বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১২:২৭ অপরাহ্ণ, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯
বার্তা প্রতিবেদক, বরিশাল::: বছরজুড়ে নিষিদ্ধ বিভিন্ন ধরনের জালের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযানের মাধ্যমে জাল জব্দ ও ধ্বংস করার পরও কমছে না এর ব্যবহার। ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন মাছের রেনু-পোনা থেকে শুরু করে জলজ প্রাণীর জীবন।
অল্প সময় ও পরিশ্রমে বেশি মাছ শিকারের লোভে ওইসব জাল ব্যবহার করা হয়। সামগ্রিকভাবে মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হওয়ায় এসব জালের ব্যবহার রোধে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, আগের চেয়ে সার্বিক বিষয়ে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রলোভনসহ নানা কারণে অবৈধ জালের ব্যবহার করছে কতিপয় জেলেরা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস-২ (আইন) অধিশাখার ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল প্রকাশিত একটি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রতি বছর ফাল্গুন থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত দুই ধরনের জাল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরমধ্যে টানা জাল ও কাঠি জাল রয়েছে। টানা জাল, যার প্রচলিত নাম মশারি জাল আর স্থানীয় নাম কাঁথা জাল, বেড় জাল এবং কাঠি জাল যার প্রচলিত নাম চট জাল আর স্থানীয় নাম জগৎ বেড় জাল বা ভীম জাল।
এছাড়া স্থিরকৃত জাল যার প্রচলিত নাম উপকূলীয় বেহুন্দি জাল। এর ব্যবহার সারবছরই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও এ জালের স্থানীয় বেশ কিছু নাম রয়েছে। এরমধ্যে বাঁধা জাল, পেকুয়া জাল, বিঙ্গি জাল, গাড়া জাল, চিংড়ি পোনা ধরা জাল, খুঁটি বা খোটা জাল, টং জাল ও বিন্দি জাল হিসেবেও পরিচিত এটি।
আর এই বেহুন্দি জাতের জালই উপকূলীয় এলাকা তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য সম্পদের বেশি ক্ষতি করে থাকে। এসব জালের কারণে শুধু মাছের পোনাই নয় ডিমও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পটুয়াখালীর বিভিন্ন শুঁটকি পল্লি সূত্রে জানা যায়, বেড়, বাধা, মশারি ও বেহুন্দি জালের ছিদ্র এতটাই ছোট যে, প্রায় সব ধরনের নদীর মাছ, মাছের পোনা এমনকি ডিমও আটকা পড়ে। এরমধ্য থেকে কিছু মাছ বাজারে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হয়। আর কিছু মাছ শুঁটকির জন্য পল্লিতে চলে যায়। তবে একেবারে যেটা মাছের ছোট পোনা, তা জাল ঝাড়ার সময়ই ফেলে দেওয়া হয়। আর ডিমের অস্তিত্ব যা থাকে জালে তাও ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো কেউ নদীতে ফেলছেন আবার কেউ ডাঙায়।
যদিও এভাবে কী পরিমাণ মাছের পোনা ও ডিম প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে তার কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি মৎস্য বিভাগ। তারা বলছে, সারাবছরই অবৈধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বেহুন্দিজাল, কারেন্ট জাল ও অন্য অবৈধ জাল অপসারণে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালানো হয়। যেখানে বরিশাল বিভাগজুড়ে ৬৫৩টি অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ২৫৪টি বেহুন্দি জাল আটক করা হয়েছে। এছাড়া এই অভিযানে ১ হাজার ৯৩টি অন্য জাল ও প্রায় ৩৪ লাখ মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছিল।
এছাড়া ২০১৮-১৯ সালের জাটকা রক্ষা কর্মসূচিতে বরিশাল বিভাগে ৩ হাজার ২৯৯টি অভিযানে ২ কোটি ৮৪ লাখ মিটার কারেন্ট জালের সঙ্গে অন্য ১ হাজার ৮৮৬টি অবৈধ জাল আটক করা হয়।
আর ২০১৯-২০ সালের জাটকা রক্ষা কর্মসূচিতে এ পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ১০৬টি অভিযানে ২ লাখ মিটার কারেন্ট জালের সঙ্গে অন্য ২০টি অবৈধ জাল আটক করা হয়। এছাড়া ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত প্রধান প্রজনন মৌসুমে ৮৯ লাখ মিটারের বেশি অবৈধ জাল আটক করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে অভিযানে সফলতা দেখা দিলেও এর প্রভাব পড়ছে শুধু ইলিশের ওপর। দিনে দিনে ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ বিলীন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (হিলসা) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, সারাবিশ্বে ওপেন ওয়াটার আছে যাদের, তাদের কিন্তু বলতে হয় না, যে ছোট মাছ ধরবে না। কিন্তু আমাদের এখানে এর বিপরীত ঘটছে। আমাদের দেশে জনসংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি জেলেদের বিকল্প চিন্তাভাবনাও নেই। যেমন, যখন মাছ কম কিংবা প্রজনন মৌসুম থাকবে তখন তারা যেন অন্য কাজ করে আয়-রোজগার করে। শুধু মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল থাকলে হবে না। আপদকালীন সময়ের জন্য তাদের কাছে কিছু থাকে না। অর্থাৎ জেলেদের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস বা স্বভাব নেই। তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি অতি আহরণ বন্ধ করতে হবে। তবে আশার আলো হচ্ছে, ধীরে ধীরে এসব চিন্তাভাবনা জেলেদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে মাছ ধরতে একবারে হাজার হাজার মানুষ নেমে যায়, যে যার ইচ্ছে মতো যত খুশি মাছ ধরে। কেউ ধরে ১ কোটি টাকার মাছ আবার কেউ ধরে ১০ হাজার টাকার মাছ। একজনের জাল বিশাল, আর একজনের নেই। অর্থাৎ কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে একসঙ্গে অনেক মাছ ধরলে পরে সেখানে আর মাছ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটা নিয়ম থাকা উচিত। নিয়মটা হওয়া উচিত এরকম, যে কেউ-ই চাইলেই অতিরিক্ত মাছ ধরতে পারবেন না। নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ উল্লেখ করা থাকবে এর বেশি মাছ কেউ ধরতে পারবেন না।