বরিশালের গৈলা গ্রামে ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি গৈলা উচ্চ ইংরেজি স্কুলটি ১২২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু তার অনেক পূর্ব থেকেই গৈলা আলোকিত গ্রাম। আরও অন্তত অর্ধশত বছর আগে এ গ্রামের কবীন্দ্র বাড়িতে (ন হন্যতে ও মংপুতে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক মৈত্রী দেবির বাড়ি) চালু হয়েছিল সংস্কৃত শিক্ষার কলেজÑ যেখানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলা থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য আসতেন।
পাশাপাশি মৌলভীদের কাছে ফারসী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাও। রবীন্দ্রনাথ তার সহজ পাঠ-এ উল্লেখ করেছেন বরিশালের গৈলা গ্রামের নাম। এই গৈলা গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন বিজয় গুপ্ত। তিনি অন্তত ৫শ’ বছর আগে মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন বাংলায়, যখন অধিকতর প্রচলিত ভাষা ছিল সংস্কৃত। জীবনানন্দ দাশের মা কুসুম কুমারী দেবী। তিনিও গৈলার বাসিন্দা।
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ কবিতার রচয়িতা তিনি। ১৮৮৫ সালে সাড়ে চার বর্গমাইল আয়তনের এই গৈলা গ্রাম থেকেই গ্রামের এক ছাত্র কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট হন। ১৮৯৩ সালে কালুপাড়া উত্তরের বাড়ির বিশে^শ^র সেন গ্রামের প্রথম এমএ। ১৮৮৫ থেকে ১৮৯২ পর্যন্ত গ্রামের ১৩ জন গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন।
গৈলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন সে সময়ে বিএ পাস শেষে সরকারি উচ্চপদে কর্মরত কৈলাসচন্দ্র সেন। তিন দশকেরও বেশি বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। পাশাপাশি তিনি পাশের গ্রামের ভেগাই হালদার ইনষ্টিটিউশনেরও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার জীবনাবসান ঘটেছে আট দশকেরও আগে। এখনও গৈলা গ্রাম এবং আশপাশের লোকেরা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে তার স্মৃতিসৌধে লেখা আছে ‘ডেথ ডিভাইডস, মেমরি লিঙ্গারস’। প্রকৃতই স্মৃৃতিতে চিরভাস্বর তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ গ্রামটিকে চিনতেন। ১৯৩১ সালে এ গ্রামের তারকেশ্বর সেন নামের এক তরুণ বিপ¬বীকে ব্রিটিশ পুলিশ হিজলী বন্দিশিবিরে গুলি করে হত্যা করেছিল। এর প্রতিবাদে কলিকাতায় যে সমাবেশ হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সেই সভায় বিখ্যাত ‘প্রশ্ন’ কবিতা পাঠ করেন, যার একটি লাইন ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।
এ গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেতে হতো ঢাকা বা কলিকাতায়। ঢাকায় যেতে ৭-৮ দিনে প্রমত্তা পদ¥া-মেঘনা নদী নৌকায় পাড়ি দিতে হতো। কলিকাতায় যেতেও তিন-চার দিন লাগত। কোনো প্রতিকূলতাই গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের প্রত্যাশা পহৃরণ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই ছাত্রছাত্রী সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। স্কুল পরিচালনার জন্য অভিভাবকদের একটি সংগঠন ছিল। তবে এর অভিনবত্ব ছিল গৈলা গ্রামের যারা এমএ-এমএসসি বা এ ধরনের ডিগ্রি অর্জন করতেন, তারা আপনাআপনি এ পরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হতেন। ১৮৯৩ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ বিদ্যালয় থেকে ১ হাজার ৫ জন ছাত্রছাত্রী এনট্রান্স বা মেট্রিকুলশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
গৈলা গ্রামটি তখন উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের পদচারণায় মুখর ছিল। ‘গৈলার কথা’ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত এ গ্রাম থেকে অন্তত ৪০ জন ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। এদের মধ্যে সাত জন নারী। এমএ-এমএসসি ও সমপর্যায়ের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন অন্তত ২২ জন।
এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন ৩৩ জন এবং গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার ৪৩ জন। ব্রিটিশ আমলেই গ্রামে মাষ্টার্স ডিগ্রিধারী নারী ছিলেন অর্ধশতের বেশি। এদের বাইরে বিএ-বিএসসি পাস করেছিলেন আরও ২৪ জন নারী। গৈলা স্কুল এখন মডেল স্কুল। অচিরেই সরকারি বিদ্যালয় হিসেবে শুরু হবে নবযাত্রা।
ছাত্রছাত্রী প্রায় দেড় হাজার। জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও কৃষক দরদি হিসেবে পরিচিত সেরালের আবদুর রব সেরনিয়াবাত টানা দুই দশক এ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কর্ণধার ছিলেন। তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি। গৈলার পাশর্^বর্তী নাঠৈ গ্রামেও বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় বাড়ি ছিল।
এই দুই এলাকার সুবাদে শৈশবে এ অঞ্চলে কিশোর শেখ মুজিবুর রহমানের যাতায়াত ছিল এবং গৈলা স্কুলও ছিল তার পদচারণায় ধন্য। বঙ্গবন্ধুর বোনের পুত্র জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত ষ্টান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ স্কুলটির উন্নতির বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী।
এ স্কুলের ব্যবস্থাপনায় তিন দশক যুক্ত ছিলেন ইউসুফ হোসেন মোল্লা। গৈলাকে মন্ত্রীদের গ্রামও বলা হয়। আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছাড়াও এ বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র সুনীল কুমার গুপ্ত, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এমএ মালেক ও সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের পিএইচডি গবেষণার সময়কালীন শিক্ষক অমিয় দাশগুপ্ত গৈলা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন।
তার সম্পর্কে অমর্ত্য সেন লিখেছেন ‘স্যার বলতেন, তার জীবনে যা কিছু অর্জন তার মূলে গৈলা স্কুলের শিক্ষা।’ এ বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা ১৯৯৩ সালে তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানের জš§শতবার্ষিকী উপলক্ষে নিজেদের অর্থে নির্মাণ করেছেন শতবর্ষ ভবন।
২০০০ সালে সাবেক ছাত্র ও সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কৃতী ছাত্রছাত্রীদের জন্য গঠন করেন পাঁচ লাখ টাকার বৃত্তি তহবিল। গত দেড় যুগে এ তহবিল থেকে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সাত লাখ টাকার বেশি বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে এবং এখনও জমা রয়েছে সাত লাখ টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিদ্যালয়ে সমাবেশ, আনন্দ মিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকাস্থ সাবেক ছাত্রছাত্রীরা ২৬ জানুয়ারি আয়োজন করেছে পারিবারিক পুর্ণমিলনীর। এ অনুষ্ঠানে অর্ধশত বছর আগ পর্যন্ত যারা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের অন্যতম প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটি গৌরব ও ঐতিহ্যের ধারায় শিক্ষার বিস্তার ও মানোন্নয়নে অবদান রেখে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।”
শিরোনামবরিশালের খবর