২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

বরিশাল সিটি নির্বাচনেও সক্রিয় ৭৫-এর থিংক ট্যাংক

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:৫৮ অপরাহ্ণ, ১৪ জুন ২০১৮

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যাকারী চক্রের থিংক ট্যাকং চিরকাল সক্রিয় থাকবে- এটি মোটমুটি ইউ’র সঙ্গে কিউ’র মতো অনিবার্য বিষয় বলে ধরে নেয়া যায়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে একাধিকবার হত্যাচেষ্টা এরই অকাট্য প্রমাণ। কিন্তু এটি শুধু শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে- এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং খুনি চক্রের থিংক ট্যাংক বিভিন্ন মাত্রায় কাজ করছে সামগ্রিকভাবে, সারাদেশে। যা শুরু হয়েছে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধানীতাবিরোধীরা নিদারুণভাবে পরাজিত হবার পর থেকেই। যার আওতায় কেবল কেন্দ্র নয়, গ্রাসরুটও ছিল; যা আছে এখনো। সম্প্রতি বিষয়টি আমার বিশেষ উপলব্ধিতে এসেছে, বরিশালের সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।

বরিশালসহ তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সমাগত। ১৩ জুন ঘোষিত তফসিল অনুসারে ভোটগ্রহণ ৩০ জুলাই। বরিশালে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত সাদিক আবদুল্লাহ। তার পক্ষে জনমত যেমন শক্তিশালী, তেমনই মনোনয়ন প্রশ্নে বিরোধিতাও বেশ শক্তিশালী। তার পক্ষের বিষয়ে নানান ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও, বিরোধিতার হিসাব মিলানো কঠিন।

বাবার বার্ধক্যজনিত গুরুতর অসুস্থতা এবং ছিঁচকে ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের কারণে গত প্রায় দেড় বছর ধরে আমাকে ঘনঘন যেতে হয়েছে প্রিয় বরিশালে। মাসে দুই বার যাবার ঘটনাও আছে। যা অনেকের দৃষ্টিতেই বেমানান ঠেকেছে। কেউ কেউ ফোন করে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন, আপনি কি ঢাকা না বরিশাল? কোরবানির সময় যেমন অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্ন করা হবার, এবার আপনি গরু না ছাগল?

গত ১১ জুন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ইফতার মাহফিলে পাশে বসা শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি বরিশালে সেটেল্ড করেছেন? আমি বললাম না; তবে ৫/৬ বছর পর বরিশাল স্থায়ীভাবে থাকবো; যদি ততদিন বাঁচি। বাবুল ভাই বললেন, আসলে এখনই আসেন; বুড়ো বয়সে এসে লাভ নেই। আমি মনেমনে বললাম, ভাইরে আমার বুড়ো হতে আর কত বাকি! সেই কবিতার মতো, ‘রাত পোহাতে আর কত বাকি পাঞ্জেরি…।’ যাক, এ ভিন্ন প্রসঙ্গ।

ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বরিশালে ঘনঘন যাওয়া এবং অবস্থানের সময় পেশাগত প্রবণতা তো অর সিকায় তোলা ছিল না। পেশাগত কাজও কিছু করেছি। এজন্যই বলা হয়, ঠেকি স্বর্গে গেলেও…। আর এই ঠেকি স্বভাবের কারণে দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে আগের চেয়ে একটু হলেও বেশি চিনেছি। একই সুবাধে জেনেছি পুলিশ কর্মকর্তা এস এম রুহুল আমিনসহ বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ইতিবাচক অনেক বিষয়। খোঁজখবর নেয়ার আওতায় বরিশালের রাজনীতির খুঁটিনাটি বিষয় তো ছিলোই। তেমনই কমবেশি পরিচিত হয়েছি বরিশালে অনেক বিষয়ের দৈন্যদশার সঙ্গে। যে কদর্য চিত্র আমাকে বেশ পীড়া দেয়; বিশেষ করে বরিশালের সাংবাদিকতার চরম অধগতি। মহান পেশা হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকতা বরিশালে অনেকটাই হয়ে গেছে ঘৃণিত কর্ম হিসেবে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কেউ কেউ নারী ও মাদক ব্যবসার মতো অপকর্মেও জড়িয়ে গেছেন। যদিও বিএমপির ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মাহফুজুর রহমান বিশেষ এক কৌশলে এর রাশ অনেকটা টেনে ধরেছেন মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হবার আগেই। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগের অর্বাচিন বাড়াবাড়িতে এ কৌশল কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন বরিশালের পর্যবেক্ষক মহল।

বরিশালে বারবার যাতায়াত, পূর্বের জানাশোনা এবং সাংবাদিকতা পেশার আলোকে খোঁজখবর নিয়ে যা জেনেছি, তাতে সাদিক আবদুল্লাহর বিরোধিতার গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপরও পেশাগত স্বভাবের কারণে মনে হয়েছে, কোনো না কোনো কারণ হয়তো থাকতেও পারে। এই ধারণা থেকে তপংকর চক্রর্তী, স্বপন খন্দকার ও রাসেল হোসেনসহ বরিশালে বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ও তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছি। আর এ ক্ষেত্রে মৌলিক ধারণা দিয়েছেন তপংকর চক্রবর্তী। তার মন্তব্য, যারা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে অপছন্দ করে, তারাই সাদিকের ঘোর বিরোধী!

তপংকর চক্রবর্তীর এ মন্তব্য আমার চিন্তার জট অনেকটা খুলে দেয়। একটি সরল অংক মিলানো গেল অতি সহজে। তা হলো, ৭১ সালে যে পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেনি তারা স্বপরিবারে তাকে এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের হত্যা করেছে। এ হত্যা লীলার শিকার হয়েছেন আবুল হাসনাত অবদুল্লাহর পিতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং শিশুপুত্র শুকান্ত বাবুও; ঘাতকের বুলেটে আহত হয়েছে অনেকে। যাদের মধ্যে শাহানারা আবদুল্লাহ শানু এখনো শরীরে ঘাতকের বুলেট বহন করছেন প্রচণ্ড যন্ত্রণায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটনাচক্রে বেঁচে গেছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। তাই বলে তিনি কখনই ষড়যন্ত্র এবং বুলেটের নিশানার বাইরে ছিলেন না। তার প্রতি বরিশালে দুই বার গুলি বর্ষণ করা হয়েছে; একবার তার গাড়িতে এবং অন্যবার পৌরভবনে। তখন তিনি বরিশাল পৌর সভার চেয়ারম্যান ছিলেন, যা এখন সিটি কর্পোরেশন। এখানেই শেষ নয়, যতবারই দেশে রাজনৈতিক বৈরী অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ততবারই দেশ ত্যাগ করে জীবন রক্ষা করতে হয়েছে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে। এদিকে তার এ অনুপস্থিতির সুযোগে বরিশালে বিকল্প হাইব্রিড নেতা দাঁড় করাবার চেষ্টা হয়েছে। এতে সাফল্যও এসেছিল। তবে তা ছিল রংধনুর মতো। তাঁর হাত ধরে বরিশাল আওয়ামী লীগে আসা পরগাছা নেতা অনেকটা বিকল্প হিসেবে নিজকে জাহির করতে করতেই নিয়তির কাছে পরাজিত হয়েছেন। এদিকে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ রাজনীতিতে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন দক্ষিণবঙ্গের সিংহ পুরুষ হিসেবে।

যদিও বরিশালের বাস্তবতায় এ কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের পক্ষে প্রথম মিছিলটি বের হয়েছিল বরিশাল শহরে। কাকডাকা ভোরে বরিশালে বিশাল এ মিছিলের নেতৃত্ব প্রদানকারী এবং প্রক্যাশ্যে রাস্তায় বঙ্গবন্ধুর ছবি অবমাননার নায়করা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে মোটেই বেগপেতে হয়নি। এদের নেটওয়ার্ক এতোই শক্তিশালী ও বিস্তৃত। এই নেটওয়ার্ক ভেদ করেই বরিশালে রাজনীতি ও সংগঠন করতে হয়েছে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে। কাজেই, ৭৫-এর খুনি চক্রের থিংক ট্যাংক-এর চক্ষুশূল তিনি হবেন- এটিই স্বাভাবিক। এরই ধারাবাহিকতায় এই অপশক্তির শ্যেন দৃষ্টিতে পড়েছেন তার সন্তান সাদিক আবদুল্লাহ।

বরিশালে বিকল্প নেতা দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়ে হয়তো স্বাধীনতাবিরোধী থিংক ট্যাংক-এর ধারণা ছিলো, প্রকৃতির নিয়মে একসময় হাসানাত যুগের অবসান ঘটবে। কিন্তু তাদের ধারণা হোচট খেলো যখন সাদিক আবদুল্লাহ বরিশালের রাজনীতিতে নেমে পড়লেন আদাজল খেয়ে। এ ব্যাপারে শুরুতে রটানো হলো, ‘নিতান্তই ছেলে মানুষ, রাজনীতি-সংগঠনের কী বুঝবে!’ কিন্তু সংগঠন কত প্রকার এবং কী কী তা যখন সাদিক বুঝিয়ে দিলেন তখন নড়েচড়ে বসলো বিরুদ্ধ পক্ষ। এবার বলা হলো, সংগঠন এবং কর্মীবাহিনী শক্তিশালী করা পর্যন্তই; জনসমর্থন পাবে না। কিন্তু জনসমর্থনও যখন তুঙ্গে তখন বিরোধীরা খুবই হতাশ হয়ে পড়লো। কিন্তু হাল ছেড়েছে- এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে ১৫ আগস্ট কাকডাকা ভোরে বরিশাল শহরে খুনি মোশতাকের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব প্রদানকারী সেদিনের দাপটের ছাত্র নেতা পরে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছেন; তিনি এখন সংসদীয় ব্যক্তিত্ব। এ হচ্ছে অপশক্তির থিংক ট্যাংক-এর নানামুখি লবিং-এর ফল। যে লবিং এখনো চলছে। অন্যদিকে জোরালো লবিং আছে সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষেও। তবে শেষতক কোন লবিং বিজয়ী হয় তা স্পষ্ট হবে বরিশাল সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ঘোষণার পর। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, মেয়র পদে সাদিক আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন। আর এটি কোনভাবে ফসকে গেলে তা হবে বরিশাল আওয়ামী লীগের জন্য চরম এক দুঃসংবাদ; যার অনিবার্য প্রভাব পড়বে প্রায় সমাগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন