বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৮:২৭ অপরাহ্ণ, ২৯ জুন ২০১৬
আমতলী: বরগুনার তালতলতে ঈদকে সামনে রেখে রাখাইন পাড়ায় নারীদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বছরের অধিকাংশ সময় অলস কাটালেও এসময়ে রাখাইন নারীদের দম ফালাবার সময় থাকে না। একারনে পাড়ায় পাড়ায় তাঁতীদের কোলাহল আর কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি বেড়েছে মনের আনন্দ। আর চোখে মুখে দেখা গেছে হাঁসির ঝিলিক। তাঁতীদের তাঁতে বিভিন্ন ধরনের কাপড় বুননের খটখট শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে তাঁত সমৃদ্ধ রাখাইনদের এই জনপদ তালতলী রাখাইন পাড়া। বার্মা থেকে আমদানীকৃত সুতা দিয়ে শাড়ী, লুঙ্গী, চাদর, শার্ট পিচ, ব্যাগ ও গামছা বুনে তাঁতীরা তাদের হস্তচালিত তাঁত বস্ত্রের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিরলস ভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
রাখাইন তাঁতীদের উৎপাদিত এ সকল বস্ত্রেরই কদর দক্ষিনাঞ্চল সহ দেশের সর্বত্রই। রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বিভিন্ন রং বেরঙ্গের সুতা দিয়ে তৈরী লতা পাতা ফুল ও বিভিন্ন কারু কাজে গড়া এ সকল তাঁত বস্ত্র যেন সকলের প্রিয়। সারা বছর এ সকল বস্ত্রের পুরো চাহিদা না থাকলেও ঈদ, কোরবানী ও শীত মৌসুমে ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়। আর সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই তাঁতীরা তাঁত কাপড় বুনন কাজে ব্যস্ত। তাদের কর্মব্যস্ততায় সরগরম হয়ে উঠেছে তালতলীর তাঁতীদের রাখাইন পাড়া গুলো। আগাঠাকুর পাড়ার উসিট মং জানান, তালতলীর বড়বগী ইউনিয়নের তালতলী পাড়া, ছাতনপাড়া, মনুখেপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়নের সওদাগরপাড়া, তালুকদারপাড়া ও সোনারচর ইউনিয়নের কবিরাজপাড়া, তাঁতিপাড়া, লাউপাড়া ও অংকুজানপাড়ায় রাখাইন পল্লী গুলোতে ১২ থেকে ১৪টি করে প্রায় অর্ধশতাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। কোন কোন পাড়ায় একই পরিবারে ২ থেকে ৩টিও তাঁত রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে তালতলীর এ তিনটি ইউনিয়নে প্রায় অর্ধশত রাখাইন পাড়া ছিল।
এবং প্রতিটি পাড়ায়ই ব্যাঙ্গের ছাতার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য তাঁত কারখানা। সেগুলোতে বস্ত্র উৎপাদনের কাজ চলতো পুরোদমে। আর সে কালে তাঁত বস্ত্রের উপরই নির্ভর ছিল পুরো রাখাইন পরিবার। সে সময় রাখাইন পরিবারের মধ্যে এমন প্রচলন ছিল যে, রাখাইন মেয়েরা হস্তচালিত তাঁত শিল্পের কাজ না জানলে সে মেয়ের বিয়ে হত না। আজ আর সে প্রচলন নেই। তাঁত পরিচালনার কাঁচা মালের অভাব ও ছিল খুব বেশী। বার্মা থেকে আনা তাঁতের সুতোসহ সকল কাঁচা মালের খরচ মিটিয়ে যা বিক্রি হত তাঁতে অনেক সময় প্রায়ই লোকসান দিতে হত তাঁতীদের। এমনি ভাবে তাঁতীরা এ তাঁত বস্ত্র উৎপাদন করতে গিয়ে সারা বছর ঋণে জর্জরিত হয়ে যায়।
লোকসান গুনতে গুনতে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায় তাঁতীরা। কালক্রমে ঝিমিয়ে পড়ে তালতলীর রাখাইন তাঁত শিল্প। এমনি ভাবে রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প প্রায় বিলীন হওয়ার উপক্রম। অনেক রাখাইন সম্প্রদায় লোকসান দিতে দিতে তাদের জমি জমা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কারনে দেশ ত্যাগ করে বার্মা চলে যায়। আর কিছু কিছু রাখাইন পল্লীতে পিতৃপেশা হিসাবে হস্তচালিত তাঁতের কারখানা এখনও চালু রেখেছে। সেই সমস্ত নারী-পুরুষ তাঁতীরা সামনে ঈদের কারনে ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য এবং নিজেদের বাড়তি আয়ের আশায় দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে মহা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বর্তমানে তাঁতের মৌসুম না হলেও রোজার ঈদের কারনে বাড়তি আয় হবে মনে করে ঝিমিয়ে পড়া তাঁতীরা আবার সচল হয়ে উঠেছে।
অতিরিক্ত পরিশ্রমেও ক্লান্তি বোধ করছেন না তারা। মুসলমানদের ঈদের পর্বের মত রাখাইনদেরর বহু বাড়তি ব্যয় রয়েছে। আর সে ব্যয় মেটানোর আশায় রাখাইনরা নিরবে অক্লান্ত পরিশ্রম সহ্য করে যাচ্ছেন। রাখাইন সম্প্রদায়ের তাঁত কারখানায় লতা পাতা ফুল ফল ও প্রানী জগতের কারু কাজে তৈরী তাঁত বস্ত্র তালতলী শহরের অনেক দোকান পাটে পাওয়া যাচ্ছে। রাখাইনদের তাঁত বস্ত্র ক্রয় করতে দূর দুরান্ত থেকে অনেকে আসেন তালতলীতে। এগুলো সকল সম্প্রদায়রা সৌখিন হিসাবে ক্রয় করে কেহ নিজে ব্যবহার করে আবার কেউবা উপঢৌকন হিসাবে প্রিয় জনকে উপহার দেয়। উপহার দেয় উপরস্থ কাউকে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যও।