বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৬:৪৫ অপরাহ্ণ, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
‘নিয়োগ জালিয়াতি’ পরীক্ষা ছাড়াই ফলাফল প্রকাশ
মোঃ জসীম উদ্দিন, বাউফল (পটুয়াখালী):: পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মমিনপুর আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক (প্রস্তাবিত মাধ্যমিক) বিদ্যালয়ে একাধিক কর্মচারী নিয়োগ বাছাই পরীক্ষা ছাড়াই ফলাফল প্রকাশ,চাকরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুস বাণিজ্যসহ ব্যাপক অনিয়ম-জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ ওই বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এঘটনায় রবিবার (১১ ফেব্রুয়ারী) উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এক ভুক্তভোগী নারী।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য ও ইউএনও’র কাছে লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১২ আগস্ট মমিনপুর আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অফিস সহায়ক, আয়া, নৈশপ্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন প্রধান শিক্ষক। ওই সব পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে একাধিক চাকরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকা নেন বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষক হুমায়ন কবির। ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা চুক্তিতে আয়া, নৈশপ্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে একজন করে প্রার্থী চূড়ান্ত করেন তারা। একজন অফিস সহায়ক পদের বিপরীতে তিনজনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া হয়। যার মধ্যে স্থানীয় ইউপি সদস্য কাওসার সিকদারের স্ত্রী মুক্তা আক্তার জন্য ৬ লাখ, বিদ্যালয়ের জমিদাতা সাইফুল ইসলামের পুত্রবধূ সাথী আক্তারের জন্য ৩লাখ টাকার চুক্তি হয় ও এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার স্ত্রীর জন্য ৬ লাখ টাকা চুক্তি হয়। ২০২৩ সালের ২ডিসেম্বর পটুয়াখালী সরকারি জুবলী উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে বলে চাকরি প্রত্যাশীদের প্রবেশপত্র দেন বিদ্যালয় প্রধান হুমায়ন কবির।
তবে নিয়োগ পরীক্ষার দিন (২ ডিসেম্বর) সকালে প্রধান শিক্ষকের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর থেকে ৪র্থ শ্রেণির সকল পদের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে জানিয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। এ ঘটনার ২৭দিন পর (২৯ ডিসেম্বর) কোনো পরীক্ষা ছাড়াই আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নৈশপ্রহরী পদে বাছাই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
ফলাফল পত্রে দেখা যায়, আয়া নৈশপ্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে তিনজন করে পরীক্ষায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে ২জনই নামমাত্র প্রার্থী ( ডামি)। অফিস সহায়ক পদে তিনজন প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় ওই পদে কোনো ফলাফল প্রকাশ করেনি। বাছাই পরীক্ষার ফলাফল পত্রে বিদ্যালয় ও নিয়োগ কমিটির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষক ও সদস্যসচিব হুমায়ন কবির ও ভরিপাশা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও নিয়োগ কমিটির সদস্য মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামানের স্বাক্ষর ও সীল থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ডিজির কোনো প্রতিনিধির স্বাক্ষর ও সীল নেই। জালিয়াতি করা ফলাফলের কাগজপত্র নিয়ে নিয়োগ স্থায়ী করতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তদবির শুরু করেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। বিষয়টি জানাজানি হলে বঞ্চিত চাকরিপ্রত্যাশীদের তোপের মুখে পড়েন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। এঘটনার পর থেকে এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে যান সভাপতি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য কাওসার সিকদার বলেন, আমার স্ত্রীকে অফিস সহায়ক পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি আমার কাছে ৬লাখ টাকা নেন। পরে জানতে পারি আরও সভাপতি আর দুইজনকে ওই একপদে চাকরি দেয়ার কথা হলে মোটা অংকের টাকা নেয়। এনিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে অফিস সহায়ক পদ বাদ রেখে বাকি তিনপদে গোপনে জালিয়াতি করে বাছাই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে।
আরেক ভুক্তভোগী ও বিদ্যালয় সভাপতির আপন ভাই মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ের জমিদাতা আমাদের পরিবার। আমার ভাই ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি। তিনি আমার পূত্রবধুকে অফিস সহায়ক পদে চাকরি দিতে ৩লাখ টাকা চুক্তিতে রাজি হন। ১লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছেন। চাকরি দেওয়ার পর বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সভাপতি আরও দুই জনকে একই পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৬লাখ করে টাকা নেন। আরও অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি ঢাকা চলে গেছেন বলে জানতে পারি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বলেন, আমার স্ত্রী চাকরির সভাপতিকে টাকা দিয়েছি। তিনি কথা দিয়েছেন চাকরি হলে আমার স্ত্রীরই হবে। তাই আমি চুপ আছি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক ও নিয়াগ কমিটির সদস্য সচিব মো. হুমায়ন কবির সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, নিয়োগ স্থগিত রয়েছেন। কোনো পদেই পরীক্ষা হয়নি। এমনকি তার স্বাক্ষরিত ফলাফলের কাগজও বানোয়াট বলে দাবি করেন তিনি। আর চাকরি দেওয়ার কথ কথা বলে টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কারো কাছ থেকে আমি টাকা নেইনি। এমন প্রমান কেউ দিতে পারবে না। নিয়োগ কমিটির আরেক সদস্য ও ভরপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক টাকা নেওয়ার বিষয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এসব বিষয়ে জানতে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলামের বাড়িতে ও বিদ্যালয়ে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিক বার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নাজমুল হক বলেন, কোনো নিয়োগ বাছাই পরীক্ষা হয়নি। নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে রাখা হয়েছে। তিনপদে ফলাফল প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু নিয়োগ পরীক্ষা হয়নি এবং শিক্ষা অফিস ও মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না ও স্বাক্ষর নেই তাই ওই ফলাফল পত্রের কোনো মূল্য নেই।
জেলা শিক্ষা অফিসার মুহা. মজিবুর রহমান বলেন, নিয়োগ বাছাই পরীক্ষার ফলাফল পত্রে যদি ডিজির প্রতিনিধির সাক্ষর না থাকে তাহলে সেটা বৈধ নয়। এটা নিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই। তারপরেও বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিব।
এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. বশির গাজী বলেন, লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এবিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।