২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

চিৎকার করে কাঁদি কিন্তু কোন আওয়াজ নেই!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:১৩ অপরাহ্ণ, ৩০ জুন ২০১৭

সম্প্রতি অকালে চলে যাওয়া শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক মীর মনিরুজ্জামানের মৃত্যুর পর ভেবে নিয়েছিলাম এবার হয়ত না ফেরার দেশের সিরিয়ালে আমি। কারণ ভঙ্গুর ব্যক্তিজীবন ও হতাশার যন্ত্রণা কঠিনতর রোগ থেকেও দ্রুত মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। বেশ কিছুদিন ধরে মিডিয়াঙ্গন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একাকী জীবন যাপনে এক প্রকার মানসিক দৈন্যতার মাঝে দিন পার করছি।

সারাদিন আপন ঘরে বন্দীর ন্যায় থাকার পর সন্ধ্যা হলে যেভাবে ঘর থেকে বের হই তাতে জমিদারী ভাব থাকলেও আসলে আমার ভেতরকার সব অন্তসার শূন্য। অর্থাৎ নাটকের আশ্রয় নিয়ে ভালো আছি প্রকাশের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছি সামাজিক কারণে। এই অল্প দিনেই অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হল দুর্দিনে অনেক শুভাকাঙ্খীদের পাশে পাওয়া যায় না। যারা এক সময় বেশ সমীহ করতো তারাও খবর নেয় না। এটাই বাস্তবতা। মিডিয়া জগতে নাম-ডাক থাকলেও নিজেকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থতার পাশাপাশি ব্যক্তি জীবনেও অন্ধকারে একাকী থাকা সর্বোপরি অবহেলায় আজ আমার করুণ দশা। যার খেসারত দিতে হচ্ছে নিরবে চোখের জল ফেলে। রাত আসলে নেমে আসে যত চিন্তা। নির্লজ্জভাবে সত্য কথা বলতে হয়, এতদিন আমি কোন নেশায় আসক্ত ছিলাম না।

কিন্তু বুকের যন্ত্রনায় অন্তত রাতে তা চেপে রাখতে গভীর ঘুমে মগ্ন হতে হুইস্কি অথবা ওয়াইন খেয়ে ভোরের সূর্য ওঠার পর নিজের চেতনা ফিরে পাই। জানি, বেঁচে থাকলেও আমি জীবন্ত একটি লাশ। ধরেই নিয়েছিলাম, যে কোন সময় আমার মৃত্যু অবধারিত। শুধু দিন গুনছিলাম। তবুও চলে যাওয়ার আগে মিডিয়া অঙ্গনে শেষ একটি চমক দেখানোর অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু সামনে অগ্রসর হতে যদি হাটি ৩ পা তবে যেন পিছিয়ে পরি আরো ২ পা। এরই মাঝে রাতে ঘুমিয়ে সকালে উঠে বেঁচে থাকার কর্মপন্থা বের করার চিন্তায় ছক আঁকি। ২৭ জুন দুপুরে ঘুম ভেঙ্গে ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র হঠাৎ খবর পেলাম প্রিয় ভাজন বরিশালের সংগ্রামী সংবাদকর্মী লিটন বাশার আর নেই। ঈদের পর দিন সকালে এমন দুঃসংবাদে অন্তত এক ঘন্টা একটি টিনচালা ঘরের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলাম নিথর হয়ে। ভাবলাম এতটাই আমি অসহায় এবং মিডিয়া বিচ্ছিন্ন যে লিটন বাশারের ন্যায় একজন জননন্দিত সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর আমি পেলাম সবার শেষে।

প্রয়াত এই সাংবাদিকের সাথে আমার স্মৃতিময় কিছু দিনের সেই পাতাগুলো নাড়াচাড়া করে ঘরে এসে বিভিন্ন জনের কাছে ফোন করে জানলাম বর্তমান পরিস্থিতি এবং লিটন বাশারের দেহখানি কোথায়। চোখের জলে মনের আয়নায় ভেসে আসলো মাত্র ৩ দিন পূর্বেও তার সাথে দেখা হয়েছিল পোশাকের দোকান ইজি’র শো-রুমে। সম্ভবত ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায়। কিন্তু বিশেষ কারণে অভিমান করে কথা না বলে তার সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম লিটন বাশার কি কিনবে? তখন সে ট্রায়াল রুমের ভেতর প্যান্টের ফিটিং দেখতে প্রবেশ করেছে। মনে পড়ছে পাঞ্জাবি পরিহিত এবং তার মাথায় টুপি। ভাবলাম রোজার মাসে সম্ভবত নামাজ ও এবাদতের মাধ্যমে তার দিন কেটেছে।

তার ওপর অভিমান ছিল কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না। লিটন বাশারের মৃত্যুর পর অনেকে কেঁদেছে শুনেছি। আবার কারো মুখে তার বন্দনার আওয়াজও পেলাম। অথচ লিটন বাশারের বিগত বেশ কিছু দুঃসময়ে এদের কাউকেই কাছে দেখিনি। অথবা তার ভুল পথ থেকে ফেরানোর উপদেশ দিয়েছে এমন ব্যক্তিকেও আমি চিহ্নিত করতে পারিনি। বরং সবাই তাকে উসকে দিয়েছে যার যার স্বার্থে। নিরেট সত্য কথা, ভালো-মন্দের মিশেলেই প্রতিটি মানুষ। তার মধ্যেও খারাপ দিক থাকতে পারে বা ছিল। কিন্তু ভালোর দিকটি ছিল খারাপের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। অন্তত সহকর্মী সাংবাদিকদের বিপদে এই একটি ব্যক্তিকেই অগ্রভাগে ভূমিকা রাখতে দেখেছি। কিন্তু কারো পাঁকা ধান ক্ষেতে মই দিয়ে সর্বনাশ করার মানসিকতা আমার চোখে পড়েনি। সম্ভবত এ কারণেই তরুণ এবং সদ্য মিডিয়া জগতে আসা সাংবাদিকদের বিশাল একটি অংশ তার ভক্ত।

যা বরিশালে আর কোন সাংবাদিকের এ ধরনের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলে আমি মনে করি না। তার এই অকাল মৃত্যুতে বরিশাল মিডিয়ায় অপূরণীয় যে ক্ষতি সাধিত হল তা কিভাবে পূরণ হবে সেটা কল্পনাতীত। তবে আমি নিশ্চিত, তার মৃত্যুতে অনেকে চোখের জল ফেললেও মনের ভেতরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে এই ভেবে যে, পথের কাটা দূর হল। তা হতে পারে মিডিয়া জগত এবং সামাজিক বা রাজনৈতিক মহল বিশেষের কাছে।

কারণ লিটন বাশারের জনপ্রিয়তা যেভাবে আরো উচ্চতায় ওঠার সমূহ সম্ভাবনায় অনেক মিডিয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার খায়েশ পোষণ করে তাদের কাছে ইর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসব ব্যক্তিরা শুধু তার প্রতিপক্ষই নয়, অনেকে কাছের লোকও রয়েছে বলে শুনতে পাই। সাংবাদিকতার জনপ্রিয়তা নিয়ে কত নোংরা রাজনীতি হতে পারে তার উদাহরণ সম্ভবত জীবদ্দশায় লিটন বাশার উপলব্ধি করে গেছেন। শুনেছি বা জেনেছি, যেখানে সে কোন বিষয়ে সুপারিশ রেখেছেন, সেখানে তারই বন্ধুরাই প্রতিবাদ করেছে অত্যন্ত গোপনে। প্রতিভাবান এই সাংবাদিকের মনে অনেক কষ্ট পূঞ্জিভূত থাকার আলামত অনেকের অজানা নয়, কম-বেশি আমিও অবহিত।

এ কারণে প্রায়ই তাকে গভীর রাত অবদি দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে একাকী সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে। তখনই অনুমান করেছি তার জীবন সীমা বেশি দূর নয়। এমনকি তাকে সরাসরি একদিন বলেছিলাম, আপনি বেশিদিন বাঁচবেন না। এ অভিমত তার শুভাকাঙ্খীদের কাছেও ব্যক্ত করেছিলাম এভাবে যে, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা শওকত হোসেন হিরনের মত লিটন বাশারও একদিন অকালে ঝরে যাবে। এই উপলব্ধির কারণ প্রেসক্লাব নির্বাচনে শতভাগ জয়ের সম্ভাবনা থাকা সত্বেও কৌশলে তাকে পরাজয়ের মালা পড়িয়ে দিয়েছে তারই আপনজনেরা। এ কারণে তিনি অনেকটাই হতাশ ছিলেন বলে আমার ধারণা। আর সেই হতাশার ধকল কাটিয়ে উঠতে না পারায় তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছে বলে আমার নিজস্ব অভিমত। সাম্প্রতিক ফেসবুকে মাত্রাতিরিক্ত তার লেখালেখির ধরণ দেখে আমার এই ধারণা জন্ম নেয়। অবশেষে ঘটলও তাই। চলে গেল লিটন বাশার। তবে বলে গেল না, কে হবেন বরিশাল মিডিয়ায় তার ন্যায় সংগ্রামী অথবা কে ধরবে তরুণদের আগলে। এ কথা সত্য যে মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। হয়ে ওঠে অপ্রত্যাশিত।

লিটন বাশারের মৃত্যু মানুষকে কিছুটা হলেও শিখিয়ে দিয়ে গেছে কর্ম জীবনের দিকপাল আর শুভাকাঙ্খীদের চারিত্রিক বৈশিষ্টে মানুষ কতটা কষ্ট নামের দুরারোগে ভুগতে পারে। আফসোস, লিটন বাশার নয় এমন মৃত্যু আমারই হওয়া উচিৎ ছিল। লিটন বাশার জীবিত থাকলে কিছুটা হলেও মানুষের উপকারে আসত। কারণ ওর একটি শক্ত-পোক্ত অবস্থান ছিল ইত্তেফাকের ন্যায় প্রতিষ্ঠিত কাগজে কর্মরত থাকায়। অন্তত সেখান থেকে আগলে রাখতে পারত তরুণদের। আর সাংবাদিকতার নেতৃত্ব নিয়ে রাজনীতির স্বচ্ছতাও টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল।

এখন যা কিছু ঘটবে সবই হবে রাজনীতির ন্যায় ওলট-পালট। কিন্তু আমার মত নগণ্য সাংবাদিকের মৃত্যু হলে কোন আফসোস থাকত না কোন মহলেরই। কেউ খুশিও হত না। আবার কারো মনে কষ্টের আঘাতও লাগত না। কারণ মিডিয়াঙ্গনে আমার দেওয়ার মত কোন শক্তি সামর্থ নেই। নিজেই নিজেকে চিনে ফেলেছি আমার যোগ্যতার মাপকাঠি। নিজের ভুল কোথায় তাও চিহ্নিত করেছি। সুতরাং হাজারো মানুষকে কাঁদিয়ে যাওয়া লিটন বাশারের উচিত হয়নি আমাকে ফেলে রেখে যাওয়া। তাই ভাবছি বিধাতা কত নিষ্ঠুর আর পৃথিবী কত বিচিত্র। এমন নাটকীয় ধরাধামে আমাকে আর কত ধুকতে হবে জানি না। আমি চলে গেলে কাঁদার কেউ ছিল না, আর থাকবেও না।

কিন্তু ওর জন্য শুধু রক্তের বন্ধন বিচ্ছিন্ন বন্ধুরাই নয়, তার স্ত্রী ও একটি সন্তানের কান্নার আওয়াজ ধ্বনিত হবে হাজারো বছর। অথবা প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ওই শিশু পুত্রের আফসোস থাকবে পিতার প্রতিভা অনুকরণে ও আদর স্নেহে মানুষের ন্যায় একদিন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। লিটন বাশারের মৃত মুখ আমি দেখিনি। ফেসবুকে যখন দেখি তখন ফ্যালফ্যাল করে শিশুর মত তাকিয়ে হাজারো প্রশ্ন রাখি আর বলি, আমার সিরিয়াল ভেঙ্গে তুমি কেন আগে গেলে না ফেরার দেশে? হয়ত তার আগে আমার মৃত্যু হলে আর কেউ কিছু না লিখলেও অন্তত লিটন বাশারের লেখনীতে আমি কিছু দিন পত্রিকার পাতায় স্থান পেতাম ক্ষুদ্র সাংবাদিক হিসেবে।

এখন সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেউ প্রশ্ন তুলবে না, আমার যদি মৃত্যু ঘটে তার নেপথ্যের কারণাদি নিয়ে। এমন সব ভাবনার সাথে আমার কান্নার আওয়াজ অনেক উচ্চতায় উঠলেও কেউ তা শুনতে পায়নি, পাবেও না। তবে আমি নিশ্চিত, প্রয়াত সাংবাদিকদের মধ্যেকার কয়েকজনের মধ্যে অন্তত লিটন বাশারের চেতনা-মেধা অনন্তকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে বরিশাল মিডিয়াঙ্গণে। লিটন বাশারের জন্য আমার মত লোকের কিছুই করণীয় ছিল না। তবে কথা দিচ্ছি, তুমি একাকী না ফেরার দেশে চলে গেছ সত্য। কিন্তু আমিও আসছি তবে তোমার জন্য হাজারো শুভাকাঙ্খীদের কান্নার স্রোতে ভেসে নয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে লিটন বাশারকে নিয়ে এই লেখার পর রাত সাড়ে ১২টায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম সদর রোডের ইত্তেফাক কার্যালয়ের সামনে। দেখলাম চারিদিকে অন্ধকার।

অফিস কক্ষটিও যেন শোকে নিস্তব্ধ। অনেক ক্ষণ দাড়িয়ে দেখলাম নিদারুণ চিত্রপট। চোখের জলে বুকের জামা ভিজে গেল। রাজপথে অশ্রুর ফোটা পরার আগেই ফিরে এলাম ঘরে। ভাবলাম আমাকেও যেতে লিটনের মত বাঁশ বাগানে।”

সাংবাদিক ও কলামিস্ট,

লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া

1 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন