Sumon Hossain
প্রকাশিত: ০২:১৭ অপরাহ্ণ, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে খুনি-লুটেরা-জালিম রেজিমের পতন এবং ফ্যাসিস্টকুল চূড়ামণি হাসিনা দেশ ছেড়ে পড়শি ভারতে পালিয়ে যাবার পর বাংলাদেশ একটি এড়োপথ বা ক্রসরোডের সঙ্গমস্থলে এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে দু’টি পথ দু’দিকে বেঁকে গিয়েছে। একটি সড়ক গেছে এক অমিত সম্ভাবনার স্বর্ণতোরণের দিকে। আরেকটি রাস্তা গেছে সংঘাত, বিপর্যয় ও ব্যর্থতায় কন্টকাকীর্ণ এক অনিশ্চিত অন্ধকার গন্তব্যের দিকে। এখন কোন্ পথে পা বাড়াবে বাংলাদেশ?
ঠিক এরকম না হলেও এর কাছাকাছি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৫ সালে মুজিবোত্তর বাংলাদেশে। তখনও একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটেছিল রক্তক্ষয়ী এক সেনা অভ্যুত্থানে। তারপর খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমের সেনাসমর্থিত সরকার দেশে সংঘাত-সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে স্থিতিশীলতা এনে পূর্ণ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারেনি। চরম অস্থিতিশীল সেই উত্তাল সময়ে সৈনিক-জনতার মিলিত জাগৃতির মধ্য দিয়ে ৭ নবেম্বর প্রত্যুষে ঢাকার রাজপথে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের অভিষেক ঘটে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশকে সত্যিকারের আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার পর্ব।
জিয়াউর রহমান এদেশের মানুষের স্বতন্ত্র জাতীয় পরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করেন। রাজনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটান ও রাজনৈতিক দলগুলোর পুনর্জন্ম দেন। সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা চালু করেন। বিদ্রোহ-দ্বন্দ্ব-কোন্দলে বহুধাবিভক্ত সশস্ত্রবাহিনীতে কঠিন হাতে শক্ত পদক্ষেপে শৃঙ্খলা ও ঐক্য ফেরান। ভারতের পরিপূরক অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্কের কূটনীতির প্রবর্তন করেন। একই সঙ্গে পাকিস্তানিকরণের প্রক্রিয়ার রাশ টেনে ধরেন শক্ত হাতে। তিনি শ্রমঘন উৎপাদনকে উৎসাহিত করে এক কর্মমুখর বাংলাদেশ গড়ে তোলেন।
তিনি বাংলাদেশকে খাদ্যে ও বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেন। দুর্নীতি ও লুণ্ঠন বন্ধ করে জাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেন। প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করেন। বাক-ব্যক্তি-সংবাদমাধ্যম ও বিচারবিভাগের স্বাধীনতা তিনি নিশ্চিত করেন। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের এক নবযাত্রার সূচনা হয়েছিল।
বাংলাদেশে আজ আবার সেই ‘পঁচাত্তরের অবস্থা অনেকটাই ফিরে এসেছে। হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম বাংলাদেশকে আর রাষ্ট্র রাখেনি। এই রাষ্ট্রের পুলিস, প্রশাসন, বিচারালয়, ট্রেড বডি থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছু কুৎসিত দলীয়করণের মাধ্যমে হাসিনা তার ইচ্ছাপূরণের দাসে পরিণত করেছিলেন। দুর্নীতি, লুটপাট ও উৎকোচকে করেছিলেন অবাধ ও অবারিত। এই দেশকে আর কারো জন্য পরিচালনার অযোগ্য করে রেখে হাসিনা পালিয়ে গেছেন।
এই গুরুতর পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক কৃতিপুরুষ, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর অর্পিত হয়েছে দেশটাকে মহাবিপর্যয়ের গিরিখাদ থেকে উদ্ধারের এক সুকঠিন দায়িত্ব। তিনি কি খন্দকার মোশতাক ও জাস্টিস সায়েমের মতো গতানুগতিক ধারায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যর্থ হবেন, নাকি জিয়ার মতো ভিশনারি ও গতিশীল নেতৃত্ব দিয়ে নতুন এক আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের অভিযাত্রার দিশারী হবেন আগামীর ইতিহাসই কেবল তার নির্ভুল জবাব দিতে পারবে।
রাষ্ট্রের হাল ধরার সময় জিয়াউর রহমান বয়সে তরুণ ছিলেন। মুহম্মদ ইউনূস বয়সে প্রবীণ। এটুকু নেতিবাচকতা ছাড়া জিয়াউর রহমানের মতন আর সব ‘অ্যাডভান্টেজ’ই তাঁর রয়েছে। জিয়া সাকুল্যে মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর সময় পেয়েছিলেন। এ অল্পসময়েই তিনি দেশ-জাতিকে অমিত সম্ভাবনার এক নতুন অধ্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন।
রুশ বিপ্লবের মহানায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের একটা দুর্দান্ত উক্তি রয়েছে। তিনি বলেছিলেন : “There are decades where nothing happens; and there are weeks where decades happen.”
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে খুব বেশি খাটে এ কথাটা। এদেশ নিষ্ফলা অনেক দশকই পেরিয়েছে। অথচ জিয়ার আমলে সপ্তাহেই, ঘটে গেছে দশকের পরিবর্তন। তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ‘অনেক শতাব্দির মণীষীর কাজ’ করে গিয়েছেন। এটাই তাঁর নেতৃত্বের অনির্বচনীয় বৈশিষ্ট। আমার নিজের প্রতীতি হচ্ছে, মুহম্মদ ইউনূসও পারবেন। খুব বেশি সময় লাগবে না। অল্প সময়েই সব কিছু ইতিবাচক ভাবে পালটে দেয়ার মতন প্রজ্ঞা, যোগ্যতা ও আন্তরিকতা তাঁর আছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
জনাব ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারটি বিশাল এক জাতীয় আলোড়নের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে। কাজেই এটি আগেকার মতো কোনো গতানুগতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। কয়েকমাসে কতকগুলো রুটিন কাজের মধ্য দিয়ে একটা ভোটের আয়োজন সাঙ্গ করেই দ্রুত পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলার বাধ্যবাধকতা তাদের ওপর আরোপ করা তাই উচিত হবে না।
বাংলাদেশে কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি রেখে হাসিনা পালাননি। স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতার পালাবদলও হয়নি। এ অবস্থায় এক্ষুনি একটি ভোট করে রাজনৈতিক দল-জোটের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ আছে বলে আমার মনে হয় না।
সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ আজ আর কোনো রাষ্ট্র নয়। হাসিনার পরিত্যক্ত বিশৃঙ্খল জমিদারি বাংলাদেশকে আবার আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তার প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলো ফের করতে হবে পুনর্গঠিত। দেড় দশক ব্যাপ্ত অন্যায়, অনাচার, হত্যাযজ্ঞ, জুলুম, তাণ্ডব, লুন্ঠনের বিচারের মাধ্যমে একটা ইনসাফ ও সমতার পরিবেশ স্থাপন করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য এই দেশকে পরিচালনার যোগ্য অবস্থায় রেখে যায়নি ওরা।
এ অবস্থায় দ্রুত একটা নির্বাচন দিলে পতিত ফ্যাসিবাদ আবার রাজনৈতিক বৈধ প্রতিযোগিতায় ফিরে আসবে। শুধু তাই নয়, লুন্ঠিত সম্পদ, অবৈধ অস্ত্র, দোসরদের সহযোগিতা ও সীমান্তের বাইরের প্রভুদের মদতে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অপপ্রচারের প্রবাহে ওরা রাজনৈতিক সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ফেলবে। তাই রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংস্কার এবং উপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিষধর ফণিনীকে আগে দ্রুত নির্বিষ করা দরকার।
আবারো সেই ‘পঁচাত্তরের কথাই একটু বলি। ৭ নবেম্বরের বিদায়ী ভাষণে খন্দকার মোশতাক ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। পরদিন রাষ্ট্রপতির ভাষণে জাস্টিস সায়েম ওই ঘোষণার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। রাজনীতি ও দলহীন ঐ সময়ে এভাবে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ জননায়ক মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি বলেছিলেন আওয়ামী-বাকশালী নিবর্তনে সব রাজনৈতিক শক্তি বিধ্বস্ত। পতিত বাকশালীদের হাতে অঢেল সম্পদ ও অবৈধ অস্ত্র আছে। ওদের আছে সব সেক্টরে বিপুল সংখ্যক সুবিধাভোগী ও দোসর। পক্ষান্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তি অসংগঠিত। এ অবস্থায় নির্বাচন কেবল ওদেরকে হারানো স্বর্গ ফিরে পেতেই সাহায্য করবে।
মওলানা তাঁর দূরদর্শী মন্তব্যে নির্বাচন ঘোষণার আগে কতকগুলো পদক্ষেপ গ্রহনের সুপারিশ করেছিলেন। তাঁর পরামর্শে জিয়াউর রহমান নির্বাচনের ঘোষিত তারিখ বাতিল করে দিয়েছিলেন। তিনি অনেকগুলো পদক্ষেপের পর রাজনৈতিক দলসমূহের পুনরুজ্জীবন ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন।
তবে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ফসল বর্তমান সরকার জনসমর্থিত হলেও নির্বাচিত নয়। জনগণও তাদের ভোটাধিকার থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। কাজেই নির্বাচন খুব বেশি বিলম্বিত করাও ঠিক হবেনা। এতে ‘অ্যাসপির্যান্ট’ রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও ধৈর্যহারা হয়ে পড়তে পারে। স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টির অপচেষ্টাও চলবে।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন না হলে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আরো প্রায় সাড়ে চার বছর পর অনুষ্ঠিত হতো।
কাজেই অনেকে বিরূপ হতে পারেন জেনেও একজন নাগরিক হিসেবে আমার মতামত হচ্ছে, বর্তমান সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচনের আয়োজন করতে দুই-আড়াই বছর সময় অনায়াসেই দেয়া যায়। এ নিয়ে যাতে কোনো দ্বন্দ্ব দেখা না দেয় তার জন্য আমার মনে হয়, নির্বাচনের স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সরকার একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারে। এ ব্যাপারে একটা ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারলেই অনেক ল্যাঠা চুকে যাবে।
সময়টা কেবল সরকার নয়, রাজনৈতিক দলগুলোরও দরকার। তারাও জানেন ও বুঝেন যে, পুরনো ধাঁচের গতানুগতিক রাজনীতি ও সংগঠন দিয়ে আর চলবে না। দলগুলোকে জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর হতে হবে। মেধাকে অগ্রাধিকার দিয়ে মেদবহুল সংগঠনকে স্মার্ট করতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সাংগঠনিক নেতৃত্ব ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার ধারার অবসান ঘটিয়ে দলের সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়ন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হতে হবে। এসব হুট করে কালকেই হয়ে যাবে না। এরজন্য কিছুটা সময় লাগবেই। রাষ্ট্র চালাবে রাজনৈতিক দল। কাজেই রাজনীতি ও দলের সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্কারই টিকবে না।
বাংলাদেশের মানুষের হৃদস্পন্দন অনুভব করার সামান্য সামর্থ এবং রাজনীতির গতিধারা পর্যবেক্ষণের যেটুকু সাধ্য আমার আছে তা থেকে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক পন্থায় সহসাই ধর্তব্য জনসমর্থন ফিরে পাবার কোনো সুযোগ নেই। তবে বিপুল অর্থ, বেআইনি অস্ত্র ও সীমান্তপারের মদত তাদের আছে, হয়তো থাকবেও। ওদের দোসর ও সুবিধাভোগীরা সবখানে ছড়িয়ে আছে। অন্তর্ঘাত, নাশকতা, বিশৃঙ্খলা ও অপপ্রচার চালাবার ক্ষমতা ওদের অপরিসীম। এসবের প্রয়োগে ধারাবাহিক অঘটন ও অস্থিরতা সৃষ্টি ওরা করতেই থাকবে। স্থিতি, নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার প্রধান চ্যালেঞ্জ ওই দিক থেকেই আসতে থাকবে। এই ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দায়িত্বে সশস্ত্রবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার কোনো বিকল্প এখন আছে বলে আমার মনে হয়না।
হাসিনা রেজিম রাষ্ট্রীয় সব প্রথা-প্রতিষ্ঠানকে ফ্যাসিবাদের বিষে বিষাক্ত করে ফেলেছে। সশস্ত্রবাহিনীতেও দলায়ন, লোভ-টোপ, সুবিধা বিতরণ ও পদোন্নতির বিনিময়ে অনেক ‘ল্যাস্পেন্সার’ বানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন করলেও সমগ্র বাহিনীর ঐতিহ্যকে পুরো কলুষিত ও ঐক্য সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে পারেনি। আর তাই চূড়ান্ত বিচারে এ বাহিনী জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তাদের মতামতভিত্তিক বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের কারণেই সেনানেতৃত্ব দিনশেষে হত্যাযজ্ঞকারী ফ্যাসিবাদী শাসনের উদ্দেশে বিদায়বার্তা উচ্চারণ করেছে। প্রাক্তন সৈনিক ও সেনা অধিনায়কেরাও আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছেন। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের বিজয় সব মিলিয়ে ত্বরান্বিত হয়েছে।
বিজয়ের পর প্রথম দিকে সশস্ত্রবাহিনী অগ্রণী ভূমিকায় থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর তাদের ভূমিকা অনেকটা ভলান্টিয়ারের মতো মনে হচ্ছে। কেন এবং কোন পক্ষের সিদ্ধান্তে এমনটা হয়েছে আমার জানা নেই। তবে আমি মনে করি ধারাবাহিক আঘাতের আশঙ্কা মোকাবিলা করে স্থিতি ও নিরাপত্তাকে দ্রুত নির্বিঘ্ন করতে হলে সশস্ত্রবাহিনীকে অনতিবিলম্বে এক্সিকিউটিভ ভূমিকায় সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। এটা কোনো স্বাভাবিক অবস্থা নয়।
প্রশাসন ও পুলিশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সবাই জানে। তাদেরকে পুরোমাত্রায় কার্যকর, সচল ও সক্রিয় করতে সময় লাগবে। এই ক্রান্তিকালে গা এলিয়ে বসে থাকার অবকাশ নেই। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সশস্ত্রবাহিনীর বর্তমান নেতৃত্ব ও প্রাক্তণ যোগ্য কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে আমাদের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। এভাবে জাতীয় ঐক্য গঠন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সমাজশক্তিকে সম্পৃক্ত ও সক্রিয় করেই সংকটের নিরসন করতে হবে।
আন্দোলনী ছাত্রনেতাদের প্রতিনিধিরা সরকারে আছেন। প্রয়োজনে অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র, সরকার ও প্রশাসনের কাজে দ্বৈত কর্তৃত্ব ও খবরদারির দ্রুত অবসান ঘটাতে হবে। ছাত্রদেরকে শিক্ষাঙ্গনে ফেরত পাঠাতে হবে। তবে বাইরে থেকে তাদের সংগঠনের ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখতে হবে।
নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার পর দ্রব্যমূল্য কমানো ও বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসনের ওপর সরকারকে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফেরাতে ইতোমধ্যে ভালো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। টাকা এ সরকারের জন্য বড় কোনো সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয় না। সংস্কার কাজের সূচনাও তারা ইতোমধ্যে করেছেন। শিক্ষা ও মিডিয়া সংস্কার কমিশনও তারা গড়বেন বলেই আশা করি। স্বাস্থ্যখাতের প্রশাসন ভালো চলছেনা। আর নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি ও সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। আরো সতর্কতা ও বেটার পারফরম্যান্স প্রত্যাশিত।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ইসলামবিদ্বেষ ও নির্যাতন এবং ভারতে হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে ইসলামিক সেন্টিমেন্ট জোরালো হয়েছে।
ইসলামধর্ম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক বলয়ের ওভারঅল জনসমর্থন সম্প্রতি বেড়েছে বলেই আমার ধারণা। এরা জোটবদ্ধ হতে পারলে নির্বাচনী ফলাফলে এদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তবে ক্রমবর্ধমান এই সেন্টিমেন্ট যদি উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় নেয় তাহলে তা’ দেশজাতির কপালে দুর্ভোগ টেনে আনবে। অতিকায় পড়শি দেশের জন্যও তা কোনো শুভ সংবাদ বয়ে আনবে না। এ আশংকা এড়াতে ভারতের করণীয় হবে পতিত ফ্যাসিবাদের ভস্মস্তুপ পাহারা না দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা। সেই প্র্যাগমাটিজম তাদের নেতৃত্ব প্রদর্শন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়ে গেছে। তাই আমাদের সমস্যা আমাদেরকেই নিরসন করতে হবে।
সময় ও পরিস্থিতির এড়োপথে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে, পতিত ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় উগ্রপন্থাকে পাশ কাটিয়ে বিএনপিই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গন্তব্য। বর্তমান অন্তর্বর্তীকাল অবসানে বাংলাদেশকে তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। নিতে হবে দেশ চালনার দায়িত্বভার। উদার, আধুনিক, গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী শক্তি ছাড়া বাংলাদেশকে আর কারো পক্ষে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে তার আগে দলে যে ঘাটতিগুলো রয়ে গেছে সেগুলো পূরণ করতে হবে। কায়েমি ও গতানুগতিক রাজনীতির অর্গল ভেঙে জিয়াউর রহমান প্রমত্ত যৌবন, উদ্দাম প্রাণশক্তি, গতিশীলতা ও আধুনিকতার জোয়ার এনে সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। আধুনিকতা ও নিরাপোষ সাহসী ভূমিকার সমন্বয়ে ‘চয়েস অব নিউ জেনারেশন’ হয়ে ‘নব্বুইয়ে খালেদা জিয়ার উত্থান ঘটেছিল।
এখনকার নেতা তারেক রহমানকেও উদারতা, গণসম্পৃক্ততা, আধুনিকতা ও কোয়ালিটি দিয়েই তার নেতৃত্বকে সর্বোচ্চ শিখরে স্থাপন করতে হবে। দেশ চায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন রচনায় ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে মৈত্রী। বিএনপির নেতৃত্বে আগামী দিনের নির্বাচিত জাতীয় সরকারে উপযুক্ত অবস্থানে ড. ইউনূসকে অ্যাকোমোডেট করে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সার্ভিস দেশের কাজে লাগাতে তারেক রহমান পিছপা হবেন না বলেই আমি আশা করি।
তারেক রহমান সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারিত একটি ব্যঙ্গচিত্র সম্পর্কে উদার ও সহিষ্ণু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রসংশিত হয়েছেন। আমরা চাই এ সহিষ্ণুতা ও উদারতা যেন প্রদর্শিত স্মার্টনেস না হয়ে তারেক রহমানের সহজাত ও অন্তর্গত প্রবণতা হয়ে উঠে।
হাসিনা রেজিমের পতনের পর দখল ও চাঁদাবাজি সহ নানা রকমের দুর্বৃত্তপনায় জড়িত বিএনপি ঘরানার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তারেক রহমান একের পর এক শক্ত পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা যেন থামতেই চাইছে না। এতে সবাই বুঝতে পাচ্ছেন যে, মুদ্রার এ পিঠেও লুকিয়ে আছে অনেক কুলাঙ্গার। এই সব ক্ষতিকর মেদ ঝরিয়ে দলকে স্মার্ট করে তোলাটা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। তারেক রহমান দেশে ফিরে যদি সব ব্ল্যাকশিপ বেছে ফেলে জিয়াউর রহমানের দেখানো পথে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বাছাই করা তারকা এবং সৎ, নির্লোভ, চরিত্রবান, ত্যাগী, দেশপ্রেমিক, দরদী ও জনঘনিষ্ঠ মানুষদের নিয়ে তাঁর দল সুসজ্জিত করেন আর দক্ষতা ও যোগ্যতাকেই তিনি সবক্ষেত্রে মূল্যায়নের মাপকাঠি করেন তাহলে রাজনীতির অঙ্গনে তিনিই হয়ে উঠবেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।
তবে সমালোচনাকে স্বাগতঃ জানাবার যে সহিষ্ণু মনোভাব তারেক রহমান ব্যক্ত করেছেন তার আলোকে একটু অনুযোগ তো করাই যায়। আজকের দিনে মিডিয়া হয়ে উঠেছে রাজনীতির প্রধান বাহন। বিএনপির প্রতি মিডিয়ার বৈরিতা সর্বজনবিদিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মিডিয়াকে গুরুত্ব দেয়া বিএনপির জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মিডিয়াকে যতদূর সম্ভব ফ্রেন্ডলি করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ বিএনপির মধ্যে দেখা গেল না। চরম বৈরি মিডিয়া হাউজগুলোতে দু’চার জন বিএনপি সমর্থকের ঢুকে পড়া খুব একটা সুফল দেবে বলে মনে হয়না।
এই সময়ে বিএনপির মুখপত্র দৈনিক দিনকালও পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। যে পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে তারেক রহমানের নাম ছাপা হচ্ছে সে পত্রিকা এমন ময়লা, গরীব, আনইম্প্রেসিভ ভাবে কেন বেরুবে? এতে তারেক রহমানের ভাবমূর্তি কি উজ্জ্বল হয়? আর এ পত্রিকা কী পার্পাস সার্ভ করবে?
এখন বিএনপির জন্য মানি ইজ নো প্রোব্লেম। কিন্তু এখনো চিন্তা ও পরিকল্পনার দৈন্য প্রকট। দিনকাল একটি স্মার্ট, ভাইব্রেন্ট ও পাঠকপ্রিয় পত্রিকা হিসেবে বেরুনো উচিত ছিল। সেই সঙ্গে একটি ইংরেজি দৈনিক এবং বিষয়ভিত্তিক কয়েকটি সাপ্তাহিক ওই হাউজ থেকে বেরুতে পারে। প্রিন্ট ও অনলাইন উভয় ক্ষেত্রে এই পত্রিকাগুলো হবে জাতীয়তাবাদীদের লড়াইয়ের শাণিত হাতিয়ার। ওই মিডিয়া হাউসের রেডিও, টেলিভিশন চ্যানেল ও রিসার্চ অর্গানও থাকা উচিত। জাতীয়তাবাদীদের তেমন প্রকাশনা হাউসই সাক্ষ্য দিবে রাষ্ট্র পরিচালনায় এই দল কতোটা দক্ষ ও স্মার্ট হবে। অনিবার্য কারণে তারেক রহমানকে এখনো প্রবাসে থাকতে হচ্ছে। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর পক্ষে বাংলাদেশে কর্মরত টিমের এ হতদরিদ্র পারফরম্যান্সকে হতাশাব্যঞ্জক ছাড়া আর কিছু বলতে পারছিনা বলে দুঃখিত।
মি. জিয়াউর রহমান জুনিয়র, বাংলাদেশকে আপনি যেমন অনেক বড় ক্যানভাসে দেখতে চান ঠিক তেমনই অন্য সবকিছুকেই অনেকে বড় ক্যানভাসে দেখতে হবে। আপনার কোনো কিছুরই ‘ফকিরা হালত’ থাকা চলবেনা। সব হতে হবে উজ্জল, স্মার্ট, ভাইব্রেন্ট। আপনি আসুন, আপনাকে একুশ শতকের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে। সম্ভাবনা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এই দেশে বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, সেনা অধিনায়ক, শিল্পপতি, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মানুষেরা আছেন। তাদেরকে আপনার নেতৃত্ব দিতে হবে। আপনি হৃদয়কে দিগন্ত সমান প্রসারিত করে আসুন। দক্ষ-যোগ্য টিম তৈরি করুন।
বাংলাদেশের বাহুবল, অর্থবল না থাকুক মেধায়, মননশীলতায়, জ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, যোগ্যতায় ও দক্ষতায় আপনার টিম যেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে।
উপসংহারে বলি, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আপনি নিজেই বলেছেন, আপনার ব্যর্থ হবার কোনো উপায় নেই। আপনি অন্ধকারের নয়, আলোর দূত। যেন তেন একটা ইলেকশন করে দেয়ার জন্য আপনি আসেননি। এই ভাগ্যহত মানুষের দেশটাকে আপনি সঠিক ট্র্যাকে তুলে দিয়ে যাবেন। বিদায়ের আগে আপনি উপযুক্ত ও সঠিক হাতে তুলে দিয়ে যাবেন নেতৃত্বের ভার। এক সময়ে সংকট মোচনের জন্য জিয়া নামের ক্ষণজন্মা এক পুরুষ এসেছিলেন এদেশে। আজ আপনি এসেছেন। আমরা চাই এ সংকট মোচনেও আপনি একুশ শতকের জিয়া হবেন এবং তারপর হবেন ইতিহাস!