বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১২:৩১ অপরাহ্ণ, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬
বাংলায় ঈদ উৎসবের বিশদ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। আমাদের এই ভূখণ্ডে কবে, কখন, কিভাবে ঈদ উৎসবের উদ্ভব হয়েছে তার কালক্রমিক ঘটনাপঞ্জি কোনো ইতিহাসবেত্তা বা ইসলামের ইতিহাস গবেষক এখনো রচনা করেননি। তবে নানা ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র থেকে বাংলাদেশে রোজা পালন ও ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহা উদযাপনের যে খবর পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এ দেশে নামাজ, রোজা ও ঈদ উৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশ কিছু আগে থেকেই। এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব বাংলায় আসেন। অন্যদিকে আরবীয় ও অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক, তথা ধর্মীয় প্রভাব যে পূর্ব বাংলায় পড়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঈদ উৎসবের সূচনাও ওই প্রক্রিয়ায়ই হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত আব্বাসীয় খলিফাদের আমলের রৌপ্য মুদ্রা থেকে জানা যায়, অষ্টম শতকের দিকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ফলে এই সুফি, দরবেশ ও তুর্কি-আরব বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে সে যুগে তা ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব। এ দেশবাসীর ধর্ম সামাজিক পার্বণ নয়। এ দেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় ‘তাসকিরাতুল সোলহা’ গ্রন্থে। এ গ্রন্থে দেখা যায়, আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ সাল মোতাবেক ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন। বঙ্গদেশে ইসলাম আগমন পূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা ও বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তানা গেড়ে (সেন আমলে) ইসলাম প্রচার শুরু করেন বলে জানা যায়। শেখউল খিদা চন্দ্র বংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের শাসনকালে (৯০৫-৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেন বলে অনুমান করা হয়। তবে তাদের প্রভাবে পূর্ব বাংলায় রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয়েছিল, তা বলা সমীচীন নয়। তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ওই সব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন এ কথা বলাই সঙ্গত। কারণ বাংলাদেশে ‘নামাজ’, ‘রোজা’ বা ‘খোদা হাফেজ’ শব্দের ব্যাপক প্রচলনে বোঝা যায়, আরবীয়রা নয়, ইরানিরাই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কারণ শব্দগুলো আরবি ভাষার নয়, ফার্সি ভাষার।
রাজধানী ঢাকার (প্রতিষ্ঠা ১৬০৮ বা ১৬১০ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ঈদ উদযাপনের কিছু কিছু খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আকরগ্রন্থ ‘বাহারাস্তানই গায়েবী’ গ্রন্থের লেখক মির্জা নাথান ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার ইসলাম খাঁর সঙ্গে ঢাকায় আসেন। মির্জা নাথান তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে ঢাকায় ঈদ উৎসবের কিছু বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘সপ্তদশ শতকের গোঙায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আরবি শাবান মাসের ২২ তারিখ থেকেই রোজার আয়োজন শুরু হতো। এ সময় থেকে মসজিদ সংস্কার ও আবাসিক গৃহাদি পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলত। বাড়ির কর্ত্রী পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য নতুন সুরি কিনতেন। ইফতারের সময় ঠাণ্ডা পানি পান করা হতো, ইফতার সামগ্রী তৈরি করার জন্য গোলাপজল, কেওড়া ও তোকমা ব্যবহার করা হতো। মোগল ও পাঠান আমলে ঢাকায় পঞ্চায়েতি চৌকিদারের মাধ্যমে ডেকে সাহরি খাওয়ানোর প্রচলন ছিল। পরে ঢাকার নওয়াব খাজা আহসান উল্লাহর আমলে (১৮৪৬-১৯০১) বিভিন্ন পঞ্চায়েত থেকে কাসিদাদল বের হওয়া শুরু হয়।’
ঢাকাবিষয়ক গবেষক দেলওয়ার হাসান ‘নওবাহারই মুরশিদ কুলি খান’ গ্রন্থের লেখক আজাদ হোসেনি বিলগ্রামীর লেখার বরাত দিয়ে লিখেছেন : ‘নওয়াব সুজাউদ্দীনের অধীন মুরশিদ কুলি খাঁ (১৭০৪-২৫) ঈদের দিন ঢাকার দুর্গ থেকে ঈদগাহর ময়দান পর্যন্ত এক ক্রোশ পথে প্রচুর পরিমাণ টাকাকড়ি ছড়িয়ে দিতেন। নওয়াবের সহযাত্রী হয়ে ওমরাহ, রাজকর্মচারী ও মুসলমান জনসাধারণ শোভাযাত্রা করে ঈদগাহ মাঠে যেতেন ঈদের নামাজ পড়তে।
ঢাকার ইতিহাসবিদ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেছেন, ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহসুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম একটি ঈদগাহ নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট। নির্মাণকালে ঈদগাহটি ভূমি থেকে ১২ ফুট উঁচু করা হয়। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মোগল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এ ঈদগাহ। প্রথম দিকে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মোগল কর্মকর্তা এবং তাঁদের স্বজন-বান্ধবরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন। পরে ঈদগাহটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই ঈদগাহের পাশে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে একটি মেলারও আয়োজন করা হয়। এই ঈদগাহের পাশে একটি সুন্দর সেতুর চিহ্নও রয়েছে রেনেলের মানচিত্রে। ঈদগাহটি এখন সংরক্ষণ পুরাকীর্তি। তবে এর পূর্বদিকে নতুন মসজিদ নির্মাণ করে নামাজ পড়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঢাকা শহরে ঈদ উদযাপন এবং ঈদের মিছিলের অঙ্কিত বর্ণাঢ্য চিত্র জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ঢাকার নওয়াবদের সদ্য প্রকাশিত ডায়েরি থেকে ঢাকা শহরের ঈদের কিছু বর্ণনা উপস্থাপন করছি।
আজ রবিবার, পবিত্র বকরি ঈদ। নামাজ শেষে আমিও অন্যান্যের মতো কোলাকুলি করি। নওয়াব সাহেব আমাকে আদেশ দেন অন্যান্যকে নিয়ে বিনা খরচে ক্লাসিক থিয়েটারে নাটক দেখার জন্য। খাজা সলিমুল্লাহ তখন নওয়াব (কাজী কাইয়ুমের ডায়েরি)। নবাবরা রাজনৈতিক সুবিধার স্বার্থে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ইহজাগতিক স্বার্থের অনুসারী- এ ঘটনা তার প্রমাণ। ঈদের নামাজ আর নাটকের সহ-অবস্থানেই তৈরি হয়েছে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। (১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮ ফেব্রুয়ারির ঈদের বর্ণনা)
বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের সাম্প্রতিক বিপুল বিস্তার ও গভীরতা আমাদের আর্থসামাজিক রূপান্তরের একটি নতুন চিত্রকে সামনে এনেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়, ঘুষ-দুর্নীতির বিস্তার, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, সন্ত্রাসের সঙ্গে রাজনীতির সখ্য, অশান্তি ও আবিলতার সৃষ্টি করেছে তার ভেতর দিয়েও সমাজ এগোচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে নিরন্তর এবং এই পরিবর্তনের একটা ধারাবাহিকতাও আছে। ঈদ উৎসবের এই ধারাবাহিক পরিবর্তনের ধারার উৎস খুঁজতে হলে আমাদের ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাসের গ্রামীণ এবং সদ্য গড়ে ওঠা খুবই সীমিত আকারের নগরজীবনকে অবলোকন করতে হবে। তাতে হয়তো একটা সমন্বিত লোকজীবন (synthesized) খুঁজে পাওয়া যাবে কিছু বিরোধাত্মক উপাদান সত্ত্বেও। মৈমনসিংহ গীতিকা বিষয়ে অথরিটি চেক পণ্ডিত দুশান জবাভিতেলের বক্তব্য উদ্ধৃত করে মার্কিন ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটন (Richard Eaton) যে মন্তব্য করেছেন তার সারবত্তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। মৈমনসিংহ গীতিকার গবেষক দুশান (তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Folk Ballads from Mymensing and the problems of their Authenticity ১৯৬৩) মৈমনসিংহ গীতিকা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, আধুনিক-পূর্বকালের (Pre-modern) ময়মনসিংহের গীতিকাগুলো : Neither the Products of Hindu or Muslim culture but of a single Bengali Folk culture’- এই সূত্র ধরে ঐতিহাসিক ইটন সাহেব আধুনিক-পূর্ব বাংলাদেশের লোক ধর্মকেও শাস্ত্রীয় ধর্মের তুল্যমূল্য বিবেচনা করেছেন। সেভাবে দেখলে পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলের প্রচলিত ইসলামও ছিল লৌকিক ইসলাম। যাতে স্থানীয় আচার-সংস্কার বিশ্বাসে ছোপ লেগেছিল বেশ ভালোভাবেই। এই সমন্বয়ধর্মিতার নানা উপাদান (various syncritistic elements) বাংলার ইসলামকে বিশিষ্ট করেছিল।
ঈদ উৎসব শাস্ত্রীয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে দ্বাদশ শতকে বাংলায় ইসলাম এলেও চার-পাঁচশ বছর ধরে শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুপুঙ্খ অনুসরণ যে হয়েছিল, তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেকালের বাংলায় ঈদ উৎসবেও তেমন কোনো ঘটনা লক্ষ করা যায় না।
এর কারণ হয়তো দুটি-
এক. গ্রাম বাংলার মুসলমানরা ছিল দরিদ্র এবং দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো তেমন প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর অবস্থাও তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটা তো জানা কথাই যে সংহত সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর অবস্থাও তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটা তো জানা কথাই যে সংহত সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। বৃহৎ বাংলায় ঈদ উৎসব তাই সপ্তদশ, অষ্টাদশ এমনকি ঊনবিংশ শতকেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। নবাব-বাদশারা ঈদ উৎসব করতেন, তবে তা সীমিত ছিল অভিজাত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে, সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক উৎসব হিসেবে ঈদের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল না।
তবে গোটা উনিশ শতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে তার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগরজীবন ও গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের ওপর। মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও এই চেতনাকে শক্তিশালী করেছে। আর তাই এই অনুকূল পরিবেশেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালিত বাংলাদেশ আন্দোলন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার যে নবরূপায়ণ ঘটেছে, তাতে ঈদ উৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নতুন গুরুত্ব পেয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যে বিপুল মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে তা বিদ্যা, বিত্ত, রুচি ও সংস্কৃতিতে তেমন পাকা না হয়ে উঠলেও তারা সামাজিক শ্রেণি হিসেবে নতুন গুরুত্ব ও তাৎপর্য লাভ করায় তাদের প্রধান উৎসব হিসেবে ঈদ উৎসব জাতীয় মর্যাদা লাভ করে। এই ভূখণ্ডে ঈদের এই নতুন মর্যাদা এই প্রথম। বাংলাদেশে ঈদ এখন তাই যতটা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিকে তার অংশ, তারচেয়ে বেশি জাতিগত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নির্মাণের নবপ্রকাশ। বাংলাদেশের আধুনিক বাঙালি মুসলমানের ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে সমন্বিত করার এক নতুন প্রকাশও আমরা লক্ষ করি ঈদ উৎসবের নববিন্যাসের মধ্যে। বাঙালি মুসলমান এভাবেই তাদের জীবনের একটা কনট্রাডিকশন বা দ্বন্দ্বের সমাধান প্রত্যাশা করেছিল।
কারণ তাদের ধর্মগ্রন্থের ভাষা আর জাতিগত সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশের ভাষা ভিন্ন। পাকিস্তানের রাষ্ট্র শাসকরা এই দুই ধারাকে এক করে দিতে চেয়েছিল। পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান তা হতে দেয়নি। তারা দুই ধারাকেই রক্ষা করে তার মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়াস পেয়েছে। ফলে ঈদ বা বাংলা নববর্ষ বা একুশে ফেব্রুয়ারি এর কোনো উৎসবই তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা, উদ্বেগ-আততি (tension) সব কিছুই এর সঙ্গে মিশে আছে। এটা এই বাংলার বাঙালির এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্জন। আসলে বাংলাদেশের বাঙালি তার আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে বিন্যস্ত করছে এক নতুন ও বড় আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এটা করতে গিয়ে জটিল ও কষ্টকর এক প্রক্রিয়াকে তারা অতিক্রম করছে কখনো সময়ের সাহসী সন্তান হিসেবে, কখনো কিছু দ্বিধা ও সংকটে, কিছু বিভ্রান্তিতে থমকে দাঁড়িয়ে, কখনো অস্পষ্টতায় পথ হাতড়ে। তবে লক্ষ্যটা বোধ হয় ঠিকই আছে।
বাঙালি মুসলমানের কোনো জাতীয় উৎসবই ছিল না। পশ্চিম বাংলার বাঙালি মুসলমান তাদের জন্য কোনো জাতীয় উৎসব নির্মাণ করে নিতে পেরেছে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালি বিগত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশাল ও কষ্টকর কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গেছে। বাঙালি হিন্দুর শারদীয় দুর্গোৎসবের মতো ঈদ উৎসবকে তারা বিশাল জাতীয় উৎসবে পরিণত করেছে। তার মধ্যে এনেছে সাংস্কৃতিক মাত্রিকতা এবং তাতে যোগ করেছে নতুন নতুন ইহজাগতিক উপাদান। ঈদ উৎসব তাই যতটা ধর্মীয়, তার চেয়ে বোধ হয় বেশি পরিমাণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক উপাদানে পূর্ণ। ঈদ ফ্যাশন ও ডিজাইন শো, পত্রপত্রিকার ঈদ সংখ্যা, নাটক ও বিচিত্রানুষ্ঠানের মঞ্চায়ন, টেলিভিশনে সপ্তাহব্যাপী ঈদের বিচিত্র অনুষ্ঠানমালা ঈদ অনুষ্ঠানকে অন্য ধর্মের মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য করে সর্বজনীন ও লোকপ্রিয় করে তুলেছে। নিছকই ধর্মীয় এক উৎসবকে একই সঙ্গে জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত করা হয়েছে। বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার প্রাগ্রসর কারণেই হিন্দু বাঙালির দুর্গোৎসব আর মুসলমান বাঙালির ঈদ উৎসব একই সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক উৎসবও বটে।
বাংলাদেশের বাঙালি একুশে ফেব্রুয়ারির জাতীয় শোক দিবসকেও যথাযোগ্য মাত্রা ও তাৎপর্যে তাদের নবজাগৃতির স্মারক উৎসবে পরিণত করেছে। এর মধ্য দিয়ে তার বাঙালিত্বের চেতনা যেমন তীক্ষ্নতা পায় তেমনি এই উৎসবের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইহজাগতিকতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে সাফল্য-ব্যর্থতারও যেন একটা পরিমাপ করা হয় বইমেলা ও তার জন্য প্রকাশিত অসংখ্য গ্রন্থের মাধ্যমে। বাংলাদেশের বাঙালির নিজেদের নির্মাণ করে নেয়ার প্রয়াস সমকালীন ইতিহাসের এক আকর্ষণীয় ঘটনা। এ বিষয়গুলো সমাজবিজ্ঞানীদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। এই বাঙালির শত-সহস্র বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিকড় স্বদেশের মাটির গভীরে প্রোথিত হলেও আর্থিক বা সামাজিক কৌলীন্য তেমন না থাকায় এই অর্জনকে চমকপ্রদই বলতে হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসকরা বাংলাদেশ, জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেও তাই বাঙালির নিজস্ব বা আত্মনির্মাণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। প্রবল প্রতাপশালী জিন্নাহর উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষার হুঙ্কার আর ছোট ডিকটেটরদের রাষ্ট্রধর্ম ও ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে’র নকশা বাংলাদেশের বাঙালি গ্রহণ করেনি। এখানেই এ বাঙালি পুরাণের চাঁদ সদাগর, সাহিত্যের হানিফ বা তোরাপ ও বাস্তবের শেখ মুজিব। উৎসবের অন্তর্নিহিত অর্থ মানুষে মানুষে মিলন, আনন্দের আয়োজনে সমবেত হওয়া, অসূয়া ও বিদ্বেষকে ঝেড়ে ফেলে মৌল মানবিক স্বার্থে সম্প্রীতি গড়ে তোলা। এতেই উৎসবের সাফল্য ও সার্থকতা।
বাংলাদেশের বাঙালির ঈদ উৎসবের নানা মাত্রিকতা ও বহুতল বিস্তারিত তাৎপর্য আছে। পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ব বা ফোকলোর পণ্ডিতরা উৎসবকে নানা প্রতীকে, সংগুপ্ত অভীপ্সায় দেখতে চেয়েছেন। এ থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে নানা তত্ত্ব ও ডিসকোর্স। ঈদ উৎসবকে ওই রকম তাত্ত্বিক ফ্রেমে ফেলে বহুমুখী আলোচনা করা যায়। ঈদ উৎসবের সঙ্গে ধর্ম ও আচার ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও তার অন্তঃসারকে কেন্দ্রে রেখেও সেন্টার (Centre) আর পেরিফেরির (Peripher) মধ্যকার বিন্যাস বিভাজন ঘটছে ঈদ উৎসবে। রাষ্ট্র ও সমাজের স্বীকৃতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইহজাগতিক ও নান্দনিক নানা ভাব, বিষয় ও ভাবনা যুক্ত হচ্ছে ঈদ উৎসবের সঙ্গে। আগে যেসব বিষয় উল্লেখ করেছি, তাছাড়া মেলা, খেলাধুলা, নৌকাবাইচ, নৃত্যগীত, নাটক এবং ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঈদ মিছিল প্রভৃতি বহুদিন ধরে অনুসৃত অনুষঙ্গের সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে স্থপতি বা চিত্রকরের ডিজাইন করা শাড়ি প্রদর্শনী বা ফ্যাশন প্যারেড। আমরা ঈদকে আনতে চেয়েছি আমাদের ব্যাপক জীবনযাত্রার কেন্দ্রে, সাংস্কৃতিক রুচির নব নব আয়োজন, নান্দনিক বোধ ও বিবেচনার প্রতিফলনকে যুক্ত করেছি ঈদ উৎসবের সঙ্গে। ফলে ঈদ আমাদের সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গির অন্যতম মাধ্যম ও বাহনও হচ্ছে। ধর্মীয় ঈদ উৎসবও নানা বৈচিত্র্যে পূর্ণ ও জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।