২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বড়দিনের প্রার্থনা: চাই সন্ত্রাসবাদ মুক্ত পৃথিবী

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৫৪ অপরাহ্ণ, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

আজ বড়দিন—মানবজাতির মুক্তিদূত যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন। দিনটি পৃথিবীর কোটি-কোটি খ্রিষ্টানের সবচেয়ে আনন্দের-মহামিলনের দিন। এদিনে খ্রিষ্টানরা গির্জায় নির্ধারিত ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মানবজাতির শান্তি ও কল্যাণ কামনায় বিশ্বব্যাপী বড়দিন উদযাপিত হয়।

খ্রিস্টমাস (খ্রিষ্টাব্দ) শব্দটি প্রাচীন ইংরেরিজ ভাষারীতি ক্রাইস্টেস মাস—যীশুর জন্মের বছর থেকেই এসেছে। যার অর্থ খ্রিষ্টের জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠান। যীশুর জন্ম কাহিনির গসপেল পড়ে জানা যায়—‘উত্তর প্যালেস্টাইনের গ্যালিলিও প্রদেশের নাজারথের ছোট্ট শহর বেথলেহমের অতি দরিদ্র ঘরের জীর্ণ পরিবেশে একটি শিশুর জন্ম হয়েছিল। যার বাবার নাম যোসেফ। মায়ের নাম মেরি (মরিয়াম)।

পৃথিবীর সর্বত্রই মহাপুরুষ-ধর্ম প্রবর্তকদের জন্ম বৃত্তান্তকে এক অলৌকিক রহস্যে আবৃত করেই তার অসাধারণত্ব প্রতিপন্ন করা হয়। যুগে-যুগে এটাই যেন ভক্তদের প্রধান প্রয়াস হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু মহাপুরুষেরা তো নিজেদের মহিমাতেই মহিমান্বিত হন। অতি রহস্যজাল কিংবা বংশগৌরবের মই ঠেকিয়ে এসব মহামানবের বাষ্পীয় উচ্চতায় তুলতে যাওয়াটা কতটা সমীচীন—বিষয়টা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কারণ, তারা যে বংশে, যেখানে, যেভাবেই জন্ম নেন, সে বংশ সূত্রধরের স্থল হলেও ধন্য তিনি তার কর্মে। তবু গসপেলকার লুকের বিবৃতি থেকে আমরা তো এটাই জানি যে, মাতা মরিয়ামের বাগবিবাহ হয়েছিল যোসেফের সঙ্গে।

কিন্তু তাদের মিলন সম্পর্কের আগেই দেখা গেল মরিয়াম গর্ভবতী হয়েছেন পবিত্র আত্মারই প্রভাবে। যোসেফ ধর্মনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তাই তার মনে ধর্মগত দ্বন্দ্ব দেখা দিলে, স্ত্রী-মরিয়ামকে সম্ভাব্য দুর্নাম থেকে রক্ষা করতে গোপনে তাদের বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন করবেন বলে মনস্থিরও করলেন। এমন সময় প্রভুর এক দূত স্বপ্নে যোসেফকে দেখা দিয়ে বললেন—‘দাউদের সন্তান যোসেফ, তোমার স্ত্রী-মরিয়ামকে ঘরে আনতে ভয় পেয়ো না। কারণ, তিনি যে সন্তান সম্ভবা হয়েছেন, তা পবিত্র আত্মারই প্রভাবে হয়েছেন। তিনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেবেন। তুমি তার নাম রাখবে যীশু। কারণ, তিনিই আপন জাতিকে পাপ থেকে মুক্ত করবেন।’

লৌকিক স্বপ্নশেষে, হতাশা ও চিন্তাগ্রস্ত যোসেফের ঘুম ভাঙল। তিনি আনন্দিতও হলেন। সন্দেহ দূর হলো। তিনি সম্মানিত বোধ করলেন। তখন মরিয়ামকে স্ত্রী-সম্মানে গ্রহণ করতে, তার আর কোনও সংকোচ থাকল না। অতপর, মরিয়ামের গর্ভে যীশুর জন্মের কাছাকাছি সময়—মাথাপিছু ট্যাক্স ধার্য করার অভিপ্রায়ে রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার তার বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র লোকগণনার আদেশ দিলেন। প্যালেস্টাইনেও বাদশার ফরমান এসে গেল। সেই আহ্বানের সিদ্ধান্ত হলো— ইহুদিদের প্রত্যেক গৃহপতি তার নিজের শহরে গিয়ে, সেখানে পরিবারের সবার নাম লিখতে হবে। সেই উদ্যোগে যোসেফকেও তার গর্ভবতী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে হয়েছিল ডেভিডের জন্মস্থান বেথলেহেমে। কারণ, রাজা ডেভিড ছিলেন যোসেফের পূর্বপিতামহ।

একই উদ্দেশ্যে বহু লোককেই দূর থেকে আসতে হয়েছিল। মারিয়মের অসুস্থতার কারণে খুব দ্রুত বেথলেহম শহরে পৌঁছতে পারেননি যোসেফ দম্পতি। তাই, আগে-ভাগেই শহরের সমস্ত সরাইখানায় লোকেরা জায়গা করে নিয়েছিল। বেথলেহমে পৌঁছেই মরিয়মের প্রসব বেদনা বেড়ে উঠল। নিরুপায় যোসেফ তখন সেখানকার কোনও এক বাড়ির পরিত্যক্ত আস্তাবলে আশ্রয় নিলেন। যেখানে গরু-ঘোড়া, ছাগল-ভেড়া, গাধা-খচ্চর থাকে। তেমনই একটি জায়গায় যোসেফ তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে কোনও করমে কিছু খড় বিছিয়ে নিজেদের জন্য একটু জায়গা করে নিয়েছিলেন। আর সেই রাতেই সমস্ত আঁধার বিতাড়িত করে মরিয়মের কোলে আবির্ভূত হলেন ত্রাণকর্তা যীশুখ্রিস্ট।

যিনি ছিলেন সৃষ্টির আদি এবং অন্ত কিংবা অনন্ত, তারই জন্ম হলো খড়ের বিছানায়, দারিদ্র্যে আবেশে গোশালায়। জনমানবশূন্য জায়গায় বাবা যোসেফ আপন হাতেই নবজাতকটিকে একটুকরো কাপড়ে জড়িয়ে পশুদের জাব দেওয়ার ‌ ‘তাগাড়ে’ শুইয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ইতিহাসের বিবরণ মানতে হলে, যীশু যখন জন্মেছিলেন তখন প্যালেস্টাইন রোমের ঠিক সরাসরি শাসনাধীন ছিল না। হেরদই তখন সেখানকার রাজা। তার মৃত্যুর পরেও জুডিয়া আর গ্যালিলিও প্রদেশেও দীর্ঘদিন হেরদের ছেলের রাজত্বই বহাল ছিল। তাই হেরদকে নিয়েও যীশু সম্পর্কে যে সব কাহিনি প্রচলিত আছে, তা ইতিহাসের পাতায় আদপেই আছে কি নেই, না ভেবে বরং সাধু মথির গসপেলে আরও যা বর্ণিত আছে সে দিকে দৃষ্টি ফেরাই—‘যীশুর জন্মের পরপরই পূর্বদেশ থেকে একদল দৈবজ্ঞ গুণী জেরুজালেমে আসেন। তারা খোঁজ করতে থাকলেন ইহুদিদের যিনি রাজা হবেন, তিনি কোথায় জন্মেছেন। পূর্ব আকাশে তারা সেই জন্মতারার সন্ধান পেয়েছেন। তাই তাকে সম্মান জানাতে তারা এখানে এসেছেন।

কথাটি হিংস্র হেরদের দরবার পর্যন্ত পৌঁছলে, রাজত্ব হারানোর ভয়ে রাজা খানিকটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। আর তিনি তখনই ইহুদিদের পুরোহিত আচার্য উপাধ্যায়সহ সবাইকে ডেকে এনে, এ বিষয়ে শাস্ত্রে কী লেখা রয়েছে, তা জানতে চাইলেন। এ বিষয়ে তখন তারা জানালেন—শাস্ত্রে তো আছেই, যীশু বেথলেহেমে জন্মাবেন। হেরদ তখন জ্যোতিষীদের ডেকে তাদের কথা শুনলেন। তাদের বেথলেহেমে যাওয়ারও নির্দেশ দিলেন। তিনি এ-ও বললেন, যীশুকে খুঁজে পেলে তারা যেন তাকে বলে যান, তাকে কোথায় দেখেছেন, কোন জায়গায় আছেন। তাহলে তিনিও যাবেন, তাকে দেখতে ও সম্মান জানাতে।

রাজার নির্দেশ পেয়ে গ্রহাচার্যরা বেথলেহেমের দিকে গেলন। আশ্চর্য যে, পূর্বাকাশের যেখানে সেই তারাটি দেখলেন, এটি যেখানে স্থির ছিল, সেখানেই আস্তাবল বাড়িতে যীশু জন্মেছেন। দৈবজ্ঞরা সেখানে গিয়ে শিশুটিকে তার মায়ের কোলে দেখতে পেলেন। বাবা যোসেফও ছিলেন সেখানে। তারপর পণ্ডিতেরা রাজা হেরদের হীনউদ্দেশ্য অনুধাবন করতে পেরে অন্য পথে স্বদেশে ফিরে গেলেন। একই রাতে যোসেফও ঐশ্বরিক দৈববাণী মতে, যিশু ও তার মা মরিয়মকে নিয়ে মিশরের উদ্দেশে পালিয়ে যান।

এদিকে, অপেক্ষমান চতুর হেরেদ বুঝতে পারলেন, দৈবাচার্যরা তাকে ফাঁকি দিয়ে গেছেন। এরপর রাজা চটে গিয়ে বেথলেহেমের সমস্ত ছেলেশিশুকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জল্লাদরা তখন হেরদের সেই নিষ্ঠুর নির্দেশ পালন করে বেথলেহেমের সমস্ত শিশুকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু যীশুই সেই ব্যক্তি, যিনি সেদিন থেকে বেঁচেই ছিলেন। তিনিই তো এই জগতের পাপ ও মৃত্যুকে গ্রহণ করার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। আর সেই মৃত্যুর চরমমূল্য দিতে তিনিই মানবজাতির মুক্তিদাতা হয়ে এসেছিলেন এই মর্তের ধূলায়।

এই উপলব্ধিতেই, যীশুখ্রিস্টের জন্মের এই দিনটি বিশ্বের সব অসহায়-বিচলিত-বেদনার্তের প্রতি প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার দিন হিসেবে মহিমান্বিত। আর আধ্যাত্মিক অর্থে এই দিনটি আমাদের জন্যে (মহৎ দিন) ক্রিসমাস কিংবা বড়দিন বলে আখ্যায়িত হয়ে ওঠে।

যীশু খ্রিস্টের জন্মবৃত্তান্ত ও তৎকালী ধর্মীয়-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে—বাইবেলে নারীর উৎপত্তি, ভূমিকা ও ভাবমূর্তি সম্পর্কে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার সমালোচনা করেই প্রবল যুক্তির মাধ্যমে রচিত হয়েছে ওম্যানস বাইবেল অধ্যায়গুলো। কুমারী মায়ের গর্ভে যীশুর জন্মের ঘটনায় সেদিন পৃথিবীর সব আধিপত্যবাদী পিতৃতন্ত্রের কায়েমি কাঠামোতে প্রবল ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থাৎ বাবা ছাড়া কেবল মাও সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা লাভ করতে পারেন, এই ধারণা-সংবাদ সেদিন পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সমাজে একটি প্রবল নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল।

পৃথিবীতে যীশু এসেছিলেন মানব জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে। মানুষকে দিয়ে গেছেন মুক্তি। পৃথিবীকে শুনিয়েছেন শান্তির বাণী। অথচ আজকের পৃথিবী ভরে উঠেছে হানাহানি, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদে। মানবজাতির মুক্তিদূত যীশুর জন্মদিনে এই প্রার্থনা—সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ মুক্ত পৃথিবী হোক।

লেখক: কবি

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন