বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০২:৩৬ অপরাহ্ণ, ১৫ আগস্ট ২০১৬
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে ঘাতকরা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি এবং মিন্টো রোডের ২৭ নম্বরে তার ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও হামলা করে। খুনিরা ছয়জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে।নিহতরা হলেন-বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু।
এছাড়া ওই ঘটনায় আহত হন নয়জন। আহতরা হলেন- আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সহধর্মিনী আমেনা বেগম, পুত্রবধূ বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ, কন্যা বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, খ.ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ।
এ হত্যাকান্ডের স্মৃতিচারণ করে সম্প্রতি বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ফজরের সময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে উঠে ঢাকার ২৭ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়ি। আমার ছেলে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত কোলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন আমি বাবুকে কোলে নিতে পারিনি। চোখের সামনেই সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখলেও কিছুই করতে পারিনি।’ বলেই অনেকটা স্তব্ধ হয়ে যান তিনি।
তিনি বলেন, ‘‘সেদিন ফজরের আযানের সময় প্রচণ্ড গুলির শব্দে হঠাৎ আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শ্বাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বলেন, ‘বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও’। তখন আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু কি কথা হয় তা আমরা জানি না। ’’
তিনি আরও বলেন, এরইমধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে, বুঝতে পারছিনা। মনি ভাই বলেন, কারা গুলি করছে দেখো। বললাম, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। মনি ভাই বলেন, তারপরেও দেখো, কারা আসছে। এরমধ্যে ফোনটি আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন, বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও।
এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে বললেন, কি ব্যাপার তুমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিলা না? আমার শ্বশুর বলেন, তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পাননি। ওনার সঙ্গে কি কথা হয়েছে আমরা সেটা শুনিনি। এমন সময় আমাদের দরজা ভাঙার শব্দ পাচ্ছিলাম।
শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ঠিক সে মুহূর্তে একটা চিৎকার শুনলাম, তোমরা সামনে এগুবে না, ভালো হবেনা। এ সময় ওরা (ঘাতকেরা) থমকে দাঁড়ায়। ওই চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ)। এরপর উনি দোতলায় চলে যান। কাজের বুয়া দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় উনি আমাদের ঘরে প্রবেশ না করে ডান পাশের রুমে প্রবেশ করেন। পরে আমরা জানতে পারি, একটা ফোন আসে (ফোনটি রিসিভ করে হাসানাত) মনি ভাই মারা গেছেন।’
আবেগ আপ্লুত শাহানারা আব্দুল্লাহ আরও বলেন, এরমধ্যে ঘাতকেরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা রুমে প্রবেশ করে হ্যান্ডস আপ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইংরুমে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, মা আমি তোমার কোলে উঠবো। আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পাশে আমার ভাসুর (শহীদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিলেন। পরে নিচে নামার পর অস্ত্র ঠেঁকিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ওপরে আর কে কে আছে? এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন তার চোখের ইশারায় আমি বললাম, ওপরে আর কেউ নেই। যেকারণে ওপরের রুমগুলো তল্লাশি না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি।
শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদেরকে মারতে এসেছে, না গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদেরকে বললো, তোমরা কী চাও। তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে?
ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে, আমরা কিছুই চাই না, আমাদের কোনও কমান্ডিং অফিসার নেই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘাতকেরা ব্রাশ ফায়ার করে। আমরা মাটিতে পড়ে যাই।’ এ কথা বলতেই শাহানারা আব্দুল্লাহর কণ্ঠ ভারি হয়ে ওঠে।
কিছু সময়ের জন্য চুপ থেকে চোখের জল মুছে শাহানারা আব্দুল্লাহ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘শহীদ ভাইকে ঠেঁকিয়ে ওরা গুলি করে। উনি সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে পরে যান। আমার শ্বশুরের শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমার শরীরের পেছনের অংশে হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। ওরা চলে যেতে লাগল। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। এরমধ্যেই কে যেন কান্না করে ওঠে। এরপর ঘাতকরা আবার দৌড়ে এসে ব্রাশ ফায়ার করে। এবার ওরা নীচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। আমার শ্বশুর সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। আমি আমার শ্বশুরের পেছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। ব্রাশ ফায়ারে ছয়জন মারা যায়। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নয়জন কাতরাচ্ছিলাম। এরমধ্যে আবার একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম এই বুঝি শেষ।
কিন্তু পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। তারা আমার শ্বশুরের পালস দেখে বলে, বাড়ির কেউ কেউ আহত আর কেউবা মারা গেছেন।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘পুলিশ আসার পর বাবুকে শহীদ ভাইয়ের বুকের নীচ থেকে উঠানো হলো। দেখলাম ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিছু সময় আগে যে সন্তান আমার কোলে উঠতে চেয়েছিল, তাকে কোলে নিতে পারি নাই, সেই আদরের সন্তানের নিথর দেহ আমার চোখের সামনে।’ অ্যালবামে হাত বুলিয়ে পুরনো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।
ছেলের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ঘাতকদের আগমনে ভীত চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত আশ্রয় চাইলেন মা শাহানারা আব্দুল্লাহ’র কোলে। কিন্তু মমতাময়ী মা তার আদরের ছোট্ট শিশুপুত্রকে আর কোলে নিতে পারেননি। তার আগেই ঘাতকেরা মায়ের চোখের সামনেই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে তাকে।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবু ছিল অসম্ভব মা ভক্ত। আমি যখন যা বলতাম তা মেনে নিতো। ও মাঝে মধ্যে বলতো মা তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে ঘাসের মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকবো।’ আবারও দীর্ঘসময় চুপ থাকেন শাহানারা আব্দুল্লাহ।
স্মৃতির ভার একটু সামলিয়ে উঠে শাহানারা আব্দুল্লাহ আবার বলেন, ‘ওর জন্ম ১৯৭১ সালের ২২ জুন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওকে বুকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে দৌড়েছি। একদিকে আর্মি অন্যদিকে রাজাকার। আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ) বরিশাল অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রাজাকাররা পেলেই আমাদের মেরে ফেলবে, এই আতঙ্কে ছিলাম।
যুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘদিন হাসানাতের সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে একটি চিরকুট পেলাম। তিনি পয়সারহাট এসেছেন। সেখানে গিয়ে দেখা করি। সেই সময়ে বাবুকে বুকে নিয়ে আজ এই বাড়ি তো কাল ওই বাড়িতে দিন পাড় করেছি।
ওই সময় গ্রামে দুধতো দূরের কথা ভাতও ঠিকমতো পাওয়া যায়নি। ভাত টিপে টিপে নরম করে বাবুকে খাইয়েছি। বাবু রাজত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আবার ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই সুকান্ত বাবু চলে গেল, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এ জননী।