বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১১:৪৩ অপরাহ্ণ, ৩১ মে ২০১৬
বরিশাল: বরিশাল পলিটেকনিক কলেজে ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করিম রেজা হত্যার নেপথ্যে কলেজ কমিটি গঠনের বিষয়ই হচ্ছে মূল ইস্যু। মূলত রাজিব এবং নিহত রেজা গঠনের অপেক্ষায় থাকা কলেজ কমিটিকে নিজ নিজ পছন্দের দুই অনুসারীকে স্থান দেওয়া নিয়ে বিতর্কের এক ঘন্টার মধ্যেই এই হামলা এবং প্রাণবিয়োগের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন মহলের দাবি, ২৭ মে রাতে কলেজ গেটে সংঘটিত এই হত্যাকান্ড পরিকল্পিত। কিন্তু উভয়ে সাদিক অনুসারী হওয়ায় হত্যাকান্ডের আসামী করা নিয়ে তাদের অনুকূলে মতবিরোধ তৈরি হওয়ায় মামলাটি গ্রহনে পুলিশ কালক্ষেপনে বাধ্য হয়। কিন্তু আকস্মিক গত রোববার রাতে চলন্ত লঞ্চ থেকে মেহেদী হাসানকে আটকের পর পাল্টে যায় গোটা পরিস্থিতি। মেহেদী ও সাদিক অনুসারী যুবলীগ নেতা। একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করে জানায়, আটক মেহেদীকে কোতয়ালী মডেল থানা হাজতে গভীর রাতে বেধড়ক পিটুনি অর্থাৎ নির্যাতন চালানো হয়। ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে মেহেদীকে আদালতে উপস্থাপন করায় বিষয়টি মিডিয়ার নজরে আসে। অবশ্য পুলিশের মধ্য থেকেই এ নির্যাতের কথা আগেভাগেই জানা গেছে।
দল ঘনিষ্ট সূত্র জানায় বরিশাল পলিটেকনিক কলেজে সদর আসনের সাংসদ জেবুন্নেছা আফরোজ অনুসারীদের দখলে ছিলো।
সম্প্রতি তার প্রতিপক্ষ মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীরা সেই শক্ত অবস্থান খর্ব করে কলেজ নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নেয়। এরপরই শুরু হয় মেয়াদউত্তীর্ণ কলেজ কমিটি গঠনে সাদিক অনুকূলে তোরজোড়। জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব আহম্মেদের প্রস্তাব ছিলো তার এক অনুসারীকে কমিটির শীর্ষ পদে স্থান দেওয়া। কিন্তু রেজাউল করিম বিরোধীতা করে তার এক অনুসারীকে একই পদে বসানোর বিষয় অনড় ছিলো। রেজাউল করিম জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের অনুসারী এবং চৌকশ ছাত্রনেতা হিসেবে সাদিকের প্রিয়ভাজন ছিলো। ফলে রাজিব আহম্মেদের প্রস্তাব প্রত্যাক্ষাণ করলে এই ছাত্রনেতা এক পর্যায়ে সাদিক আবদুল্লাহকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। এবং রাজনীতিতে তার পাশ থেকে সড়ে দাড়ানোর হুমকি দেয়। উল্লেখ্য রাজিব ও রেজা কারো পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র নয়।
কিন্তু পলিটেকনিক কলেজের সাবেক নেতা হিসেবে জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের অনুসারী এই নেতা কলেজ নিয়ন্ত্রন শুরু করে। এবং ফাহিম নামক এক ছাত্রকে সেখানে দখল ধরে রাখার দায়িত্ব দেয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রটি জানায়, ২৭ মে রাতে রাজিব ও রেজার মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে সাদিক আবদুল্লাহ উভয়কে ডেকে আনে। রাত ৮টার দিকে নেতার সামনেই উভয় ছাত্রনেতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব আহম্মেদ সাদিক আবদুল্লাহর বাসা থেকে বেড়িয়ে যায়। এর এক ঘন্টা পরেই রেজা ও ফাহিম তিনটি মোটর সাইকেল যোগে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ মাত্রই তাদের উপর হামলা চালানো হয়। উভয়কে এলোপাতারি কুপিয়ে জখম করায় তাদের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকা পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু এর আগেই রাত ১০টার দিকে রেজা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই হত্যাকান্ড নিয়ে বিপাকে পড়ে যায় সাদিক আবদুল্লাহ ও তার উপদেষ্টারা।
সূত্র জানায়, সাদিকের অনুসারী অর্থাৎ ছাত্র সংগঠনকে ধরে রাখার দায়িত্বে থাকা জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক ঘটনার পরের দিন নিহত রেজার ভাই রিয়াজ উদ্দিনকে ডেকে আনে। নিহত রেজার বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার শিয়ালঘুনি এলাকায়। রিয়াজকে ডেকে আনার পর মামলার আসামী হিসেবে প্রতিপক্ষ জেবুন্নেছা গ্র“পের অন্যতম ছাত্রনেতা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি সম্পাদক জসিম উদ্দিন ও নিজ অনুকূলেরই রাজিব আহম্মেদ সহ বেশ কয়েকজনকে আসামী করে একটি তালিকা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমানের নিকট দাখিল করেন। ঘটনার পরের দিন সকালে মিডিয়া কর্মীদের প্রশ্নের মুখে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহনের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বলেন মামলাটি তিনি এজাহার হিসেবে এখনো নথিভূক্ত করেনি।
সৃষ্টি হয় রহস্য। অনুসন্ধানী সূত্র গুলো জানায়, ওই মামলায় মহানগর ছাত্রলীগ নেতা অসীম দেওয়ানকে আসামী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। বিশেষ কারনে তা হয়ে ওঠেনি। তবে মামলাটি গ্রহনে এ কালক্ষেপনের নেপথ্যে ছিলো জেবুন্নেছা আফরোজ ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর হুশিয়ারী। বিশেষ করে মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসিমকে আসামী করায় তারা মামলাটি গ্রহন না করতে পুলিশকে চাপের মুখে ফেলে দেয়। দ্বিতীয়তঃ মামলাটি দাখিলে ছাত্রনেতা রাজ্জাক যে তালিকা তৈরি করেছে তা সাদিক আবদুল্লাহরও মনপুত হয়নি।
তিনি চেয়েছিলেন সাজিয়ে গুছিয়ে এমন ভাবে আসামীর তালিকা তৈরি হোক যাতে প্রতিপক্ষ ছাত্রনেতারা মাঠ ছাড়া হয়ে যাক। অন্যদিকে ঘটনার সাথে জড়িত নিজ ঘরোনার ছাত্রনেতাদের রক্ষা করা। এ নিয়ে দুই দিন নাটকীয়তার পর যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসান লঞ্চযোগে গত শনিবার রাতে বরিশাল লঞ্চ টার্মিনাল ছাড়ার পরই পুলিশের কাছে খবর আসে তার পালিয়ে যাওয়ার রুট। অতপর পুলিশ স্পীডবোর্ট যোগে কীর্তনখোলা নদীর বেলতলা নামক স্থানে লঞ্চের গতিরোধ করে তাকে আটক করে নামিয়ে নিয়ে আসে। একটি সূত্র জানায়, জেবুন্নেছা অংশের অর্থাৎ তার সমর্থিত বেশ কয়েকজনের চোখে পড়ে মেহেদী এমভি কালামখানে উঠেছে। সেখান থেকে খবরটি পুলিশকে পৌছানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী একটি সূত্রের দাবি, রেজা হত্যাকান্ডে মেহেদী সরাসরি জড়িত না থাকলেও দূর থেকে দাড়িয়ে দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলো। হত্যার জড়িতদের মধ্যে বরিশাল পলিটেকনিক কলেজের ছাত্রনেতা ছোট মেহেদী সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে বহিরাগতদের মাধ্যমে এ হামলা চালায়। এই মেহেদীও সাদিক অনুসারী। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মেহেদীকে আটক করার পরই মৎস্যলীগ নেতা টুটুলের নেতৃত্বে ২০/২৫ জনের একটি দল থানায় প্রবেশ করে নতুন একটি তালিকায় ১৪ জনের নাম অন্তর্ভূক্ত করে মামলা গ্রহনে পুলিশকে বাধ্য করে। সেখানে মহানগর ছত্রলীগ সভাপতি জসিমকে হত্যার পরিকল্পনার নায়ক হিসেবে আসামী করা হয়। থানায় যেভাবে সাদিক অনুসারীরা অবস্থান নেয় তাতে পুলিশ পরে যায় বেকায়দায়। অপরদিকে, জেবুন্নেছা আফরোজ মামলাটি গ্রহণে পুলিশকে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিলেও উপেক্ষিত হয়ে যায় পরিস্থিতি গত কারনে। এরপর আটক মেহেদীকে যেন নির্যাতন না করা হয় তার একটি সংকেত দিয়ে আসে টুটুল ও তার সঙ্গীরা।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, নিহত রেজা হত্যার ঘাতক হিসেবে মেহেদীকে আটকের সময় তিন পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে আবু তাহের হচ্ছে নিহতের আপন খালাতো ভাই। গভীর রাতে আবু তাহের থানার হাজতখানা খুলে মেহেদীকে দ্বিতীয় তলা নিয়ে বেধড়ক পিটুনিতে গোটা এলাকা চিৎকারে কেপে ওঠে। এক পর্যায়ে মুখ বেধে চলে ভোররাত পর্যন্ত নির্যাতন। গতকাল মেহেদীকে বরিশাল আদালতে সোপর্দ করার সময় এই যুবলীগ নেতা পায়ে হেটে চলতে পারছিলো না বলে দেখা গেছে। এমনকি তার ডান পায়ে ব্যান্ডেস বাধা অবস্থায় দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে এসআই আবু তাহেরের সাথে যোগাযোগ করা হলে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে ব্যস্ততার অজুহাতে সেলফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। চলতি দায়িত্বে থাকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমানও একই সুরে কথা বললেন। মেহেদীকে নির্যাতনের বিষয়টি সাদিক অনুসারীরা অবগতের পর তারাও পুলিশের উপর ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
এদিকে, মেহেদী আটকে অর্ধঘন্টার মধ্যে দায়েরকৃত মামলায় মহানগর ছাত্রলীগ নেতা জসিমকে আসামী করায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও সাংসদ জেবুন্নেছা আফরোজ পুলিশের উপর চটেছেন। তাদেরকে আশ্বস্থ করা হয়েছে মামলার চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়ার। সাদিক আবদুল্লাহর কাছে এই গোপন খবর পৌছে যাওয়ার পর তিনিও ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতাদের মাধ্যমে পুলিশকে এমন ভাবে চেপে ধরেছেন যে, শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থায় বরিশাল কোতয়ালী থানা পুলিশ এখন রেজা হত্যাকান্ড নিয়ে বিপাকে পরেছে।