১২ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

নদী ভাঙনে বদলে যাচ্ছে রাঙ্গাবালীর ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের জীবন জীবিকা

বরিশালটাইমস, ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: এক সময় সমতল ভূমির বাসিন্দা হলেও ক্রমাগত নদী ভাঙনের কারণে ‘মানতা‘ সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা হয়ে ওঠে নৌকা কেন্দ্রিক। সমতল বিচ্ছিন্ন এসব মানুষের নাগরিকত্বই ছিল না।

এই সম্প্রদায়ের শিশুরাও সমতলের শিক্ষা ও খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত ছিল। মুজিববর্ষে উপহারের ঘর পেয়েছেন পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গম চর-চরমোন্তাজের ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের ৬০টি পরিবার।

সেইসাথে পেয়েছেন নাগরিকত্ব, এমনকি দুর্গম চরের ওই সব বাড়িতে এসেছে বিদ্যুৎ। জেলেদের মতো ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের মানুষেরও জীবিকা চলে মাছ ধরে। নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করে নৌকাতেই।

সূত্রে জানা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষের হাতে ঘর তুলে দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় ধাপে দুই শতক জমির মালিকানাসহ এসব উপকারভোগীদের সুদৃশ্য রঙিন টিনশেডের সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়। প্রতিটি ঘরে রয়েছে দু’টি বেডরুম, একটি টয়লেট ও রান্না ঘর। একেকটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার টাকা।

ঘর পাওয়া এসব মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকেই জন্মের পর থেকেই ছিলেন ভাসমান, নৌকাতেই ছিল সংসার। নৌকায় জন্ম হতো নৌকাতেই মারা যেত। তাদের সন্তানেরা কখনো পায়নি সমতলে খেলার সুযোগ।

এমনকি অনেকের সন্তান পানিতে ডুবে মারাও গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে পানির জীবন থেকে সমতলে থাকার স্বাদ পাচ্ছেন তারা। আর কুপির আলোতে জীবন কাটলেও তারা এখন বিদ্যুতের মাধ্যমে আলো পাচ্ছেন।

চর মন্তাজের বাসিন্দা ফুলবানুর চার সদস্যের পরিবার। স্বামী মাছ শিকার করে তাদের সংসার চালায়। জন্মের পর থেকেই নৌকায় থাকতেন ফুলবানু। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যেভাবে রাখছিল সেভাবেই থাকতাম। নৌকার মধ্যে ঘুমাইতাম, রান্নাবান্নাও নৌকার মধ্যে করছি। মাছ ধইরা বাজারে বিক্রি কইরা সংসার চলে। যেদিন মাছ বেশি আসে ওই দিন আয় ভালো হয়, আর নাইলে কম।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রায় দুই বছরের মতো হইসে, এই ঘর পাইসি। আগে নৌকায় কষ্টে আসিলাম। ঘর পাইয়া কষ্ট একটু কমছে। পোলাগরে একটু লেখাপড়া করাইতাম পারি। পোলা দুইডা এখন ঘরের সামনে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে, খেলতে পারে।

নৌকার মধ্যে তো পারতো না। ঘর পাওয়ার দুই মাস পর কারেন্ট আইসে। কারেন্ট যখন ছিল না তখন সোলার দিয়ে শুধু মোবাইল চার্জ দিতাম। আর কিছু চলতো না। এখন ফ্যান লাইট সব চালাইতে পারি।’

তিন ছেলে নিয়ে স্বামীসহ নৌকায় বাস করতেন রোকেয়া বেগম। এখন দুর্গম চরে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের বাড়িতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘সরকার আমাগোরে ঘর দিছে দেইখা পাইছি। আমাগোরে চেয়ারম্যান স্যারে ডাইকা নিসে, নিয়ে বলছে আপনাগো ঘর বাড়ি নাই।

ঘর-বাড়ি ঠিকানা নাই, নদীতে থাকি মাইনষে গইরাল বলে। উনি আমাদের নামটাম দিসে, আমরা ঘর পাইছি। ঘরে ওঠার কয়েক দিনের মধ্যে কারেন্ট আইসে। এত কিছু পাওয়ার পর কইছি- আমাগোরে এত কিছু যারা দিসে। দোয়া করি আল্লাহ যেন হেগরে ভালো রাহে।’

রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান বলেন, এই সম্প্রদায়ের মানুষের নদীতেই জীবন নদীতেই মরণ-এমন কথা প্রচলিত ছিল। তাদের সমস্ত জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, তারা একেবারেই নিঃস্ব।

তিনি আরো বলেন, তারা এতই জনবিচ্ছিন্ন ছিল যে, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা তা থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল। তবে মৎস্য শিকারের জন্য তাদের নদীর কিনারেই থাকতে হবে। এজন্য তাদের নদীর কিনারেই ঘর দেয়া হয়েছে, যাতে তারা সহজেই মাছের জন্য নদীতে যেতে পারে।

এখানে মূল সমস্যা ছিল তাদের যেহেতু স্থায়ী ঠিকানা ছিল না, কোনো ইউনিয়ন তাদের ভোটার করতে পারেনি এবং তাদের নাগরিকত্বও ছিল না। আমরা প্রথমে তাদের নাগরিকত্ব দিয়েছি, যাতে করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা যায়।

সেটা করার পর প্রাথমিকভাবে আমরা ২৯টি পরিবারকে এখানে পুনর্বাসিত করেছি এবং দ্বিতীয় ধাপে আরো ৩১টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এখন তারা স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করছে।

55 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন