের ব্যাটারিচালি অটোরিকশা নিয়ে নতুন বাবজার অতিক্রম করার সময় ট্রাফিক বিভাগের ডিসির সামনে পড়লে তিনি ওই গাড়িটি আটকের নির্দেশ দেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি- আরও অনেক হলুদ অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা গেলেও সেদিক তিনি ফিরে দেখেন নি (!) জানা গেছে- ৭০ হাজার টাকা সমিতি থেকে লোন তুলে সাম্প্রতিকালে ক্রয় করেছিলেন। এখন গাড়িটি আটক হওয়ায় আয় ইনকাম না থাকায় ঘরে আসবাবপত্র বিক্রি করতেও বাধ্য হচ্ছেন।

সর্বশেষ গত কয়েকদিন ওই পরিবারটি অভুক্ত থাকার পর মঙ্গলবার পলাশের স্ত্রী দুলু বেগম একটি প্রতিশ্র“তি পেয়ে ট্রাফিক অফিসে এসেছিল গাড়িটি ফিরে পাওয়ায়ার জন্য। তিনি গাড়ির বৈধ কাগজপত্র দেখালেও ডিসি ট্রাফিক তাকে কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। এরকম বহু পরিবার প্রতিদিনই ট্রাফিক অফিসের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে থাকছে বলে স্থানীয় দোকানীরা জানান। এমনকি এই তথ্য ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরাও বলেন এখানে মানবতাও হারিয়ে গেছে।

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম চলছে। এমন তথ্য পেয়ে অনুসন্ধ্যানে ডিসি উত্তম কুমার পালের বর্তমান অটোরিকশা নিয়ে কঠোর ভুমিকায় খোদ ট্রাফিক বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যরা নাখোশ। কিন্তু মুখ খুলতে পারছেন না। তবে অনেক অজনা খবর জানিয়ে দিয়ে বলছে গাড়ি নিয়ে কী ঘটেছে প্রশাসনের ভেতর। তা না হলে একটি অংশের গাড়ি ধরা হচ্ছে অপরাংশের গাড়ি চলছে। তাহলে ডিসির কথা অনুযায়ী হলুদ অটো বন্ধের নির্দেশনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্নর উত্তর এক্ষেত্রে সহজেই মিলে যায়। এই কর্মকর্তা এতটাই দৃঢ় অবস্থায় নিয়ে আছেন যে এ বিষয়ে পাত্তা দিচ্ছেন না।

আবার কারও কাছে সঠিক কোন ব্যাখ্যা দিতেও রাজি হন না। শুধু বলছেন আইনের মধ্যে থেকে কাজ করা হচ্ছে। তাহলে আটক গাড়ি নির্ধারিত সময় সীমার ভেতরে কেন আদালতে পাঠানো হচ্ছে না তারও কোন উত্তর দিতে নারাজ।

এই বিষয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারি কমিশনার (এসি) আব্দুর রব যে কী না পুলিশের মামলা মোকাদ্দমা নিয়ে আদালতের কার্যক্রম দেখা শোনা তিনিও এই গাড়িও উত্তর বা আইনের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়ে সোজা বলছেন ওপরের কর্তাই সব জানেন! সর্বশেষ বরিশাল ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মালিক শ্রমিক এখন আন্দোলনে যেতে প্রস্তুতি নিয়েছে।

গত রাতে এই সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মী বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাদের ভাষ্য- সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশের নাটকের নেপথ্যের বিষয়াদী তারা প্রকাশ করে তবেই আন্দোলন বেগবান করে তুলবেন।’’

13 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন