৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

জঙ্গি করিম নিহত, জাহিদের স্ত্রীসহ তিন নারী গ্রেফতার

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:৩৬ অপরাহ্ণ, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রাজধানীর লালবাগে আরেক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়ে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। গত রাত পৌনে ৮টার দিকে আজিমপুর বিজিবি ২ নম্বর গেটের পাশের একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলার ওই আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার আরেক সন্দেহভাজন জঙ্গি আবদুল করিম। ওই আস্তানা থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে তিন নারী জঙ্গিকে। পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছে তিনটি শিশুকে। এদের মধ্যে মিরপুরের রূপনগরে নিহত জঙ্গি প্রশিক্ষক মেজর জাহিদের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছেন।

পুলিশ এদের প্রত্যেককেই দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছিল। অভিযানের সময় জঙ্গিদের বোমা ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন পাঁচ পুলিশ। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অভিযান চলার সময় ব্যাপক গুলি ও বোমার শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই বাসাটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ জানিয়েছে, আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করে কাউন্টার টেররিজম বিভাগ ও সোয়াত। ওই আস্তানা থেকে তিন  নারী জঙ্গিকেও আটক করা হয়েছে। অভিযানের পর পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এই করিমই গুলশানের হলি আর্টিজান, শোলাকিয়ার জঙ্গি হামলা, কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানাসহ জঙ্গিদের বাসা ভাড়া নেওয়ার মূল হোতা। আইজি বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় মিরপুরের রূপনগরে নিহত মেজর জাহিদুলের পরিবার লালবাগের আজিমপুরে বসবাস করছিল বলে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। এর ভিত্তিতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে গোয়েন্দা পুলিশ ওই বাসার দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দরজা খুলতে বলে।

এ সময় ভিতর থেকে মরিচের গুঁড়া, গুলি ও গ্রেনেড পুলিশের ওপর ছুড়তে থাকেন তারা। তখন পুলিশ পাল্টা আক্রমণ করলে ঘটনাস্থলে একজন জঙ্গি নিহত ও তিন নারী জঙ্গি আহত হন। গোলাগুলির সময় পুলিশের পাঁচ সদস্য আহত হন। অভিযান শেষে ওই বাসা থেকে তিন শিশুকে উদ্ধার করা হয়। একজনের বয়স ১২-১৩ বছর, একজনের ৯-১০ বছর এবং একজনের ১ বছর।’ পুলিশপ্রধান বলেন, গুলশান ঘটনার জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা বাড়ির মালিক করিম নামে যাকে খুঁজছিল পুলিশ, আজকে নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তার চেহারার অনেকটা মিল রয়েছে। তিনি জানান, আজিমপুরে জঙ্গিদের এই আস্তানা থেকে চারটি পিস্তল, বেশ কিছু ভিডিও সিডি, চারটি ল্যাপটপ ও কিছু টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এখন ঘটনাস্থলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী কাজ করছে। উদ্ধার হওয়া তিন শিশুর মধ্যে নিহত মেজর জাহিদের মেয়ে আছে কিনা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে শহীদুল হক বলেন, একজন থাকতে পারে। তবে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এদিকে পুলিশ জানায়, এ আস্তানাটি নারী জঙ্গিদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

নিজেকে ব্যবসায়ী জামশেদ পরিচয়ে ১ আগস্ট ১৮ হাজার টাকায় ১০৯/৭ নম্বর বাসাটি ভাড়া নেন করিম। বাড়ির মালিকের নাম কায়সার। কাউন্টার টেররিজম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, রাত সাড়ে ৮টায় আজিমপুরের বাড়িটি পুলিশ ঘিরে দাঁড়ালে জঙ্গিরা বিস্ফোরক ছোড়ে। হাসপাতালসূত্র জানায়, রাত সাড়ে ৮টায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শারমিন (২৫) নামে এক নারীকে পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। স্থানীয়রা জানান, আজিমপুরে বিজিবি ২ নম্বর গেটের কাছে কায়সার মিয়ার দ্বিতীয় তলায় পুলিশ অভিযান চালায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গুলি বিনিময় হয়। পুলিশ বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এলাকায় দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই বাড়ির লাগোয়া রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শী আরমান বলেন, ‘১০৯/৭ নম্বর বাসা থেকে এক নারীকে ছোরা হাতে দৌড়ে যেতে দেখি। পেছনে দেখতে পাই সাদা পোশাকের পুলিশও ছুটছে অস্ত্রহাতে। পুলিশ এ সময় লোকজনের সহায়তা চায়। এর আগে ব্যাপক বোমাবাজি ও গুলির শব্দ পাই। আমরা পুলিশকে নিয়ে ওই বাসার তিন তলার দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করি। একপর্যায়ে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকেই দেখি গুলিবিদ্ধ এক নারী মেঝেতে পড়ে আছেন। তিনি পুলিশকে দেখেই দা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পুলিশ এ সময় আবারও গুলি চালায়। পরে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।’ ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, বিডিআর-২ নম্বর গেটের কাছের ওই বাড়িটিতে পুলিশের সিটিইউর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের অভিযান চলছিল। সন্ত্রাসীরা দুই পুলিশ সদস্যের হাতে কোপ দেয় এবং তিনজনের চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়। এ ঘটনায় পুলিশের পাঁচজন আহত হন এরা হলেন— মাহতাব, জহিরুদ্দিন, রামচন্দ্র বিশ্বাস, লাভলু ও শাজাহান আলী।

মেজর জাহিদের স্ত্রী : আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে ‘মেজর’ জাহিদের স্ত্রীসহ তিন নারী জঙ্গিকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের গুলিতে আহত এই তিন নারী জঙ্গির মধ্যে একজন হলেন মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত মেজর জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা। ওই বাসা থেকে মেজর জাহিদের দুই শিশু সন্তান জুনায়েরা (৬) ও মারিয়াম (১)-কেও উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাদের একজনকে নারী পুলিশ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। এলাকার বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গোলাগুলির একপর্যায়ে সালোয়ার-কামিজ পরা নারীকে ছুরি হাতে দৌড়াতে দেখি। এ সময় পুলিশ ফাঁকা গুলি করে। একই সময় আহত এক পুলিশ সদস্য চিৎকার করে ঘটনাস্থলে আরও পুলিশ সদস্য পাঠাতে বলেন। তখন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এক নারী সদস্যকে পুলিশ আটক করে।’ অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ সদস্যরা জানান, বাড়ির দরজায় নক করলে দরজা খুলে দুই নারী তাদের লক্ষ্য করে মরিচের গুঁড়া ছোড়েন।

কে এই করিম : কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আবদুল করিমের কাজই হচ্ছে জঙ্গিদের জন্য বাসা ভাড়া করা। তার স্ত্রীও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন বলে ধারণা পুলিশের। এর আগে ভাটারা, কল্যাণপুর ও শোলাকিয়ায় এই করিমই স্ত্রী, দুই সন্তানসহ বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। সামান্য কিছু আসবাবপত্র নিয়ে বাসায় ওঠেন তিনি। পরে জঙ্গিরা ওই বাসায় অবস্থান নেওয়ার পর করিম পরিবার নিয়ে অন্যত্র সটকে পড়েন। গুলশান হামলার দুই দিন পর করিম পরিবারসহ বসুন্ধরার বাসা থেকে পালিয়ে যান। এর পর থেকে তাকে ধরতে জোর তত্পরতা চালাচ্ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, এ পরিবারটি একসঙ্গে একাধিক বাসা ভাড়া নিয়ে রেখেছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এসব বাসার কয়েকটিতে অভিযানও চালানো হয়েছে। তবে তাদের পাওয়া যায়নি। বাড়িওয়ালা তাদের জানিয়েছেন, তাদের না জানিয়েই ভাড়াটিয়ারা কোথাও চলে গিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এসব বাসায় ভারী কোনো আসবাবপত্র নেই। কোনোরকমে ঘুমানোর জন্য কিছু তোশক-বিছানাপত্র ও রান্নার জন্য হাঁড়ি-পাতিল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কোনো ডকুমেন্টসও পাওয়া যায়নি এসব আস্তানায়।

সিটির কর্মকর্তারা জানান, সাংগঠনিক সিদ্ধান্তেই আবদুল করিম বাসা ভাড়া নিতেন। তার সংসারের খরচের টাকাও দেওয়া হয় সংগঠন থেকে। তার কাজই কেবল দম্পতি পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানা তৈরিতে সহায়তা করা। সংশ্লিষ্টরা জানান, করিমের মাধ্যমেই তার স্ত্রী জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ৮-১০ বছর বয়সী তাদের দুটি সন্তানও রয়েছে।

নিরাপত্তার চাদরে আজিমপুর : নিউমার্কেট থেকে বিজিবি ৩ নম্বর গেট হয়ে আজিমপুর নতুন পল্টন লাইনে যাওয়ার মোটরসাইকেল, মোটরগাড়ি, পিকআপ ভ্যানসহ সব যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। আজিমপুরে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানকে কেন্দ্র করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় এ রাস্তায় চলাচলকারী শত শত মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। শুধু নতুন পল্টনবাসীই নয়, আজিমপুর পিলখানা ২ নম্বর গেটের সামনে জঙ্গি অভিযান পরিচালনাকালে আজিমপুর কবরস্থান, শেখ সাহেব বাজার, নবাবগঞ্জসহ আশপাশের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

32 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন