ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা সময়েও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জেলেরা
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: পদ্মা-মেঘনার আশপাশের চরাঞ্চলসহ সর্বত্র ইলিশ ধরার উৎসব শুরু হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জেলেরা। জেল-জরিমানা এমনকি সরকারি নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করেই অবাধে চলছে ইলিশ নিধন। জেলেরা পাল্লা দিয়ে ইলিশ শিকার করছে দিনে ও রাতে। তবে এদের বেশিরভাগই মৌসুমী ইলিশ শিকারি বলে দাবি জেলেদের।
চাঁদপুর হরিণা ফেরিঘাট এলাকার জেলে হোসেন ও বিল্লালসহ আরও একাধিক জেলে বলেন, ‘সরকারি নিবন্ধিত জেলেরা নিয়ম মেনে নদীতে না নামলেও এক শ্রেণির মৌসুমী জেলে অবাধে ইলিশ ধরছে।
প্রতিবছরই ওইসব জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সময়ে ইলিশ ধরে অনেক টাকা কামিয়ে নেয়। কিন্তু আমরা নিয়ম মানলেও সরকারি সামান্য সহযোগিতায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই।’
শহরের বড়স্টেশন ও আনন্দ বাজার এলাকার জেলে খোরশেদ, শাহিন মোল্লা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেকে সরকারের আইন না মেনে নদীতে মাছ ধরছে। টাকাও রুজি করছে।
আর আমরা নিয়ম মেনে কষ্টে দিন কাটাইতেছি। সরকার কি আমাগো দিকে ভালভাবে নজর দিতে পারে না? ২০ কেজি চাল দিয়েতো আর আমাদের সংসারের অভাব মিটে না।’
এদিকে ইলিশের নিরাপদ বংশ বিস্তারে গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে ইলিশ প্রজনন মৌসুম। যা আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত প্রায় ৯০ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশসহ সকল ধরনের মাছ আহরণ, বিপণন, মওজুদ, ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে সরকার।
আর তা বাস্তবায়নে দিনরাত নদীতে বিচরণ করছে জেলা ট্রাস্কফোর্সের সদস্যরা। কিন্তু এরপরও বন্ধ হয়নি চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় মা ইলিশ শিকার। কতিপয় অসাধু নিবন্ধিত জেলে ও মৌসুমী জেলেরা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে পর্যাপ্ত ইলিশ প্রাপ্তিতে হুমকি বলে দাবি করেন ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ইলিশের নিরাপদ বংশ বিস্তারের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। অন্যথায় এরা তাদের গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে।
এছাড়াও এই সময়ের বেশিরভাগ ইলিশের পেটে ডিম রয়েছে। আর তা ধরে ফেললে আগামীতে ইলিশ উৎপাদন কমে যাবে। তাই নির্দ্দিষ্ট সময়ে ইলিশ না ধরার আহ্বান জানান তিনি।’
পদ্মা-মেঘনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে ইলিশ ধরছে জেলেরা। তারা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সুযোগ পেলেই দলবদ্ধ হয়ে নেমে পড়ছে নদীতে। আর অবাধে শিকার করছে ডিমওয়ালা মা ইলিশ।
যদিও জেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও মৎস্যবিভাগ ২৪ ঘণ্টাই নদীতে বিচরণ করছে। কিন্তু ওইসব জেলেরা প্রশাসনের লোকজনকে নজরে রেখে সুযোগ বুঝেই নদীতে নামছে।
আর আহরণকৃত ওইসব ইলিশ দাদনদারদের পাশাপাশি বিভিন্ন পাড়া মহল্লাসহ কৌশলে গ্রামের বিভিন্ন বন জঙ্গলে এবং হাটবাজারে গোপনে বিক্রি করছে। চাঁদপুর নৌ-পুলিশের এসপি মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের নৌপুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে।
প্রতিদিনই আমরা জেলেসহ জাল ও ইলিশ জব্দ করছি। এরপরও ওইসব জেলেদের আমরা আটকাতে পারছি না। তবে আমাদের সদস্যরা আন্তরিকভাবেই কাজ করছে।’
তবে নিবন্ধিত জেলেরা নদীতে নামছে না দাবি করে চাঁদপুর কান্ট্রি ফিশিং বোর্ড মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মালিক বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমাদের নিবন্ধিত জেলেরা নদীতে নামে না।
প্রতিবছরই এই সময়ে মৌসুমী জেলে, মৌসুমী আড়ৎদার ও পাইকার গড়ে ওঠে। এরা সারা বছর অন্য পেশায় থেকে নিষেধাজ্ঞার সময়ে বেশি লাভের আশায় নদীতে নামে।
বর্তমানে ওইসব মৌসুমী জেলেরা প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিতে স্পিডবোট দিয়েও মাছ ধরে। তাছাড়া এই বিশাল নদীতে প্রশাসনের দু-একটা টিম দিয়ে কোনো সফলতা আসবে না।’
অপরদিকে, চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন গত ১২ দিনে ৬০৮ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে।
এছাড়াও ১৬ কোটি মিটার কারেন্ট জাল ও সাড়ে ৩ টন ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত ইলিশ বিভিন্ন এতিমখানা ও মাদ্রাসায় বিতরণ করা হয়। আর অবৈধ কারেন্ট জাল প্রশাসনের উপস্থিতিতে পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ার আগ থেকেই জেলেদের সরকারি নিয়ম মানতে উদ্বুদ্ধ করেছি।
পাশাপাশি তাদের ইতোমধ্যে ভিজিএফ’র চালও দেওয়া হয়েছে। এরপরও অনেকে নদীতে নামছে। তবে এদের বেশিরভাগই মৌসুমি জেলে। এরপরও আমরা তাদের আটক করে আইনের আওতায় আনছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি। কিন্তু বিশাল এই নদী এতো কম জনবল দিয়ে আর শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই এই সম্পদ রক্ষার্থে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
দেশের খবর