২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

সারল্যের শক্তি: বরিশালের মনীষা আর রাজশাহীর মুরাদ

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:১৪ অপরাহ্ণ, ২৯ জুলাই ২০১৮

পেটের মার, মানের মার, জানের মার খেয়ে আমাদের সময়ের মুখ প্রায় অন্ধকার। মনে হয়েছিল যে জীবনের নাম মহাশয়, যা সওয়াও তা-ই সয়। মাত্র কয়েক মাস আগে হতাশায় লিখেছিলাম, অন্ধকার ক্রমে সয়ে আসছে। ভুল লিখেছিলাম। অন্ধকার যে সহ্য হচ্ছে না আর, সরলমতি কিন্তু জেদি তরুণ-তরুণীরা তা জানিয়ে গেল। সত্যিই ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’। কোটা সংস্কার আন্দোলনে হঠাৎ আলোর সেই ঝলকানি দেখা যায়। বলপ্রয়োগের অন্ধকার থাবা তাদের ঢেকে দিতে চাইলেও পারছে কই? ধিকি ধিকি তুষের আগুন জ্বলছেই।

রাজনীতি ও প্রতিবাদের মাঠে নতুন ফল ফলেছে। সেই ফলের নাম ‘ইনোসেন্স’। এই ইনোসেন্স মানে নিরীহ না, এই ইনেসেন্সের অর্থ সরল সত্যের শক্তি।

এবারে আলোর ঝলকানি হয়ে এসেছে এক তরুণ আর এক তরুণী। বরিশালের মনীষা চক্রবর্তীর কথাই আগে বলি। তাঁর পরিচয় এখন গল্প হয়ে ছড়াচ্ছে। গত এপ্রিল মাসের শেষে ফেসবুকে একটা ভিডিওর খুব ছড়িয়ে গেল: লম্বা মতো এক শ্যামলা তরুণীকে গ্রেপ্তার করতে বরিশালের পুলিশ হুলুস্থুল লাগিয়ে দিয়েছে। মেয়েটিকে ঘিরে থাকা জনতাকে বেধড়ক পেটাতে হচ্ছে। মেয়েটিকে ঘিরে আছে লুঙ্গি-স্যান্ডেল পরা ভাঙাচোরা চেহারার একদল মানুষ। তরুণ ও বৃদ্ধ, লুঙ্গি-টুপি-দাড়ি শোভিত। পেশায় সবাই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক। রাস্তা থেকে তাঁদের উচ্ছেদ ঠেকাতে পেটের দায়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন। বাসদ নেতা ডা. মনীষা দলবল নিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

মনীষা গ্রেপ্তার দৃশ্য এক চোখে পানি আরেক চোখে ক্ষোভের বাষ্প জমায়্ সাত ভাই চম্পার মতো সংগ্রামী বোনকে জাপটে ধরে আছে ভাইয়েরা, আর বোনটিও আঁকড়ে আছে ভাইদের। ছাড়াতে হলে এই বন্ধন আগে ছিঁড়তে হবে। পুলিশ পারেনি ছিঁড়তে। শেষে মনীষাসহ সবাইকে জেলে নেয়।

গল্পটা সেখানেই শেষ না। জামিনে মুক্ত হয়ে মনীষারা ফিরলেন। ফিরলেন তাঁদের কাছে, যাঁদের হয়ে তিনি লড়াই করছিলেন, জেলে গিয়েছিলেন। বীজ যেমন সজল মাটি পেলে শিকড় চারিয়ে দেয়, জনগণও তেমনি বিশ্বাসী নেতা পেলে তার চারপাশে খেতের বেড়ার মতো দাঁড়িয়ে পড়ে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বাসদের পক্ষ থেকে দাঁড়ালেন মনীষা। সেই বয়সী দিনমজুরেরা মাথায় হাত দিয়ে মেয়েটিকে দোয়া করে, ছাত্রছাত্রী-শ্রমজীবী তরুণেরা তার মিছিল লম্বা করতে থাকে। মনীষার মার্কা মই যেন তলার মানুষের ওপরে উঠে আসারই প্রতীক।

প্রথমে গুঞ্জন, তারপর আলোচনা তারপর মনীষা একটা আলোড়ন। খবরাখবর ও ছবি থেকে মনে হচ্ছে, বরিশালের সজল মাটি তাঁকে নিয়েছে। তিনিও সেখানকার মানুষের মনে ছাপ ফেলতে পারছেন। যাঁরা বলেন দেশে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে, তাঁরা মনীষা এবং তাঁর মিছিলের মানুষদের দিকে তাকালে নজরটা ধুয়ে নিতে পারেন। হিজাব পরা নারী, সুন্নতি টুপি-দাড়ির মানুষ—কে নেই? হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ শিক্ষিত-কুটিল মানুষেরা যত করে, আমজনতা ততটা করে না। মনীষার বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তায় তারই আলামত। মানুষ দেখে সততা, মানুষ দেখে জনগণের জন্য কষ্ট করার ত্যাগের নমুনা। বছর কয়েক আগে রাজধানীর তোবা গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা বেতনের দাবিতে আমরণ অনশনের দৃশ্যে এই ডাক্তার মেয়েটিকে নিরলসভাবে সেবাশুশ্রূষা করতে দেখা গিয়েছিল। মানুষ পরীক্ষা নেয়। একবার যখন সে পরীক্ষায় আপনি পাস করবেন, মানুষ আপনাকে নয়নের মণি করে রাখবে।

খুলনা ও গাজীপুরের মেয়র নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বলে, সবই হচ্ছে সরকার-নির্ধারিত ছক অনুযায়ী। তারা যা চাইবে, তা-ই হবে। কিন্তু সেই ছকের মধ্যে আরেক ছকভাঙ্গা প্রার্থী রাজশাহীর মুরাদ মোর্শেদ। অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রশিবির-ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, যৌন নিপীড়ন এবং প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। রাজনীতি করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ফেলে নতুন করে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে আইনজীবী হয়েছেন। কোন সেই শক্তি যা মুরাদের মতো যুবকদের কালো টাকা ও পেশী শক্তির সঙ্গে লড়তে সাহস যোগায়? সেটা বোধহয় নিষ্ঠা, মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং আত্মসম্মান। ফ্রাঞ্জ কাফকার বিখ্যাত ইউরোপীয় উপন্যাস ‘মেটামরফোসিস’ বা ‘রূপান্তর’ নিয়ে কত হৈ চৈ। আমাদের দেশে কত লোক আত্মসম্মান খুইয়ে রূপান্তরিত হয়ে পরিণত হচ্ছে ভেড়ার পালে কিংবা পা-চাটা কুকুরে কিংবা রক্তখেকো নেকড়েতে! আবার কেউ কেউ পোকামাকড়ের জীবনটাকে রূপান্তর করতে মানুষের মতো উঠে দাঁড়াচ্ছে!

পোড়খাওয়া বললে একসময় সুনাম বোঝাতো। কিন্তু এখন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ বলতে বোঝায় ঘাগু, পল্টিবাজ, দুর্নীতিমত্ত ধুরন্ধর নেতাকে। ঐসব পোড়খাওয়ারা অনেক পোড় খাইয়েছেন দেশটাকে। বাংলাদেশের এখন চাই বন্যার মতো নতুন সজীব পানি। যে বান জনসমাজে পলির আস্তর ফেলে আবার উর্বর করবে গণমুখী রাজনীতির মাঠকে।

বাংলাদেশ এমন এক দেশ, যেখানে ভালো মানুষেরা তলিয়ে যাচ্ছেন আর ঘোলা জলে ভ্যাদা মাছের মতো ভেসে উঠছে চরম নিকৃষ্ট মানুষেরা। কিন্তু বরিশালের ডাক্তার দিদি আর রাজশাহীর অ্যাডভোকেট ভাইরা হাজির হয়ে জানালেন, আশা আছে।

বর্তমানে রাজনীতিতে যে ভানুমতির খেল চলছে, তাতে নির্বাচনে জনগণের নিজস্ব মানুষের জয় কঠিন। কিন্তু এভাবে যদি তরুণেরা আসতে থাকেন, যদি নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ নিয়ে তাঁরা মানুষের জড়তা ভাঙার চেষ্টা জারি রাখেন, যদি নিজ নিজ দলের মুখস্ত বুলি আর অচল ঠাঁটবাট ছেড়ে সরল মনে মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে দিনবদল হবেই। তরুণ বঙ্গবন্ধুকে দেখুন। কত কত পোড়খাওয়া ঝানু নেতাকে পেছনে ফেলে তিনি উঠে এসেছিলেন দুটি যোগ্যতায়। তিনি মানুষকে বিশ্বাস করে তাঁদের কাছে বারবার গিয়েছেন; বসে থাকেননি কখনো এবং তিনি পুরোনো বুলিবাগীশতা ফেলে সময়ের প্রয়োজনটা ধরতে পেরেছিলেন।

জনগণ হলো হাতির মতো, যে নিজের শক্তি সবসময় টের পায় না বলে দুর্বল মাহুতকে পিঠে বসতে দেয়। জনগণ আগে থেকে তৈরি কোনো জিনিস না। গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থী রাজশাহীর মুরাদ মোর্শেদর হাতি প্রতীকের অর্থ সেভাবেই করা যায়। নেতাকে প্রথমে কল্পনা করতে হয় যে এই জনতা আমার এবং আমিও তাদের। নেতার কল্পনা-অধ্যবসায় আর সাহসের কারণে জনগণ একসময় টের পায় যে তাঁরা আছেন এবং সংগঠিত হলেই তাঁরা ভাগ্য বদলাতে পারেন। কল্পনা তখন সত্যি হয়। অবশ্য তার জন্য চাই সৎসাহস। সৎসাহসের ভরসা তরুণেরা ছাড়া আর কে জোগাবে? সাবাশ যদি দিতে হয় সাবাশ দেব তাদের।

দেশ যখন রসাতলে তখন ফন্দিফিকির, ভীরুতা কিংবা ভেজাল চরিত্র দিয়ে তাকে ঠেকানো যায় না। নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, সারল্য ফিরে আসছে। ইতিহাস মনে হয় চলতে শুরু করেছে।

  • ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
1 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন