বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০১:৪৭ অপরাহ্ণ, ১৯ নভেম্বর ২০২৩
কীর্তনখোলা নদীতীর দখল করে গড়ে উঠছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্টরা নিবর কেন
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতীর দখলের উৎসব চলছে। শহর লাগোয়া শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (দপদপিয়া) সেতুর নিচে নদীতীর দখল করে হিরণ মাহামুদ নামক জনৈক এক ব্যক্তি গড়ে তুলছেন ভবন। এছাড়াও আশপাশ এলাকাসমূহে কীর্তনখোলা নদীতীর দখল করে একাধিক নির্মাণ স্থাপনা তৈরি হয়। সরকার সংশ্লিষ্টদের তরফ থেকে গত কয়েক বছর যাবৎ দখলকারীদের তালিকা প্রনয়ণসহ ব্যবস্থাগ্রহণ করার অভয় দেওয়া হলেও অদ্যাবধি তা লক্ষ্যণীয় নয়। ফলশ্রুতিতে দিনে দিনে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতীর দখল হয়ে নতুন নতুন অসংখ্য স্থাপনা গড়ে উঠছে। অভিযোগ আছে এই নদী দখল প্রক্রিয়ায় শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই নয়, বিএনপি-প্রতাপশালীসহ চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা জড়িত।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) জানায়, বরিশাল নগরের আমানতগঞ্জ খাল থেকে রূপাতলী দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫৭০ কিলোমিটার কীর্তনখোলার তীর তাদের আওতাধীন। নদীর তীরের দিকে ৫০ গজ পর্যন্ত উভয় তীরে ৩৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ফোরশো আছে, যার অর্ধেকই দিনে দিনে বেদখল হয়ে গেছে।
এছাড়া বছর দুয়েক আগে করা বিআইডব্লিউটিএ’র তদন্তে নদী দখলকারীদের একটি দীর্ঘ তালিকায় ৪ হাজার লোকের নাম উঠে এসেছে। তবে এখন এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, বিপরিতে শান্ত-স্নিগ্ধ-শ্রোতস্বীনি কীর্তনখোলা সংকুচিত হয়ে আসছে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিআইডব্লিউটিএ এবং বরিশাল জেলা প্রশাসন কীর্তনখোলা নদী রক্ষায় কয়েকবার উদ্যোগগ্রহণের কথা জানালেও পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে আছে। সরকার সংশ্লিষ্টদের এই নিশ্চুপ থাকায় নদীতীর দখলের উৎসব চলে, এখন নির্বাচন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ রাক্ষুসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, শুধু নদীতীরই নয়, আশপাশে থাকা জেলা প্রশাসনের ভূমিও দখল নিচ্ছে অসাধু চক্রটি।
অথচ সাবেক জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার দখলকারীদের উচ্ছেদ কীর্তনখোলার স্বাভাবিক গতিপথ ফিরিয়ে আনার একটি সংকল্প করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তিনি আর সামনে অগ্রসর হতে পারেননি। এমনকি বিআইডব্লিউটিএও রহস্যজনভাবে নিরব হয়ে যায়। ফলে বরিশালে নদী রক্ষায় সরকারের তরফ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্যণীয় নয়। তবে বরিশাল সদর আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) জাহিদ ফারুক শামীম নদীভাঙন রোধে ব্যাপক ভূমিকা রেখে প্রশংসিত হয়েছেন।
অভিযোগ আছে, ভাঙন রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীতীরে যে ব্লক দিয়েছিল, তা তুলে ফেলে দখলকারীরা। এবং সেখানে সেই ব্লক এবং সিমেন্ট দিয়ে মজবুত করে নিজেদের ভবনের কাঠামো নির্মাণ করেছে, করছে, যা প্রতীয়মাণ হয় শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতুর নিচ ঘুরলেই।
এখানে দেখা যায়, নদীর অন্তত ১০-১৫ ফুট দখল করে একটি ভবন নির্মাণ কাজ চলছে। ভাঙন রক্ষার্থে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বসানো ব্লক তুলে তা দিয়ে নদীর বড় একটি অংশজুড়ে দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্তত ৬ থেকে ৭ শ্রমিক এই নির্মাণযজ্ঞ চালাচ্ছে। তারা স্বীকার করেছেন, প্রতিষ্ঠান মালিক হিরণ তাদেরকে নদীতীরে ভবন তৈরি করার কাজ দিয়েছেন। এবং তিনিই বলেছেন, সরকারি ব্লক তুলে তা দিয়ে ভবনের নিচের পাইল করতে। শ্রমিকেরা সেই মোতাবেক কাজই করছেন। অনুরুপ অবস্থা দেখা যায় আশপাশেও।
বিভিন্ন মাধ্যম জানা গেছে, কালিজিরা টু বেলতলা পর্যন্ত কীর্তনখোলা নদীতীর দখলে এক ধরনের মহোৎসব চলছে। বিশেষ করে এই দখল প্রক্রিয়া সাংসদ নির্বাচনের আগে বেড়েছে কয়েকগুণ। বিশ্লেষকরা মনে করছে, নির্বাচনকে ঘিরে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা ব্যস্তরা থাকার সুযোগটি নিতে চাইছে ভূমিদস্যুরা। সরকারি আইনের তোয়াক্কা না করে তারা একের পর এক নদীতীরে নতুন নতুন ভবন তৈরি করছে।
তাদের মতে এমন ভাবে দখল কার্যক্রম চলতে থাকলে হয়তোবা কয়েক দশক পর কীর্তনখোলা একটি খালে পরিণত হবে। এবং এ থেকে দূষণ ছড়িয়ে পড়বে, বরিশালবাসীর জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। সুতরাং কালবিলম্ব না করে এখনই ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।
অভিন্ন তথ্য দিয়ে নদীতীরের বাসিন্দারা জানিয়েছে, কীর্তনখোলা যারা ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে তাদের অধিকাংশই প্রথমে ব্যবসার উদ্দেশে এসেছিল। ইট-পাথর-বালুর ব্যবসা করতে গিয়ে তারা যে যার সুবিধা মতো করে নদীতীর দখল করেছেন। কেউ নির্মাণ করেছে ভবন, আবার কেউ চারিদিক বাউন্ডারিতে আবদ্ধ রেখে ভেতরে ব্যবস্থাপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন। দখলকারীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ শহীদ আব্দুর বর সেরনিয়াবাত সেতুর ঢালে হিরণ যে দখল প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন তা স্থানীয়দের অবাক করেছে। কয়েকদিন ধরে চলমান নির্মাণকাজ বন্ধ করতে কোনো প্রকার উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ বা পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে দখল প্রক্রিয়ায় গতি যেনো আরও বেড়েছে।
অভিযুক্ত হিরণও নদীতীর দখলের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি দাবি করেছেন অনেকের চেয়ে কম নিজের দখলে আছে। এবং প্রাসঙ্গিক এই বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যাওয়ার আর্জি রাখেন, দেন আর্থিক সুবিধার প্রস্তাব। কিন্তু সরকারি সম্পত্তি দখলকারীর সাথে আপসরফার সুযোগ কোথায় এমন প্রশ্নে তিনি বেশি না বাড়ালেও একাধিক ব্যক্তি-বিশেষ দিয়ে ফোন করিয়ে সংবাদ প্রচার না করার অনুরোধ রাখেন।
এই বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালিদ বরিশালটাইমসকে জানান, তিনি বরিশালে সবেমাত্র কয়েকদিন হলো যোগদান করেছেন। তারপরেও চলমান নদী দখল প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করবেন। সেক্ষেত্রে তিনি ঘটনা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণের কথাও জানিয়েছেন।
অনুরুপ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ’র বরিশাল অফিস কর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিষয়টি তাদের জানা নেই, খোঁজ-খবর নিয়ে দেখবেন এবং ব্যবস্থাগ্রহণ করবেন।’