২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

তৃণমূলে তীব্র বিরোধীতার মুখে বরিশালের ৬ এমপি

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আবারও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রশ্নে নির্বাচনী এলাকার তৃনমূল নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছেন বরিশাল আওয়ামী লীগ দলীয় ৬ এমপি। জেলা উপজেলা কমিটির পক্ষ থেকে মনোনয়নের বিরোধিতা করে রেজুলেশন নেয়া থেকে শুরু করে চিঠি দেয়া হচ্ছে কেন্দ্রে। কোথাও কোথাও মামলা পর্যন্ত হচ্ছে এমপিদের বিরুদ্ধে। এই নিয়ে সংঘাত সংঘর্ষও ঘটছে বিভিন্ন এলাকায়। অবশ্য এসবকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্যরা। তাদের মতে, ‘আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে সবাই যে পক্ষে থাকবে তা নয়। যারা অন্যায় সুবিধা চেয়ে পায়নি তারাই মূলতঃ এসব কর্মকান্ড চালাচ্ছে।’

দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী জটিলতায় আছেন বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের এমপি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ। এখানে দলীয় পদ-পদবী ধারীদের প্রায় সবাই তার মনোনয়নের বিরুদ্ধে। কেবল তাই নয়, দলীয় দুই কর্মীকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে পঙ্কজের বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি মামলা পর্যন্ত হয়েছে। মেহেন্দীগঞ্জে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের জমি দখলের অভিযোগে হয়েছে আরো ১টি মামলা। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে এমপি হওয়া পঙ্কজ স্থানীয় আওয়ামী লীগের মূল ধারার সাথে কখনোই যুক্ত হতে পারেননি এটাই অভিযোগ সেখানকার নেতাদের। কাজীরহাট থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আঃ জব্বার খান বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় জনসমর্থনগত অবস্থান কতটা দুর্বল হলে একজন এমপি’র বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা হতে পারে সেটা ভাবুন। এখানে ভিন্ন আরেকটা আওয়ামী লীগ তৈরীর কাজ করছেন পঙ্কজ। ফলে দলের কোন নেতা-কর্মী এখন আর তার সাথে নেই। দলের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা তার কাছে কেবল উপেক্ষিতই নয় চরমভাবে অবহেলিত।’ হিজলার উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপু বলেন, ‘এই নির্বাচনী এলাকার ৩ টি সাংগঠনিক থানার পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা রেজুলেশন করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাকে যাতে কোনভাবেই দলীয় মনোনয়ন দেয়া না হয় সেজন্যে অনুরোধ জানানো হয়েছে দলীয় সভানেত্রীকে। কেননা পঙ্কজ আবারও মনোনয়ন পেলে এখানে নৌকা’র বিজয় অসম্ভব হয়ে পড়বে।’ অভিযোগ সর্ম্পকে জানতে চাইলে এমপি পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, ‘ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতা-কর্মী মাপার পরিমাপ যন্ত্রটা কি একটু বলবেন ? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন যে আমার কারনে দলের ক্ষতি হয়েছে নাকি উপকার হয়েছে। তিনিই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’

পটুয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব তালুকদারের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা দুর্নীতির মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে আদালতে। চলতি সরকারের মেয়াদে পতাকাবিহীন থাকাবস্থায় দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে দুরত্ব সৃষ্টি হওয়ার অভিযোগ উঠে তার সর্ম্পকে। এছাড়া দলের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের প্রতি অবহেলা, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে আত্মীয়করন এমনকি নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত প্রার্থী করার চেষ্টা করেন মাহবুব। মূলতঃ এসব নিয়েই দলের অধিকাংশরা বিপক্ষে অবস্থান নেয় তার। এখন এরা সবাই জোট বেধে চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তিনি আর না পান মনোনয়ন। কলাপাড়ার পৌর মেয়র পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি বিপুল চন্দ্র হওলাদার বলেন, ‘আবারও মাহবুব তালুকদারকে মনোনয়ন দিলে ফলাফল ভাল হবেনা। দলীয় সিদ্ধান্তের কারনে আমরা ঠিকই নৌকার পক্ষে থাকবো কিন্তু মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মানাবো কি করে ? মাহবুবের দীর্ঘদিনের ক্ষমতার অপ-ব্যবহার আর নেতা-কর্মীদের সাথে দুরত্বের কারনে এখানে জনসমর্থন প্রশ্নে শূন্যের কোঠায় পৌছে গেছে সে।’ কলাপাড়ার উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব তালুকদার বলেন, ‘তাকে যাতে আর মনোনয়ন না দেয়া হয় সেজন্যে নেত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছি। মাহবুব আবারও মনোনয়ন পেলে জয়লাভ মুশকিল হয়ে পড়বে।’ অভিযোগ সর্ম্পকে জানতে চাইলে এমপি মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘মনোনয়ন নিশ্চিত হলে আর কোন সমস্যা থাকবেনা। এসব বিরোধিতা কোন বিষয় না। মূল বিষয় হচ্ছে নৌকা। মাঠের নেতা-কর্মী এবং ভোটাররা নৌকা প্রশ্নে কোন দ্বি-মত করেনা। সেটাই আসল ব্যাপার।’

টানা প্রায় ৩০ বছর ধরে পটুয়াখালী-২ অর্থ্যাৎ বাউফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজ। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রশ্নে তিনিও আছেন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরোধীতার মুখে। এর কারন দলে তার একাধিপত্য আর স্বেচ্ছাচারিতা বলে মনে করছেন সবাই। পরিস্থিতি এমন যে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে তার এমপি হওয়ার পর সেই সংসদ সদস্য পদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা পর্যন্ত দায়ের হয়। মামলাটি করেন বাউফল পৌরসভার বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা জিয়াউল হক জুয়েল। বাউফলের উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মজিবর রহমান বলেন, ‘দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ২/৪ জন ছাড়া আর কেউই এখন তার পক্ষে নেই। তাকে আবার মনোনয়ন দেয়া হলে নৌকার বিজয় অসম্ভব হয়ে পড়বে।’ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি, প্রবীন নেতা নিজাম উদ্দিন খান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে আওয়ামী লীগ করছি। জাতীর জনক ব্যক্তিগতভাবেও আমায় চিনতেন। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে এখানে আওয়ামী লীগ নয়, ভাল আছে বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা। বেপরোয়াভাবে চলছে লুটপাট। নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন নেই। এই পরিস্থিতিতে আ.স.ম ফিরোজকে বাদ দিয়ে ক্লিন ইমেজের কাউকে মনোনয়ন না দিলে নৌকা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।’ অভিযোগ সর্ম্পকে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন ধরেননি আ.স.ম ফিরোজ। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মোতালেব হাওলাদার বলেন, ‘এসব হচ্ছে পাগলের প্রলাপ। আ.স.ম ফিরোজই এখানে দলের একমাত্র যোগ্য প্রার্থী। তিনি মনোনয়ন পেলে বিপুল ভোটে জিতবে নৌকা।’

একদিকে ১৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদক’র অনুসন্ধান-তলব এবং অন্যদিকে হোটেল রেইনট্রি’র কলঙ্কিত অধ্যায়। এই দুই নিয়ে বিপাকে থাকা ঝালকাঠী-১ আসনের এমপি বিএইচ হারুনের বিরুদ্ধে রয়েছে আরো বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ। নির্বাচনী এলাকার লোকজনের মতে, তারা বাবা বুলবুলে পাকিস্তান ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি। এলাকায় বিএনপি জামায়াতের লোকজনকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি দলের নেতা-কর্মীদের নূন্যতম মূল্যায়ন না করার অভিযোগও রয়েছে বিএইচ হারুনের বিরুদ্ধে। দলে হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা হারুন ১৯৯১ সালে চেয়েছিলেন বিএনপি’র মনোনয়ন। ৯৬’তে তিনি নির্বাচনী কর্মকান্ড করেন জেপি (মঞ্জু)’র প্রার্থীর পক্ষে। রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন মাতুব্বর বলেন, ‘আমাদের উপর তাকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্ত বলে একবার মেনে নিলেও আবারও যে মানবো তার নিশ্চয়তা নেই।’ কাঠালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তরুন সিকদার বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকার ১২টি ইউনিয়নের প্রায় সবকটিতে বিএনপি-জামায়াতকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন হারুন। তাদেরকে চেয়ারম্যান মেম্বার বানিয়েছেন। তাকে আবার মনোনয়ন দিলে দলের ইজ্জত যাবে।’ অভিযোগ সর্ম্পকে জানতে চাইলে বিএইচ হারুন বলেন, ‘তরুন-রিয়াজ এরা কারা ? এরা তো দলের কেউ নয়। কাঠালিয়ায় আহবায়ক কমিটি কাজ করছে। নির্বাচনী এলাকার ১২টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বাররা আমার পক্ষে আছে। তাছাড়া নেত্রী ভাল করে জানেন আমি এলাকার জন্যে কি করেছি বা না করেছি। তিনিই সিদ্ধান্ত দেবেন।’

নেতা-কর্মীদের সাথে সমুদ্র সমান দুরত্বের বহু পুরোনো অভিযোগ বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমনের বিরুদ্ধে। এর পাশাপাশি তাকে মনোনয়ন দেয়ার সময় থেকেই যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী আলোচিত তা হচ্ছে তার বাবা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ড। যে কারনে প্রথম যখন তাকে মনোনয়ন দেয়া হয় তখন যেমন সেখানে বিরোধীতা করেছিল দলীয় নেতা-কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধারা তেমনি এখনও স্বাধীনতা দিবসের সব অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না রিমন। বিজয় এবং স্বাধীনতা দিবসের কোন অনুষ্ঠানে রিমন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবেনা এরকম একটি নির্দেশনা পর্যন্ত দিয়েছিল হাইকোর্ট। পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি আলমগীর হোসেন এবং সাবেক সভাপতি বেলায়েত হোসেন প্রায় একবাক্যে বলেন, ‘তাকে আবার মনোনয়ন দেয়া হলে এখানে আওয়ামী লীগের বিজয় তো দুরের কথা দল জামানত হারাবে।’ বামনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাড. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘তার বাবা একজন কুখ্যাত রাজাকার ছিল। মুক্তিকামি বহু মানুষের রক্ত লেগে আছে এই পরিবারের হতে। একবার দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি কিন্তু আর নয়।’ অভিযোগ সর্ম্পকে জানতে চাইলে এমপি রিমন বলেন, ‘আমার স্ত্রী এবং কন্যা অসুস্থ। আমি তাদেরকে নিয়ে ব্যাস্ত আছি। এই মুহুর্তে কিছুই বলতে পারবো না।’

যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদন্ডপ্রাপ্ত জামাত নেতা সাঈদীকে হারিয়ে প্রথমবার এমপি হয়ে তাক লাগিয়ে দিলেও রাজনীতির সেই ইমেজ খুব বেশীদিন ধরে রাখতে পারেননি পিরোজপুর সদর আসনের এমপি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একেএমএ আউয়াল। আর এখনতো তার বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি সন্ত্রাসের অভিযোগ অফুরন্ত। এমনকি তার সহোদর ভাইয়েরা পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাঠে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এ্যাড. আঃ হাকিম হাওলাদার বলেন, ‘আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি যে তার মতো একটা নষ্ট মানুষকে মনোনয়ন দেবেনা কেন্দ্র। তারপরও যদি দেয়া হয় তবে এখানে জামানত হারাবে আওয়ামী লীগ।’ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি পৌর মেয়র এবং এমপি আউয়ালের আপন ভাই হাবিবুর রহমান মালেক বলেন, ‘এখানে দলীয় মনোনয়নের আশায় মাঠে থাকা হাফ ডজনেরও বেশী নেতার একটাই বক্তব্য, যাকে ইচ্ছা মনোনয়ন দিক নেত্রী, সবাই এক হয়ে তার পক্ষে কাজ করবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই যেন আউয়ালকে মনোনয়ন দেয়া না হয়। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে কেউ নামবেনা নির্বাচনী মাঠে।’ বিষয়টি সর্ম্পকে আলাপকালে এমপি একেএমএ আউয়াল বলেন, ‘২০১৪ সালে এখানে ৩০ জনেরও বেশী দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। নেত্রী আমার উপর ভরসা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাল করে জানেন আমার সর্ম্পকে। কে কি বললো বা না বললো তাতে কিছু আসে যায়না। পিরোজপুর সদর আসনের সাধারন মানুষ এখনও আমার পক্ষে। আশা করি দল আমাকেই মনোনয়ন দেবে।’ ##

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন