ডিমের বাজারে কড়াকড়ি, তাই বাচ্চাতে লুটপাট!
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: পোল্ট্রি খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ইঁদুর-বিড়াল খেলায় মেতেছে। সিন্ডিকেট করে কখনো দাম বাড়াচ্ছে মুরগির, কখনো ডিমের। সরকার ডিম-মুরগির বাজারে নজরদারি বাড়িয়েছে এবং ডিমের দাম প্রতি পিস ১২ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর ফলে ডিম-মুরগিতে বাড়তি মুনাফায় তাদের কিছুটা ভাটা পড়েছে।
তাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এবার পোল্ট্রি শিল্পের এক দিনের মুরগির বাচ্চা নিয়ে সিন্ডিকেট শুরু করে দিয়েছে এবং এক মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ দাম বাড়িয়ে রীতিমতো লুটপাট শুরু করেছে। এসব অভিযোগ তুলেছেন দেশের ক্ষুদ্র খামারিরা। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরতে আজ জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে ক্ষুদ্র খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)।
বিপিএর পক্ষ থেকে অভিযোগ তুলে বলা হয়েছে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মুরগির বাচ্চায় সিন্ডিকেট করে দৈনিক হাতিয়ে নিচ্ছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। এভাবে গত দুই মাসে এই সিন্ডিকেট মুরগির বাচ্চায় বাড়তি মুনাফা নিয়ে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা লোপাট করেছে।
এসব তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সুমন হাওলাদার সময়ের আলোকে বলেন, করপোরেট গ্রুপগুলো সরকারি সব সুবিধা ভোগ করেও খেয়াল খুশি মতো কখনো ডিম, কখনো মুরগি, আবার কখনো পোল্ট্রি ফিড ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে সিন্ডিকেট করে বাজারে ডিম-মুরগির বাড়তি দাম জায়েজ করতে চায়।
এখন বাচ্চায় সিন্ডিকেট চলছে। মাস দুয়েক আগেও একটি ব্রয়লার বাচ্চার উৎপাদন খরচ হয় ২৮-৩০ টাকা, বিক্রি ৩৫ টাকা। কালার বার্ড সোনালি মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ ২০-২২ টাকা, বিক্রি ৩০-৩২ টাকায়। ডিমের লেয়ার বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২০-২৫ টাকা, বিক্রি ৪৫-৫০ টাকায়।
অথচ উৎপাদন খরচ না বাড়লেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বাচ্চার দাম দ্বিগুণ করে দিয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই সেই বাচ্চা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৫ টাকায়, কালার বার্ড সোনালি মুরগির বাচ্চা ৫৫-৬০, আর লেয়ার বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়।
জানা যায়, প্রতিদিন ব্রয়লার সোনালি বাচ্চা উৎপাদন হয় ২৪ লাখ, লেয়ার বাচ্চা উৎপাদন হয় ২ লাখ। প্রতিদিন মোট বাচ্চা উৎপাদন হয় ২৬ লাখ। প্রতিটি বাচ্চায় যদি ২৫ টাকাও বেশি নেওয়া হয় তাতে, সিন্ডিকেট করে প্রতিদিন ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে করপোরেট গ্রুপগুলো। এভাবে গত দুই মাসে তারা ৩৫০ কোটি টাকা লোপাট করেছে। কৃষি আইনে উৎপাদক ৩০ শতাংশ লাভ করার কথা থাকলেও তারা ১০০ শতাংশ লাভ করে যাচ্ছে।
বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার আরও বলেন, ‘ফিড ও মুরগির বাচ্চায় ১০০ শতাংশ, ডিম ও মুরগির বাজারে ৬০ শতাংশ, আবার চুক্তিভিক্তিক খামারেও উৎপাদন করায় বাজার কার্যত করপোরেটদের দখলে চলে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়ে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একই বাজারে দুই রকম দামে বাচ্চা ও ফিড বিক্রির বৈষম্য দূর করে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদনে ধরে রাখতে হবে। সুতরাং এখনই এ বাজারে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। তা না হলে মুরগি ও ডিমের বাজার আবার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।’
এই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দৌরাত্ম্যে দেশের ক্ষুদ্র খামারিরা হারিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, একটা সময় দেশে ১ লাখ ৬০ হাজার মুরগির খামার ছিল। এর মধ্যে ২০০৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে ৬০ হাজার খামার। ২০২০ সালের করোনা মহামারির পর থেকে এখন পর্যন্ত খামার বন্ধ হয়েছে আরও ৪০ হাজার খামার। বর্তমানে চালু খামার আছে ৬০ হাজার। এর মধ্যে ব্রয়লার ও সোনালি খামার ৪৪ হাজার, লেয়ার খামার ১৬ হাজার।
তবে বন্ধ ১ লাখ খামারের মধ্যে ১৯ হাজার বন্ধ খামার করপোরেট কোম্পানির কন্ট্রাক্ট খামারে চলে গেছে। এ হিসাবে মোট ৭৯ হাজার খামার চালু আছে। এর মধ্যে কোম্পানির সঙ্গে ১৯ হাজার ও প্রান্তিক খামার ৬০ হাজার। বাজারের ডিম-মুরগির চাহিদার ৮০ শতাংশ যোগান আসে প্রান্তিক খামার থেকে, ২০ শতাংশ যোগান আসে কোম্পানি থেকে। অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এই ২০ শতাংশ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।
মো. জাকির হোসেন নামের এক ক্ষুদ্র খামারি বলেন, গত এক-দেড় বছর আগে ১ বস্তা ব্রয়লার ফিডের মূল্য ছিল ২২৫০ টাকা, যা এখন ৩৪৫০ টাকা। ১ বস্তা লেয়ার ফিডের মূল্য ছিল ১৯০০ টাকা যা এখন ২৮৭০ টাকা। ১ কেজি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন খরচ ১৬০ টাকা, যা আমরা এখন বিক্রি করছি ১৩৫ টাকা, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করে প্রান্তিক খামারিদের লোকসান হচ্ছে ২৫ টাকা করে।
তা হলে আমাদের এই লোকসানটা আমরা কীভাবে পূরণ করব। বাংলাদেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা প্রান্তিক খামারিরা সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই, একটি ডিম ১২ টাকা বিক্রি করার জন্য, কিন্তু সে ক্ষেত্রে ফিডের মূল্য পার কেজিতে ৬ টাকা কমিয়ে আনতে হবে। বর্তমান ব্রয়লার বাচ্চার মূল্য ৫৩-৫৫ টাকা ও লেয়ার বাচ্চার মূল্য ৭৫ টাকা। তারপরও বাচ্চা পাওয়া যায় না।
তাই সরকারের কাছে অনুরোধ করব বাচ্চা আমদানি বন্ধ না করে, বাচ্চা আমদানির অনুমতি দিয়ে সবসময় এক দিন বয়সের লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার মূল্য ৩০-৩৫ টাকার মধ্যে নির্ধারণ করে দিলে বাংলাদেশের প্রান্তিক খামারিরা খামার বন্ধ না করে এই পোল্ট্রি শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারবে এবং বাংলাদেশের লাখ লাখ বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারগুলো আবার উৎপাদনে ফিরে আসতে পারবে।
জাতীয় খবর