বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১০:৩৮ অপরাহ্ণ, ১৯ নভেম্বর ২০১৬
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ায় উল্টে গেছে দলটির সামগ্রিক প্রস্তুতিসহ নির্বাচনি ছক। এর ফলে ব্যর্থ হয়েছে আইভীকে ঠেকাতে মহানগর সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে কেন্দ্র করে সাজানো শামীম ওসমানের অনেক উদ্যোগ। তছনছ হয়েছে তার সাজানো বাগান।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মনোনয়ন পাবেন এমন ধারণা থেকেই সিটি নির্বাচনের বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তাকে সমর্থনকারী প্রভাবশালী নেতা ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান এবং তার অনুগামী নেতাকর্মীরা। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রে আনোয়ার হোসেনসহ যে তিন জনের নাম পাঠানো হয় সেই তালিকার বাকি দু’জনও ছিলেন শামীম ওসমানের অনুগত নেতা। আর নির্বাচনে জয় হবে ধরে নিয়ে মিডিয়া সেল, ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠন, নির্বাচনি প্রচারণাসহ সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছিল। কিন্তু, তাদের সর্বোচ্চ প্রতিরোধ সত্ত্বেও শুক্রবার সেলিনা হায়াৎ আইভী মনোনয়ন পাওয়ায় ওলোটপালট হয়ে গেছে সব প্রস্তুতি। সিটি নির্বাচন নিয়ে শামীম ওসমানের দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং তার পরিণাম দেখে স্থানীয়দের অনেকে ক্রিকেটীয় ভাষায় মন্তব্য করছেন, ‘সিটি নির্বাচনে ছক্কা মারতে গিয়ে আইভীর মনোনয়নে আউট হয়ে গেলেন শামীম ওসমান।’
জানা গেছে, ২০১১ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইভীর পক্ষে কাজ করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। সে বছরের ১৮ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে পরিবহন সংক্রান্ত এক সভায় আনোয়ার হোসেনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেন শামীম ওসমান। কিন্তু, ২০১৪ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি নাসিম ওসমানের মৃত্যু ও পরে সংসদে দাঁড়িয়ে ‘ওসমান পরিবারের পাশে থাকব’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন ঘোষণার পরই শামীম ওসমানের বলয়ে চলে আসেন আনোয়ার হোসেন। একই বছরের ২৬ জুন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপ নির্বাচনে সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করেন আনোয়ার হোসেন।
২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শহরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় নাগরিক সমাজের ব্যানারে আওয়ামী লীগ নেতাদের সমাবেশ থেকে আইভীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেন শামীম ওসমান, সে সভায় সভাপতিত্ব করেন আনোয়ার হোসেন। ওই সময়ে শহরে আইভীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণার অংশ হিসেবে ব্যাঙ্গাত্মক ফেস্টুন ব্যানার ব্যবহৃত হতে থাকে।
গঠন করা হয়েছিল মিডিয়া সেল, কর্মীদের জন্য ছিল নির্দেশনা
গত ১৪ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর ১৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় আনোয়ার হোসেনের নাম প্রস্তাব করা হয়। সেদিনই শামীম ওসমান একটি মিডিয়া সেল গঠন করে দেন আনোয়ার হোসেনের জন্য। সেদিন শামীম ওসমান জানান, আনোয়ার হোসেনের নির্বাচন নিয়ে কথা বলবেন তিনজন। তাঁরা হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চন্দন শীল, যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাত।
ওই বর্ধিত সভায় শামীম ওসমান কর্মীদের দিক নির্দেশনা দিয়ে বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটি ছাড়াও নির্বাচন পরিচালনার জন্য আলাদা কমিটি গঠন করতে হবে দলীয় ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নিয়ে। শামীম ওসমান তখন বলেন, ‘আল্লাহর যদি হুকুম হয়, আর আমাদের নেত্রী যদি আনোয়ার ভাইকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করেন তাহলে আপনাদের সকলের চেষ্টায় তিনিই হবেন নারায়ণগঞ্জের পরবর্তী মেয়র। আপনাদের কারও কোনও কাজ যদি তিনি অসম্পন্ন রাখেন তাহলে তিনি আল্লাহর কাছে ঠেকা থাকবেন।’
মাজার জিয়ারত করে প্রচারণা শুরু করেছিলেন আনোয়ার
১৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় আনোয়ার হোসেন শহরের দেওভোগে হযরত মিন্নত আলীর মাজার জিয়ারত শেষ করে নগরবাসীর দোয়া চেয়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে শহরে বের হন। এর আগের দিন মহানগরের সভায় আনোয়ার হোসেনকে মাজার জিয়ারত করে নগরবাসীকে নির্বাচনি সালাম দিয়ে কাজ শুরু করার জন্য বলা হয়েছিল।
নির্বাচনের জন্য আনোয়ার মহানগর সভাপতির দায়িত্বও ছাড়েন
আনোয়ার হোসেন সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে মনোনয়ন পাবেন সে আত্মবিশ্বাস থেকেই তার ওপর চাপ কমাতে গত ১৫ নভেম্বর মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় তার ওপর থেকে দলীয় চাপ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেদিন আনোয়ার হোসেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে নির্বাচনি কাজের জন্য কিছুদিনের জন্য অব্যাহতি নেন। পরে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় সহসভাপতি চন্দন শীলকে।
সভা শেষে মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট খোকন সাহা জানান, মঙ্গলবারের সভায় আনোয়ার হোসেন সভাপতিত্ব করলেও এখন তিনি নির্বাচনি কাজে থাকায় সহসভাপতি চন্দন শীলকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়।
আনোয়ার হোসেনকে ‘আনকনটেস্ট’ জয়ী করার ঘোষণা ছিল শামীম ওসমানের
গত ২১ জুলাই নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শামীম ওসমান বলেন, ‘নাসিকে মেয়র পদ আমার প্রয়োজন নাই। আমি যেখানে আছি সেইটাই ভালো। আমি এমপি, আমার ভাই এমপি। আর আমি ভুয়া এমপি না পাওয়ারফুল এমপি। আমি মন্ত্রীর রুমে গেলে ম্যাক্সিমাম মন্ত্রী চিন্তা করে আইছে কেন বাবারে? আগে বুইজ্জা লই। আপনারাই ঠিক করুন বটগাছ লাগাবেন না আম গাছ লাগাবেন। বটগাছের পাতা ছাগলে খায় আর আম গাছের আম খেতে পারবেন। আনোয়ার ভাই সারাজীবন রাজনীতি করছে। আইভীর পক্ষ হয়ে আনোয়ার ভাই সবচেয়ে বেশি গালাগাল করছে। কিন্তু একটা গালাগালও আমার লাগে নাই। কারণ আমি জানি আনোয়ার হোসেন সাচ্চা আওয়ামী লীগ করে। কিছু কোন্দলের কারণে বিভেদ থাকলেও আনোয়ার ভাই আর আমার আদর্শ এক। আমার তো মনে হয় আল্লাহর হুকুম হয়েই গেছে। আমার লাগবে না এমনিতে খবর হয়ে যাবে। আর ইলেকশনটা আনোয়ার হোসেন করবে না, করবে শামীম ওসমান। কারণ আনোয়ার ভাইয়ের কাছে না আছে টাকা না আছে পয়সা। আনোয়ার ভাই বাসায় বসে থাকবে।’
ওই সভায় শামীম ওসমান আরও বলেন, ‘‘আনোয়ার ভাই ইলেকশন করুক, আনোয়ার ভাইকে দল নমিনেশন দিক, আমি তো কই ইলেকশনটা ‘আনকনটেস্ট’ কইরা ফালামু ইনশাল্লাহ। আর আনোয়ার ভাইকে নমিনেশন দেওয়ার পর বিএনপি খাড়াইবো, খাড়াক দেখি জনগণ কী বলে। নিষেধ তো করা যায় না। নেত্রী যদি আনোয়ার ভাইকে ভালোবাসেন তাহলে নেত্রী আনোয়ার ভাইকে নমিনেশন দেবেন, আনোয়ার ভাইও পাস করবে। আনোয়ার ভাই ইনশাল্লাহ মনোনয়ন পাবেন এবং নির্বাচন করবেন।’
‘আনোয়ার ভাই নৌকা পেলে নিঃস্বার্থ কাজ’
গত ২৯ অক্টোবর বিকেলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কের পাশে ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামের পাশের খোলা মাঠে মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আরেকটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশের উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যানারে ‘মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদমুক্ত আধুনিক নারায়ণগঞ্জ গড়ার প্রত্যয়’ বিষয়টি উল্লেখ করা থাকলেও এটি ছিল মূলত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগাম প্রচারণা।
সে সমাবেশে শামীম ওসমান বলেছিলেন, ‘আমার নেত্রী আমাকে বলেছেন জনগণের কাছে যাও, জনগণের সেবা কর। আমি তাই করছি। জনগণের বাইরে এবং দলের নেতাকর্মীদের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। মঞ্চে থাকা নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের প্রচারণায় তখন শামীম ওসমান বলেন, তিনি একজন সাচ্চা আওয়ামী লীগের নেতা। আগামী নির্বাচনে যদি আনোয়ার ভাই নৌকা প্রতীক পান তাহলে নারায়ণগঞ্জের এ সমাবেশে আসা লাখো মানুষ নিঃস্বার্থভাবে আপনার পক্ষে কাজ করবে।’
ওই সময়ে শামীম ওসমান দুই হাত উঁচু করে আনোয়ার হোসেনের পক্ষে সমর্থন চাইলে সবাই হাত তুলে আনোয়ার হোসেনকে সমর্থন করেন।
মহানগরের সভাতেও আনোয়ার হোসেনের নাম
গত ১৫ নভেম্বর মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগ এক বর্ধিত সভা করে সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়নের জন্য তিন জনের নাম ঠিক করে। পরে তা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ। তবে সেখানে বর্তমান মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর নাম দেওয়া হয়নি। নাম পাঠানো হয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান এবং বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ রশিদের।
এভাবে মূলত সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ঠেকাতে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে ঢাল হিসেবেই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন শামীম ওসমান। আনোয়ার এ নির্বাচনে মনোনয়ন পেলে শামীম ওসমানের সব রাজনৈতিক উদ্যোগ সফল হয়ে যেতো। কারণ, শামীম ওসমানের কূটচালের পাশাপাশি দলীয় প্রতীকও হাতে পেলে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করা ভীষণ কঠিন হয়ে যেতো আইভীর জন্য। আর তাতে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে কোনঠাসাও হয়ে পড়তেন আইভী। তবে বিষয়গুলো বুঝতে পেরে এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে এবং দলীয় সূত্রে জনপ্রিয়তা যাচাই করে শুক্রবার রাতে বর্তমান মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপরেই আস্থা রাখেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। আর এ ঘোষণাতেই তছনছ হয়ে যায় শামীম ওসমানের সাজানো বাগান।