১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

ঘরের শত্রু বিভীষণ আতঙ্কে বরিশাল আওয়ামী লীগ

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:৩৬ অপরাহ্ণ, ১১ অক্টোবর ২০১৮

ঘরের শত্রু বিভীষণ আতঙ্কে ভুগছে বরিশাল আওয়ামী লীগ। দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী বিরোধী মনোভাবসম্পন্ন নেতারাই এই আতঙ্কের কারন। কেবল কর্মী নয়, জেলা ও মহানগর কমিটির গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বে থাকা প্রায় সোয়া ২ ডজন নেতাকে নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগের। রাজাকার এবং বিএনপি পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন দল থেকে আসা এইসব নেতারা কখন দলের পিঠে ছুরি বসায় সেটাই এখন শংকা। জেলা ও মহানগরের দুই সাধারন সম্পাদক সংসদ সদস্য এ্যাড. তালুকদার মোঃ ইউনুস এবং এ্যাড. একেএম জাহাঙ্গীরও স্বীকার করেছেন চলমান এই উৎকন্ঠার কথা। একই সঙ্গে তারা বলেছেন যে এধরনের হাইব্রিড ও নব্য আওয়ামী লীগারদের উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। খোজ-খবর নেয়া হচ্ছে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং কর্মকান্ড সর্ম্পকে।

২০০৭ সালে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগে যোগ দেন বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ খান। দল বদলের সময় তিনি ছিলেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। প্রায় ১১ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকা এই নেতা হঠাৎ করে গেল মাসের শেষের দিকে রাজধানী ঢাকায় যোগ দেন বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্ত ফ্রন্টের একটি রাজনৈতিক সভায়। সেখানে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে একাত্মতা ঘোষনা এবং ফ্রন্টের সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আওয়ামী লীগ থেকে বহিঃস্কার করা হয় তাকে। আর সেই থেকেই এখানে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে বিভিন্ন দল থেকে আসা নেতা ও রাজাকার পরিবারের সদস্যসহ হাইব্রিড এবং নব্য আওয়ামী লীগারদের নিয়ে শুরু হয় জল্পনা কল্পনা। টানা ১১ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি তথা দলীয় সকল কর্মকান্ডে জড়িত থাকার পর রশিদ খান যখন দলের সাথে বেঈমানী করতে পারলেন সেখানে আরো কেউ যে বেঈমানী করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে সেটাই এখন প্রশ্ন নেতা-কর্মীদের।

এক হিসেবে দেখা গেছে, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের ৭১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির ২১ জন নানাভাবে বির্তকিত। এদের মধ্যে ১ জন সরাসরি রাজাকার পরিবারের। পরিবারের সবাই বিএনপি করেন অথচ নেতা একা আওয়ামী লীগ এমন আছেন ৩ জন। বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা ৭ জন। জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন এমন আছেন ৩ জন। নব্য আওয়ামী লীগার ১জন। জাতীয় পার্টি পরিবার থেকে আসা ১জন এবং বহুদল ঘুরে আওয়ামী লীগের এসেছেন এমন আছেন ৩ জন। এছাড়া এমন দু’জন আছেন যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে সরাসরি দরিদ্র মানুষের লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। মূলতঃ এই ২১ জনকে নিয়ে টেনশন মহানগর আওয়ামী লীগে। জেলা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এই ধরনের পদ-পদবীধারী নেতার সংখ্যা ৭ জন। এদের একজন সহ সভাপতি পদে থাকা বিএনপি’র সাবেক এমপি অধ্যক্ষ আব্দুর রশিদ খান ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে বহিঃস্কার হয়েছেন। বাকি যে ৬ জন আছেন তাদের মধ্যে ওয়ান ইলেভেন’র সময় সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের আর্শিবাদ পুষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগে আসা একজন রয়েছেন জেলা সহ-সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বে। এছাড়া বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা ১ জন, জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগের আসা ১ জন, সরাসরি রাজাকার পরিবারের ১ জন, পুরো পরিবার বিএনপি’র অথচ নেতা করেন আওয়ামী লীগ এমন ২ জন, বহুদল ঘুরে আসা ১ জন এবং নব্য আওয়ামী লীগ আছেন ১ জন। মজার ব্যাপার হচ্ছে মহানগরের মতো জেলা কমিটি থেকেও বহিস্কার হয়েছেন এক নেতা। বর্তমানে জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি পদে থাকা এই নেতার নাম এ্যাড. ওবায়দুল্লাহ সাজু। ইউএনও তারিক সালমন-কে মামলায় জড়িয়ে জেলে পাঠানোর ঘটনায় দল থেকে বহিঃস্কার করার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক।

জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মী বলেন, ‘বংশানুক্রমিকভাবে আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত এমন ধরনের নেতা-কর্মীরা কখনোই দলের সাথে বেঈমানী করেনা। বিভিন্ন দল থেকে আসা হাইব্রিড আর সব দলের নেতা থাকা পরিবারগুলো থেকে আসা লোকেরাই আওয়ামী লীগের ক্ষতি করে।’ পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘দলে এসে পদ-পদবী দখল করাই কেবল নয়, সব আমলে সুবিধা নেয়া আওয়ামী লীগ নেতার সংখ্যাও অনেক। জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা সৈয়দ দুলাল বিএনপি’র কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল’র বড় ভাই। এই পরিবারের প্রায় সবাই বিএনপি ঘরানার। কেবল সৈয়দ দুলালই আছেন আওয়ামী লীগে। ২০০১ সালে আলাল যখন বরিশাল-৩ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচন করেন তখন দুলাল’র স্ত্রী কন্যাসহ পরিবারের সকল সদস্যরা সেখানে গিয়ে পুরোদমে অংশ নেন ধানের শীষের নির্বাচনী প্রচারনায়। আবার ৯২-৯৩ সালের দিকে যখন বিএনপি ক্ষমতায় তখন সৈয়দ দুলাল কলাপাড়ার মহিপুরে বরফ কল করেন। আর সেই বরফ কল প্রকল্পে মোটা অংকের ঋন দেয় শিল্প ব্যাংক। শিল্প ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকা ছোট ভাই আলাল’র সহযোগীতায় মেলে আওয়ামী লীগ নেতা বড় ভাই’র সেই ঋন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাবস্থায় এই পরিবারটি চলে আলালের ক্ষমতায়। আর আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন বড় ভাই আওয়ামী লীগ নেতা দুলাল।’

কেবল সৈয়দ দুলালই নয়, এরকম আরো অনেকেই আছেন যাদের ভাই-বোনরা দল ভাগাভাগী করে সব সরকারের আমলেই থাকেন মহা আরামে। মাঝে থেকে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় আওয়ামী লীগ তেমনি এসব সুযোগসন্ধানী নেতাদের কারনে বঞ্চিত হয় দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিতরা। জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাড. মজিবর রহমান একসময় ছিলেন বরিশাল আইনজীবি সমিতির সভাপতি। আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থনে সেসময় নির্বাচিত হন তিনি। তারই ছোট ভাই বিএনপি’র প্রভাবশালী আইনজীবি নেতা এ্যাড. মহসীন মন্টু। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মন্টুও একসময় ছিলেন আইনজীবি সমিতির সাধারন সম্পাদক। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি’র সমর্থনে। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে জেলা এবং মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ন দুটি পদে আছেন রাজাকার পরিবারের ২ সন্তান। এদের একজনের বাবা ছিলেন শান্তি কমিটির প্রভাবশালী নেতা এবং অন্যজনের বাবা ও ভাই দু’জনেই শান্তি কমিটির পাশাপাশি ছিলেন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার স্ব-পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগে যখন এরকম রাজাকার পরিবারের সন্তানেরা পূর্নবাসীত হয়, তাও আবার দলের গুরুত্বপূর্ন পদে তখন টেনে মাথার চুল ছেড়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা।’

এসব বিষয় নিয়ে আলাপকালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এ্যাড. একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘অধ্যক্ষ রশিদ খানের ঘটনার পর থেকেই সর্তক অবস্থায় আছি আমরা। এটা ঠিক যে বংশানুক্রিমকভাবে আওয়ামী লীগ করা নেতা-কর্মীরা কখনোই দলের সাথে বেঈমানী করেনা। হাইব্রিড আর নব্য আওয়ামী লীগাররাই দলের জন্যে ক্ষতিকর। মহানগর কমিটিতে এই ধরনের যারা আছে তাদেরকে নিয়ে আমরাও শংকায় আছি। বর্তমানে তাদের উপর কড়া নজরদারীর পাশাপাশি অত্যন্ত সাবধান অবস্থানে রয়েছি আমরা। যাতে করে এদের কেউ দলের পিঠে ছুড়ি বসাতে না পারে। আমাদের তীক্ষè দৃষ্টি রয়েছে এদের কর্মকান্ডের প্রতি।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সংসদ সদস্য এ্যাড. তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, ‘আমাদের অভিভাবক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, মন্ত্রীর পদমর্যাদায় থাকা সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বর্তমানে চিকিৎসার প্রয়োজনে দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি আসার পর পরিস্থিতি বিবেচনায় পরবর্তি সিদ্ধান্ত নেব আমরা। তবে তার আগ পর্যন্ত এইসব সুবিধাভোগী নব্য হাইব্রিড এবং বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে আসা নেতাদের উপর কড়া নজরদারী রাখা হচ্ছে। কোন অবস্থাতেই কোন ঝুকি নিচ্ছিনা আমরা।’ ##

 

সূত্র: যুগান্তর।

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন