২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বরিশাল পুলিশ কমিশনারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ঢাকায় গেলেন আ’লীগ নেতা (!)

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:০৬ পূর্বাহ্ণ, ১৬ জুলাই ২০১৮

বরিশালে দলীয় প্রার্থী পক্ষে প্রচারণায় এসে ঘটনাচক্রে পুলিশ কমিশনারের ওপর চড়াও হলেন দক্ষিণ ঢাকা আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলম মুরাদ। একটি যাত্রীবাহি লঞ্চের কেবিনে এই নেতা প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে সিনিয়র সহকারী কমিশনার মর্যাদার এক কর্মকর্তাসহ তিন পুলিশ সদস্যকে পেটালেন। এমনকি ওই সময় পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মাহফুজুর রহমান ছুটে গেলে তাকেও শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত করেন। শনিবার সন্ধ্যারাতে বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালের এই ঘটনায় বরিশাল পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি বরিশাল পুলিশের ইমেজের বিষয় হওয়ায় কেউ মুখ খুলছেন না।

এমনকি সংশ্লিষ্ট কোতয়ালি মডেল থানার পুলিশও রয়েছে নিরব-নিশ্চুপ। তবে বিষয়টি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করার বিষয়টি অনুমান করা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ওই লঞ্চের একাধিক যাত্রী ঘটনার বিবরণ দিয়ে জানিয়েছেন- ঢাকা দক্ষিণ মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম মুরাদ সুন্দরবন ১১লঞ্চের ভিআইপি কেবিনের সম্মুখে অন্তত অর্ধশত নেতাকর্মী নিয়ে অবস্থান করছিলেন। প্রায় একই সময় ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মেদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান লঞ্চঘাটে যান। সরকারী এই কর্মকর্তাকে প্রোটকল দিতে সেখানে গিয়েছিলেন ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম ও পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মাহফুজুর রহমান।

কিন্তু ঘটনাচক্রে সচিবকে পিছু ফেলে পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা চলে যান লঞ্চের ভিআইপি কেবিনের লাউঞ্জে। সেখানেই গিয়ে দেখতে পান অর্ধশতাধিক লোকের মধ্যে বসে ছিলেন আ’লীগ নেতা শাহ আলম মুরাদ। এই নেতার সাথে থাকা অপরাপর বেশ কয়েক ব্যক্তি পিস্তল হাতে নিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করছিলেন। সেই দৃশ্য দেখে কমিশনারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহিদুল ইসলাম ছুটে গিয়ে অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়টি জিজ্ঞাসা করেন। এবং পিস্তলের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য কাগজপত্র দেখতে চান। কিন্তু আ’লীগ নেতা শাহ আলম মুরাদ ও তার সাথে থাকা লোকজন পুলিশকে কোন ধরনের ‘থোরাও কেয়ার’ করেনি।

এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ কমিশনারের দেহরক্ষী ছুটে গিয়ে তাদের দ্রুত স্থান ত্যাগের অনুরোধ করেন। এই সময়ে তুমুল বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে শাহ আলম মুরাদের সাথে থাকা সৈকত ইমরানসহ ২০ থেকে ২৫জন একত্রিত হয়ে সহকারী জাহিদুল ইসলাম ও দেহরক্ষী হাসিবকে এলোপাতারি পিটুনি দেয়। উদ্বুদ্ব পরিস্থিতিতে পুলিশ কমিশনার চেয়েছিলেন সকলকে বের করে দিয়ে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার। কিন্তু ক্ষুব্ধ শাহ আলম ও তার বাহিনী পুলিশ কমিশনারকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে শাহ আলম কমিশনারের মাথায় পিস্তল ধরেন।

এমনকি কমিশনারকে এই সময়ে শারীরিক লাঞ্ছিত করেন তার সাথে থাকা ইমরান সৈকতসহ বেশ কয়েকজন। এই চিত্র ক্যামেরায় ধারন করতে গেলে কমিশনারের সঙ্গি ওবায়েদকেও মারধর করে। একপর্যায়ে তার সাথে থাকা ক্যামেরাটি ছিনিয়ে নিয়ে যায় শাহ আলমের লোকজন। আ’লীগ নেতার পুরো সন্ত্রাসের চিত্র লঞ্চের অনেক যাত্রীকে হতাশ-বাকরুদ্ধ করেছে। পরিস্থিতি বেগতিক অনুমানে নিয়ে পুলিশ কমিশনার দ্রুত ফোন করে ঘটনাস্থলে আরও পুলিশ ডেকে নেয়। কিন্তু বরিশাল পুলিশ চাইছিল না সরকারের দুই জন সচিবের উপস্থিতিতে এই ধরনের বিষয় প্রকাশ্যে আসুক।

যে কারণে ঘটনার পর সকলকে গ্রেফতারের প্রস্তুতি নিতে লঞ্চটি থামিয়ে রাখা হলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে একটি সূত্র দাবি করছে- এই ঘটনার পর বিষয়টি তাৎক্ষণিক শাহ আলম মুরাদ কেন্দ্রীয় আ’লীগের প্রভাবশালী এক নেতাকে মুঠোফোনে অবহিত করেন। এর পরেই কমিশনারের মোবাইল ফোনে কোন ব্যক্তি বিশেষ ফোন করে কথা বলেন। মূলত মুঠোফোনে আলাপচারিতার পরই বরিশাল পুলিশ গ্রেফতারের মতো কোন ঘটনার দিকে না গিয়ে লঞ্চটি ছেড়ে দেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা লঞ্চের যাত্রীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই এই লঞ্চে ঢাকার যাত্রা নিরাপদ নয় মনে করে টার্মিনালেই মেনে যান।

যদিও লঞ্চটি ছেড়ে দেওয়ার আগেই পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান পুরো ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র সিসিটিভি থেকে সংগ্রহ করে রাখেন বলে শোনা গেছে। এই বিষয়টি নিয়ে রোববার দিনভর বরিশাল পুলিশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইলেও দায়িত্বশীল কোন কর্মকর্তা মুখ খোলেন নি। এমনকি সংশ্লিষ্ট কোতয়ালি পুলিশও বিষয়টি স্বীকার করছে না। তবে গভীর রাতে পুলিশের একটি অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে- এই ঘটনায় শাহ আলম মুরাদের নাম উল্লেখ করে ২০ থেকে ২৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। সেই মামলায় তাদের ১৪২/১৪৩/১৮৬/৩৫৩/৩৩২/৩৩৩/৩০৭ ও ৩৪ ধারায় অভিযুক্ত করার সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার অনুঘটক শাহ আলম মুরাদকে কেন নামধারী আসামি করা হচ্ছে সেই সম্পর্কে বরিশাল পুলিশের পক্ষ থেকে কোন মন্তব্য আসেনি।

তাছাড়া অভিযুক্তদের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করে তাদের পাওয়া যায়নি। তবে এই ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা এক আ’লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেন- পুলিশ কমিশনার শাহ আলম মুরাদকে সঙ্গীদের নিয়ে বসে থাকতে দেখতে পান। ওই সময় তাকে দেখে কেন আ’লীগ নেতরা উঠে দাড়ালেন না এই বিষয়টিতে তিনি ক্ষুব্ধ হন। মূলত এই কারণেই তর্কাতর্কির একপর্যায়ে এই উদ্বুদ্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যদিও বরিশাল কোতয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ্ মো. আওলাদ হোসেন মামুনের ভাষ্য হচ্ছে- তিনি ঘটনা সম্পর্কে মোটেও ওয়াকিবহাল নন। তাছাড়া কেউ তাকে কিছু অবহিতও করেনি।

তবে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান বলছেন- ঢাকা থেকে আসা কতিপয় বাজে ছেলেপান তাদের সদস্যদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে। এই ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

উল্লেখ্য দক্ষিণ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম মুরাদ শনিবার সকালে অর্ধশত লোকজন নিয়ে বরিশালে এসে দলীয় মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর নৌকা প্রতীকের স্বপক্ষে প্রচারণা করেন।’’

1 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন