ইলিশের উৎপাদন ও আহরণ বৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে হলে নদীদূষণ রোধ করে ইলিশের গতিপথ নির্বিঘ্ন করতে হবে। সেই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ইলিশের প্রজনন সময় চিহ্নিত করে ওই সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। ‘ইলিশ বাড়ছে: ধরে রাখার উপায়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় আজ শনিবার বক্তারা এসব কথা বলেন।
এনহ্যান্সড কোস্টাল ফিশারিজ (ইকোফিশ, বাংলাদেশ) প্রকল্পের সহযোগিতায় এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, এ বছর যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছে, তা বেশ উৎসাহিত হওয়ার মতো ব্যাপার। এক দশক আগে ইলিশের যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তাতে ইলিশ থাকবে কি না, তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু গত দুই-তিন বছরে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়ার এই প্রক্রিয়াটি যে করেই হোক ধরে রাখতে হবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ২০১১ সালে ইলিশ রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে জেলেরা ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ১১ দিন, তারপর ১৫ দিন এবং পরে ২২ দিন ইলিশ মাছ ধরা থেকে বিরত থাকেন। পুলিশ, র্যাব, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় নিয়মিত অভিযান চালিয়ে মা ইলিশ রক্ষা করা হয়। বর্তমানে দুই-তিন কেজি ওজনের ইলিশও পাওয়া যাচ্ছে, যা ওই বিশেষ উদ্যোগের ফল। কেননা দুই কেজি ওজন হতে একটি ইলিশের প্রায় চার বছর এবং দেড় কেজি ওজন হতে অন্তত দুই বছর বয়স হতে হয়। মা ইলিশ রক্ষা করে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে জেলেদের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টিও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে ইলিশ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। বর্তমানে উৎপাদন যে পর্যায়ে এসেছে সেটি যেমন আনন্দদায়ক, এটি ধরে রাখা ততটাই চ্যালেঞ্জিং। ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধরে রাখার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ইলিশের ওপর একটি আলাদা গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
বৈঠকে জেলেদের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পটুয়াখালীর অলিপুর মৎস্যবন্দরের আড়তদার আনসার আলী মোল্লা। তিনি বলেন, সরকার ঘোষিত সময়ে তাঁরা মাছ না ধরলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জেলেরা ইলিশ ধরা অব্যাহত রাখেন। অবরোধকালীন সরকারি সহায়তাকে অপ্রতুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রান্তিক জেলেদের অনেকেই সে সুবিধাটুকু পান না।
আনসার আলী মোল্লার এ অভিযোগের সঙ্গে একমত হন কয়েকজন আলোচকও। পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিকস রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, মৎস্যজীবীদের ৭০ শতাংশই অতি দরিদ্র। তাঁদের মাছ ধরা বন্ধের সময়ে শুধু খাদ্য-সহায়তা নয়, আর্থিক সহায়তা দেওয়াও জরুরি। তাঁরা দাদনপ্রথার যে ঋণের জালে জড়িয়ে আছেন, সেখান থেকে বের করে আনতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে ইলিশের ‘প্রিমিয়াম ভ্যালু’ যোগ করতে পারলে বাংলাদেশের জিডিপিতেও এর অবদান বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক আতিক রহমান বলেন, মৎস্যজীবীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ভবিষ্যতে ইলিশ পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। জলবায়ুর পরিবর্তনও বড় ধাক্কা হিসেবে আসতে পারে। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ইলিশ দূরে সরে যাবে বলে মত তাঁর।
ইকোফিশের টিম লিডার আবদুল ওহাব বলেন, এবার যে ইলিশ ধরা পড়েছে, তার মধ্যে ১৫ শতাংশের ওজন এক কেজির ওপরে। ৬৫ শতাংশের ওজন ২৪০ থেকে ৯০০ গ্রাম এবং ২০ শতাংশ ছোট। ইকো সিস্টেমের স্বাস্থ্য ভালোর দিকে যাচ্ছে বলেই এবার বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি মত দেন।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ইউএসএআইডির ডেপুটি ডিরেক্টর নাথান সেইজ, বাংলাদেশ ইকোফিশের প্রকল্প পরিচালক এম আই গোলদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের, ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের পুষ্টিবিদ শকুন্তলা থিলস্টেড প্রমুখ।
জাতীয় খবর