বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ, ১১ মে ২০২২
আহমেদ মুন্না’র কলামঃ তেল নিয়ে তেলেসমাতির শেষ কোথায়?
বাংলাদেশে প্রতিমাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা গড়ে ১৫ কোটি লিটার। অথচ গত একমাসে দেশে ঢুকেছে ৬২ কোটি ৩৮ হাজার লিটার সয়াবিন তেল। যা দেশের মাসিক মোট চাহিদার চেয়ে চারগুণেরও বেশি। অথচ বাজার থেকে রাতারাতি তেল গায়েব! কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো এতো বিপুল পরিমাণ তেল?
ভোজ্যতেল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে একের পর এক নোঙর করছে জাহাজ। চার জাহাজে চেপে চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই প্রায় ৩ কোটি ৬৩ লাখ লিটার সয়াবিন ও পাম অয়েল এসেছে। এর আগের মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৫৮ কোটি ৭৫ লাখ লিটার ভোজ্যতেল খালাস করেছেন আমদানিকারকরা। এ হিসাবে রোববার (৮ মে) পর্যন্ত দেশে ভোজ্যতেল ঢুকেছে ৬২ কোটি ৩৮ লাখ লিটার।
এবার এই পরিসংখ্যানের আরেকটু গভীরে যাই চলুন। চাহিদার চেয়ে চারগুণেরও বেশি পরিমান ভোজ্যতেল আমদানি এবং খালাস করেছেন দেশের বড় বড় ৬টি প্রতিষ্ঠান। তারা হলেন- বসুন্ধরা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস.আলম গ্রুপ, টি.কে গ্রুপ এবং বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো খালাসের পরে এতো বিপুল পরিমাণ তেল রাতারাতি হাওয়া হয়ে গেলো! বাজারে তেল নেইতো নেই!
তেলের পাইকারদের ভাষ্যমতে, এই ৬ আমদানিকারক সিন্ডিকেটই অবৈধভাবে মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। নির্দিষ্ট ডিলারদের দিয়ে সয়াবিন তেল সীমিত আকারে সরবরাহ করছেন তারা। এজন্য মিলগেটেও চাহিদামতো ভোজ্যতেল মিলছে না। এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারদের কাছ থেকেই চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না তারা। পাইকারদের বিরুদ্ধে তেল মজুত করার অভিযোগ তুলছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
গত কয়েকদিনের অভিযানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি এবং খুচরা ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ লিটার ভোজ্যতেল উদ্ধার হয়েছে এবং হচ্ছে। পাইকারি আর খুচরা ব্যাবসায়ীদের কাছেই যদি এতো বিপুল পরিমাণ তেলের অবৈধ মজুত থাকে তাহলে আমদানিকারকদের কাছে মজুতের পরিমাণ কত?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি সরকারকে বিব্রত করতে চাইনা বরং এরচেয়ে আরেকটু গভীরে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই সুযোগে দেশের ৬ আমদানিকারক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বহুদিন থেকেই তেলের দাম দিগুণ করার সুযোগ খুঁজছিলেন। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তাদের বিভিন্ন তদবির এবং লবিং করতেও বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। তবে রমজান মাসে তেলের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে ছিল সরকার।
একাধিক গোপন বৈঠকের পরে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল ঈদের পরে তাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে। তবে ব্যবসায়ীরা শর্ত জুড়ে দেন তেলের আমদানি শুল্ক কমাতে হবে। বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখার স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে তেল আমদানির ভ্যাট ১৫% থেকে কমিয়ে ৫% নির্ধারণ করা হয়। তবে এই ভ্যাট কমানোর সুফল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পেলেও পায়নি দেশের জনগণ।
তেল আমদানিতে ১০% ভ্যাট প্রত্যাহারের সুযোগে দেশের মাসিক চাহিদার চেয়ে চারগুণ বেশি তেল আমদানি করে এই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমসসহ বিভিন্ন জটিলতায় পণ্য খালাস হতে কয়েকমাস সময় লাগে। কিন্তু তেল খালাসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। বন্দরে তেলবাহী জাহাজ নোঙর করার সাথে সাথেই বিদ্যুৎগতিতে খালাস হয়েছে সব তেল। কারণ, ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই জানতেন দেশে তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা কখন আসবে এবং কত বাড়ানো হবে। এই গোপন সন্ধি রমজানের আগেই চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছিল। এরপরে যা যা ঘটেছে তার সবগুলোই ছিল সাজানো চিত্রনাট্যের অংশ মাত্র।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের গোপন সমঝোতার স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণাতেই। গত একমাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে পৌনে ৩ শতাংশ। অথচ ১০% শুল্ক প্রত্যাহারের পরেও দেশের বাজারে সেই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ববাজারের সাথে তুলনা করলে দেশীয় বাজারে এই মূল্যবৃদ্ধির হার নয়গুণেরও বেশি! বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম একলাফে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটারের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৮ টাকা।
এদিকে তেল আমদানিকারক ৬ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারের সাথেও খেলছে ডবলক্রস। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সাম্প্রতিক বক্তব্যেও সেটা স্পষ্ট হয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন-‘আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম কিন্তু তারা কথা রাখেনি।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে মূলত বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরকারের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা ১০% আমদানি শুল্ক কমিয়ে নিয়েছে। এর পাশাপাশি আমদানি করা সব তেল দেশের বিভিন্ন জায়গায় মজুত করে বাজারে তেলের হাহাকার সৃষ্টি করেছে।
এতে তাদের দ্বিমুখী উদ্দেশ্য হাসিল হয়েছে। কমিশন খেয়ে হোক আর বাধ্য হয়েই হোক, সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে ২৭ শতাংশ। এদিকে বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করার কারণে সবাই হুমড়ি খেয়ে বাড়তি দামেই তেল কেনা শুরু করেছে। পরে যদি আরও বাড়ে কিংবা তেল না পাওয়া যায়; এমন আশঙ্কা পাবলিকের মনে সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিয়ে কয়েকদিনেই হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু কালো বিড়াল আর ব্যবসায়ী দস্যু সিন্ডিকেট মিলে খেলেছেন এই ভানুমতীর খেলা। পেঁয়াজের পরে তেল নিয়ে এই তেলেসমাতি দেখিয়ে পাবলিকের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করা হলেও সরকার যেন অসহায় এবং নির্বিকার। এ যেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণ লুটের মহোৎসব! তবে তেল নিয়ে সম্প্রতি মানুষের মাঝে ব্যাপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এবং জনরোষের মুখে গত কয়েকদিন থেকে তেল মজুতদারির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে সরকার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জব্দ করা হচ্ছে মজুতকৃত বিপুল পরিমাণ তেল।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরে সয়াবিন তেলের সর্বশেষ মূল্য টন প্রতি গড়ে ১৯০০ থেকে ২০০০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের টাকার হিসাবে প্রতি লিটার তেলের বর্তমান দাম ১৫৫ থেকে ১৬৫ টাকা। বিশ্ববাজারে এই বর্তমান মূল্যের তেল এখন আমদানি করা হলেও সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে সেই তেল দেশে ঢুকতে আগামী আরও কমপক্ষে দেড় মাস সময় লাগবে। বর্তমানে দেশের বাজারে যে বিপুল পরিমাণ তেল মজুত রয়েছে সেগুলো আগের দামে লিটার প্রতি গড়ে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় কিনেছিলেন আমদানিকারকরা।
তাহলে আন্তর্জাতিক বাজার হতে ১০০ থেকে ১২০ টাকা লিটার দামে আমদানি করা সয়াবিন তেলের মূল্য দেশীয় বাজারে কেন এবং কার স্বার্থে ১৯৮ টাকা করা হলো এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? কার কাছে এর জবাব চাইবে দেশের ১৮ কোটি মানুষ? মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য নিয়ে যারা এই লুটতরাজ করছে তাদের কি কখনো বিচার হবে? দেশের জনগণকে জিম্মি করে এই অরাজকতা কি দেশদ্রোহীতার সামিল নয়? এদের বিচার কবে এবং কীভাবে হবে?
ভোগ্যপণ্য নিয়ে অরাজকতা এদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। পেঁয়াজের পরে এখন চলছে তেল নিয়ে তেলেসমাতি। তেলের পরে হয়তো আসবে অন্যকিছু। তবে এর একটা বিহিত করা জরুরি। নাহলে এই ধারা চলছে এবং চলবে। বহুকাল ধরে চলমান এই অচ্ছেদ্য চক্র ভাঙার দুটি কার্যকরী পন্থার আইডিয়া রয়েছে আমার কাছে। একটি বৈধ প্রক্রিয়ায় এবং অন্যটি অবৈধ প্রক্রিয়ায়। বৈধ পন্থাটি দীর্ঘমেয়াদি এবং কম কার্যকরী। তবে অবৈধ প্রক্রিয়াটির কার্যকারিতা শতভাগ এবং তড়িৎগতির।
প্রথমে বৈধ প্রক্রিয়াটি নিয়েই আলোচনা করি। মজুতদারিকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে গণ্য করে দেশদ্রোহীতার আইনে তাদের বিচার করতে হবে এবং এর শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। নতুন আইন প্রণয়ন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এই দেশদ্রোহীতার বিচার করতে হবে। কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এই বৈধ প্রক্রিয়া থেকে তাড়াতাড়ি ফল লাভের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তবে দ্বিতীয় অবৈধ প্রক্রিয়াটি শতভাগ ফলপ্রসূ এবং সেটা হবে রাতারাতি। ঘটনাটা হবে এরকম-‘তেলসহ ধরা পড়ার পরে অভিযুক্ত মজুতদার ব্যবসায়ীর দেওয়া তথ্যমতে গোপন জায়গায় আরও তেল উদ্ধারের জন্য তাকে নিয়ে অভিযানে নামবে র্যাব। সেখানে তেল উদ্ধারের সময় মজুতদার ব্যবসায়ীর সহযোগীরা তাকে ছাড়িয়ে নিতে র্যাবের ওপরে গুলি চালাবে। র্যাবও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুঁড়বে। উভয় পক্ষের গোলাগুলি চলার সময় পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হবে মজুতদার ব্যবসায়ী। এসময় ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল উদ্ধার হবে।’
ঠিক এরকম দু’একটা সংবাদ বাস্তবে রূপলাভ করলেই এদেশ থেকে মজুতদারি আর সিন্ডিকেট ব্যবসা চিরতরে দূর হয়ে যাবে। আর এটা আমার ধারণা নয় গ্যারান্টি। সরকার কিংবা ব্যবসায়ী সমর্থক কেউ হয়তো বলতে পারেন- সরকার এই বেআইনি পন্থায় কেন যাবে অথবা বলতে পারেন- এটাতো মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। তাহলে আমি বলবো- এই দুর্নীতি নৈরাজ্য চিরতরে বন্ধ করতে আপনার কাছে কি এরচেয়ে বেটার কোনো অপশন আছে? পরিশেষে জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের একটি স্লোগান দিয়েই আমার এই দীর্ঘ লেখাটা শেষ করতে চাই- “দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে দাগই ভালো।” #
লেখাঃ আরিফ আহমেদ মুন্না
সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও মানবাধিকারকর্মী।
বাবুগঞ্জ, ১১ মে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।