Sumon Hossain
প্রকাশিত: ১২:০৮ অপরাহ্ণ, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: নিয়মিত অফিসে না গিয়েও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দেওয়ার অভিযোগ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) ইস্যু ক্লার্ক মোঃ বনি আমিনের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে অসদাচরণ, এমনকি যেসব দিনে তিনি (সিএল) সম্প্রতি ছুটি কাটিয়েছেন সে দিনের হাজিরা খাতায় তার স্বাক্ষর মিলছে। একাধিক সূত্র ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। এর আগে তিনি ধর্ষণের অভিযোগে ২০২০ সালে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কৃত হন।
২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি অফিসে যাননি, কিন্তু হাজিরা খাতায় রয়েছে তার স্বাক্ষর। একই সালে ১৩ ও ১৪ আগস্ট তিনি ব্যক্তিগত কারণে ছুটি কাটিয়েছেন অথচ হাজিরা খাতায় তার স্বাক্ষর দেওয়া। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বললে স্বাক্ষর মুছে সিএল লেখেন বনি আমিন।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরিশাল মহানগর যুবলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে আসা বনি আমিন নিজের ইচ্ছে ও খেয়াল-খুশিমতো অফিস করতেন। সরকারের পতনের পর ভয়ে বেশ কিছুদিন অফিসে যাননি। এখনো তিনি ঠিকমতো যান না। তবে সাংবাদিক তথ্য নিতে যাওয়ার খবরে বনি আমিন নিয়মিত অফিস করছেন ও লাইব্রেরিয়ান বরাবর আবেদন দেন। আবেদনে তিনি দুঃখ প্রকাশ ও বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অফিসে নিয়মিত আসার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
গত ২২ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও অফিসে না পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ছেন বলে লাইব্রেরিয়ান বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সিয়াম বলেন, লাইব্রেরিতে বই আনতে গেলে শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের সঙ্গে অন্যরা যেভাবে ব্যবহার করেন তিনি সেভাবে ব্যবহার করেন না। তিনি আমাদের সঙ্গে এমন এক ভাব নিয়ে কথা বলতেন যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্মচারী তো দূরের কথা কোনো কর্মকর্তা-শিক্ষক এমনকি উপাচার্য স্যারও এভাবে আচরণ করতেন না।
ইংরেজি বিভাগের আরেক মেহেদী হাসান মিরাজ বলেন, বই আনতে গেলে তিনি ব্যবহার করতেন যেন তিনি রাজা আর আমরা শিক্ষার্থীরা প্রজা। তাকে কিছু বললে বলতেন তুমি আমাকে চেন? আমার পরিচয় জানো? বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি না করলে আমার হবে কী? এভাবে তিনি অফিসে আ.লীগের পরিচয় দিয়ে হ্যাডাম (ক্ষমতা) দেখাতেন ও ছাত্রলীগের ভয় দেখাতেন। দুঃখের বিষয় এখনো তার ব্যবহারে পরিবর্তন আসেনি।
আ.লীগ করার কারণে বিগত উপাচার্যের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. ছাদেকুল আরেফিনের সঙ্গে বেশ সখ্য ছিল তার (বনি আমিন)। শহরের আওয়ামী রাজনীতি ও এই উপাচার্যের সঙ্গে সখ্য থাকায় কারোরই তোয়াক্কা করতেন না তিনি। সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেও ব্যক্তিগতভাবে তাকে একবার লাইব্রেরি ভবনের আশপাশের ঝোপঝাড় ও জঙ্গল পরিষ্কার করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। যে দায়িত্ব স্টেট অফিসার অথবা লাইব্রেরিয়ানের পাওয়ার কথা ছিল। উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে লাগানোর গাছ কেনার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল বনি আমিনকে।
জানা যায়, বনি আমিন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সিটি মেয়র সাদেক আব্দুল্লাহর অনুসারী ছিলেন। ধর্ষণের অভিযোগে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার আগে ২০২০ সাল পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের সভাপতিও ছিলেন তিনি। এ জন্য তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের সত্যতা ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সাবেক উপাচার্যদের ব্যক্তিগত কাজও করে দিতেন এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্টও ছিলেন তিনি। তাই লাইব্রেরির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
এসব বিষয় বনি আমিনের কাছে জানতে চাইলে বলেন, আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কোনো সাক্ষাৎকার দিতে পারবো না। অভিযোগের বিষয়ে ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান মধুসূদন হালদার বলেন, তিনি ৫ সেপ্টেম্বর অনুমোদিতভাবে আসেননি এবং পরবর্তীতে স্বাক্ষর করেছেন এটা আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হয়েছি। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এ ছাড়া প্রায়দিনই তিনি নিয়মিত অফিস করতেন না। ইচ্ছামতো আসতেন আর যেতেন। গত মাসেও তিনি ছুটির তারিখে স্বাক্ষর করেছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ লিখিত অভিযোগ পেয়েছি এগুলো আমি কর্তৃপক্ষকে জানাব। অফিসে না গিয়ে স্বাক্ষর করা আইনশৃঙ্খলা বিরোধী। আমরা এর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে জানাব।
তিনি জানান, তার প্রাপ্য সিএল ছুটি ২০ দিনের ২০ দিনই কাটিয়েছেন। এই বছর কোনো সিএল ছুটি পাবেন না। গুরুত্বপূর্ণ কোনো নথি দেওয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। তবে তার নামে যেসব অভিযোগের সত্যতা রয়েছে এগুলো নিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়া কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
এসব অভিযোগের আগে তার একাধিক অভিযোগে কারণ দর্শানো হয়েছে ও বিভিন্ন শাস্তির বিষয় উল্লেখ করে শাস্তি প্রদান করা হয় তাকে। বনি আমিন নিয়মিত অফিসে না আসার জন্য ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বেশ কয়েকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নিজ ভাতিজির বান্ধবীকে বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে বরিশাল নথুল্লাবাদ থেকে জোর করে মাইক্রো উঠিয়ে কুয়াকাটা নিয়ে যান এই কর্মচারী। অপহরণের পর রাতভর ধর্ষণ করার অভিযোগ দেন তার (বনি) বিরুদ্ধে। পরদিন ওই ছাত্রীকে ঝালকাঠিতে বনি আমিনের এক নিকট আত্মীয়ের বাড়ি থেকে পুলিশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় বরিশাল এয়ারপোর্ট থানায় মামলা হলে মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়।
১৩ ফেব্রুয়ারি বনি আমিনকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে মানববন্ধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বনিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেয় বরিশাল নারী শিশু নির্যাতন ও সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটি। ধর্ষণের এবং অপরাধে প্রাথমিক বলিষ্ঠ তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অননুমোদিত অফিসে না আসার কারণে তাকে ২৪ ফেব্রুয়ারিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সাবেক উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বনি আমিনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ১ বছর ৪ মাস ১৮ দিন অননুমোদিত কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে শাস্তি প্রদান করে। ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২৫ জুন ২০২৫ পর্যন্ত তিন বছরের বেতন বৃদ্ধি স্থায়ীরূপে বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে ওই এক বছর ৪ মাস ১৮দিন অনুমোদিত অনুপস্থিতকাল বিনা বেতনে ছুটি হিসেবে গণ্য করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড.মোঃ মুহসিন উদ্দীন বলেন, তার নামে এই বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। তার নামে এর আগেও কয়েকবার অভিযোগ এসেছিল এবং শাস্তিও হয়েছিল। অভিযোগের সত্যতা পেলে আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।