বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬
পিরোজপুর-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল। তাঁর স্ত্রী লায়লা ইরাদ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। মেজো ভাই মজিবুর রহমান খালেক পিরোজপুর পৌরসভার মেয়র। আরেক ভাই হাবিবুর রহমান মালেক উপজেলার চেয়ারম্যান। ছোট ভাই মশিউর রহমান মহারাজ একাধারে জেলা বাস মালিক সমিতির চেয়ারম্যান ও পিরোজপুর বণিক সমিতির সভাপতি। এক কথায় পিরোজপুরে আওয়ামী লীগ মূলত সংসদ সদস্য আউয়াল পরিবারের কবজায়। তাদের কথাতেই ওঠে-বসে পিরোজপুরবাসী। বছরের পর বছর এভাবেই ‘রাজত্ব’ করছে আউয়াল পরিবার। কিন্তু সেই রাজত্বে ভাঙন ধরেছে। তিন ভাই মিলে আউয়ালের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
দীর্ঘদিন বড় ভাই এমপি আউয়ালসহ তাঁর ছোট তিন ভাই জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। কিন্তু ক্রমেই তাঁদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর এর জের ধরেই ‘প্রতাপশালী’ এমপি আউয়ালের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন অপর তিন ভাই। একক আধিপত্য আর বেপরোয়া দখলদারিতে একচেটিয়া নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন সংসদ সদস্য আউয়াল, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে। সব দখল উৎসব আর আধিপত্যে হাত দেওয়ার সুযোগ নেই অন্য ভাইদেরও। পৈতৃক সম্পত্তির ভাগও দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন অপর ভাইয়েরা। তাঁরা বলছেন, ভাইয়ের সংসারের সদস্যদের কাছে তাঁরা নিজেরাও কোণঠাসা হয়ে আছেন।
তার দুর্নীতি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ তুলেছেন তাঁরই দুই ভাই। তারা অভিযোগ করেন ভাই শুধু ভাবীকে (আউয়ালের স্ত্রী) নিয়েই ব্যস্ত। সবকিছু তার নামেই হচ্ছে আর কর্মীরা না খেয়ে মরছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে নাজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এমপি আউয়ালের দুই ভাই পিরোজপুর পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান এসব অভিযোগ করেন।
রাতে যোগাযোগ করা হলে অভিযোগ অস্বীকার করে সাংসদ আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে তাঁদের (দুই সহোদর) প্রমাণ করে দেখাতে বলেন।’ দলীয় নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়নের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁর মতো কর্মীবান্ধব নেতাই হয় না।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেনের সভাপতিত্বে নাজিরপুর উপজেলা সদরে দলীয় কার্যালয়ে এ সভা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বড় ভাইয়ের (সাংসদ) স্ত্রী-সন্তানদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দলীয় নেতা-কর্মীরা অতিষ্ঠ। এরপরও আমরা তিন ভাই এ জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হাকিম হাওলাদার। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অমূল্য রঞ্জন হালদার প্রমুখ। বক্তারা সাংসদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন করে নিয়োগ ও টেন্ডার-বাণিজ্যের অভিযোগ করেন।
এ প্রসঙ্গে সাংসদের অপর ভাই জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান বলেন, ‘সাংসদের বিরুদ্ধে আপনাদের করা অভিযোগ শুনেছি। আপনারা সাংসদের কাছ থেকে যথাযথ মূল্যায়ন পাননি। এ কারণেই আমরা তিন ভাই আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছি।’
সভায় অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে হাবিবুর রহমান বলেন, পুলিশে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী এবং স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে সাংসদ অনেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। পরে অনেককে চাকরি দেননি। টাকাও ফেরত দেননি। এ ছাড়া টেন্ডারবাজি করেন।
সাংসদ আউয়ালের আরেক ভাই হলেন জেলা বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান। বেকুটিয়া ফেরিঘাট ও বলেশ্বর সেতুর টোল আদায়ের ইজারা নেওয়া নিয়ে কয়েক মাস আগে তাঁদের সঙ্গে সাংসদের বিরোধ দেখা দেয়। ফেরি ও সেতুর টোল আদায়ের ইজারা পেয়েছে সাংসদের স্ত্রীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
যেভাবে বিরোধের সূত্রপাত :
পিরোজপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন বেকুটিয়া, টগরা ফেরিঘাট এবং বলেশ্বর ব্রিজের টোল আদায় করে থাকে এমপি আউয়ালের মেজো ভাই পৌর মেয়র মজিবুর রহমান খালেকের প্রতিষ্ঠান। আগামী অর্থবছরের ইজারার জন্য আবারও টেন্ডার জমা দিয়েছেন তিনি। শুরুতে এ নিয়ে কোনো জটিলতা না হলেও হঠাৎ করে গুঞ্জন ওঠে এমপির পরিবার দরপত্র জমা দিয়েছে। তা-ও আবার দরপত্র দাখিলের নির্ধারিত সময়ের তিন-চার দিন পর।
এ ব্যাপারে মেয়র খালেক বলেন, ‘পরিবারে আমিই প্রথম জনপ্রতিনিধি (পৌরসভার চেয়ারম্যান) নির্বাচিত হয়েছি। উনি (আউয়াল) পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আমরা ভাইয়েরা প্রত্যেকেই যার যার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। কেউ কারো ওপর নির্ভরশীল নয়। অথচ বর্তমানে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে আউয়াল সাহেব যেভাবে চাইবেন আর বলবেন, সেভাবেই চলতে হবে আমাদের। তিনি বড় ভাই—এই হিসেবে সেটা মানা গেলেও ওনার স্ত্রী ও সন্তানদের আচরণ মেনে নেওয়া সম্ভব না। অবস্থা এমন যে উনি রাজা, ওনার স্ত্রী মহারানি, ছেলেরা রাজপুত্র আর আমরা সবাই তাদের প্রজা।’ দুর্নীতির ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, এমপি হওয়ার আগে তাঁর আর্থিক অবস্থা কী ছিল আর এখন কী হয়েছে, তা কারো অজানা নয়। শুধু দুর্নীতি নয়, তাঁর একক আধিপত্য আর দখলদারির মনোভাব এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে কেবল দলই নয়, পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত অবজ্ঞা করতে শুরু করেছেন তিনি।
চলছে সংঘর্ষ আর মামলা :
ভাইদের এই বিরোধে পিরোজপুরের আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তারাও বহুধাবিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ, এমনকি সংঘর্ষেও জড়িয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রেস ক্লাব এলাকায় আকস্মিক হামলার শিকার হন পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রসংসদের জিএস সাব্বির আহম্মেদ। তাঁর দুটি পা ভেঙে দেয় হামলাকারীরা। এর ঘণ্টাখানেক পর নতুন পৌর ভবনের সামনে হামলা চালিয়ে মারধরের পাশাপাশি পা ভেঙে দেওয়া হয় পিরোজপুর সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রাসেলের। হামলার শিকার এ দুজনই এমপি আউয়ালের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি মেয়র আবদুল খালেককে প্রকাশ্যে গালাগাল করেন এমপির বড় ছেলে আবদুর রহমান। ওই ঘটনার পর থেকেই মেয়রের বাসার সামনে সব সময়ই তাঁর অনুসারী অন্তত ২০-৩০ জন অবস্থান নিয়ে আছে। এমপি বহর নিয়ে শহরে মহড়া দিলেও মেয়র সব সময়ই একা চলাফেরা করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরের আনাচকানাচে অন্তত সহস্রাধিক অনুসারী রয়েছে মেয়রের। সার্বক্ষণিক মেয়রকে তারা আগলে রাখে। বিষয়টি এমপি নিজেও জানেন। ভাইদের মধ্যে এমন শক্তির মহড়া চোখে পড়ার মতো।
বিরোধের খবর অজানা নয় :
পিরোজপুর শহরের ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন সংসদ সদস্যের দুই ভাই মজিবুর রহমান খালেক ও মশিউর রহমান মহারাজ। এত দিন তাঁরাই এমপিকে ঢাকা থেকে পিরোজপুরে আসার সময় সম্ভাষণ জানিয়ে বরণ করতেন। কিন্তু ৯ মে ঢাকা থেকে পিরোজপুর আসার সময় হুলারহাট লঞ্চঘাটে অনুসারী নেতাকর্মীদের হাজির করিয়ে শোডাউনের মাধ্যমে শহরে ঢোকেন এমপি আউয়াল। শহরের চালকরা না আসায় পার্শ্ববর্তী স্বরূপকাঠি, ভাণ্ডারিয়া আর কাউখালী থেকে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি জানাজানির পর আউয়াল পরিবারের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি এখন তৃণমূল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের অজানা নয়। পরদিন জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এক সভায় ভাইদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার ফল ভালো হবে না। আমার নেতাকর্মীদের ওপর একটা আঁচড়ও যদি পড়ে, তাহলে পিরোজপুর ছাড়া করা হবে। এখানে আমি যা বলব, সেটাই চূড়ান্ত। এর পরে আর কিছু নেই।’ এমন বক্তব্যের পর নেতাকর্মীরা বিরোধের তীব্রতার বিষয়টি টের পায়। ক্রমেই নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ভাইদের অভিযোগ :
পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা ইউনিয়নে চলমান ইকো পার্ক নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেন এমপির দুই ভাই। এ সময় সেখানে নির্মাণাধীন একটি দেয়াল ভেঙে ফেলেন তাঁরা। এ ব্যাপারে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান মালেক বলেন, আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রের সম্পত্তি দখল করে এমপি সাহেব পার্ক বানাচ্ছেন। তাই নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছি। ওই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে এমপি আউয়াল চলতি বছরের ১১ মে পিরোজপুর এলজিইডি কার্যালয়ে জেলার সব দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীদের ডেকে পাঠান। তিনি সেখানে ‘আমি বা আমার লোক ছাড়া কেউ যাতে কাজ না পায়’ সে নির্দেশনা দেন কর্মকর্তাদের। পাশাপাশি ছোট ভাই মহারাজের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাস টার্মিনাল দখলেরও হুমকি দেন এমপি।