নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের ব্যবহৃত তৎকালীন ওয়ারিদ (বর্তমানে এয়ারটেল) নম্বরটি জনৈক নাজমা বেগমের নামে নিবন্ধিত করা ছিল। চার্জশিটে উল্লেখ করা তথ্যানুযায়ী, এই ফোন নম্বরটি ব্যবহার করে র্যাবের মেজর আরিফ হোসনের সঙ্গে ঘটনার আগে ২৭ বার কথোপকথন হয়েছিল নূর হোসেনের। কিন্তু মোবাইল ফোনের কল লিস্ট ধরে কথোপকথনের এই তালিকাটি করা হলেও তাদের মধ্যে ওই সময়ে কী ধরনের কথা হয়েছিল তার কোনও অডিও টেপ সংগ্রহ করা হয়নি। এদিকে ওই ফোন নম্বরটির ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়ে জানা গেছে, ভুয়া নাম পরিচয় ও ঠিকানা ব্যবহার করে সিমটি কেনা হয়েছিল। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মণ্ডল আদালতে জেরার সময়ে এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন।
সোমবার নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে সাত খুনের দুটি মামলায় চতুর্থ দিনের মতো তাকে জেরা করা হয়।
এদিন নূর হোসেনের পক্ষে অসমাপ্ত জেরা শেষ করেন তার আইনজীবী খোকন সাহা, যিনি একইসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সেক্রেটারি।
জেরাতে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয় চার্জশিটে নূর হোসেনের সঙ্গে র্যাবের কর্মকর্তাদের আর্থিক লেনদেনের যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার কোনও দালিলিক প্রমাণ আছে কিনা। উত্তরে না সূচক জবাব দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
জেরার মুখে এই তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও জানান, নূর হোসেনের সঙ্গে র্যাবের সাবেক মেজর আরিফ হোসেনের কথোপকথনের কোন অডিও টেপ সংগ্রহ করা হয়নি, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৫ সদস্য নূর হোসেনের নাম বলেননি। এছাড়াও গ্রেফতারকৃত নূর হোসেনের সহযোগী গোলাম মর্তুজা চার্চিল, রহম আলী, আলী মাহমুদ এরা কেউ নূর হোসেনের কর্মচারী এমন কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি তদন্তকারী ওই কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল রাত ১০টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত মামলার প্রধান আসামি কাউন্সিলর নূর হোসেনের মোবাইলে আসামি মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ২৭ বার কল করে কথা বলেছেন। অপরদিকে একই সময়ে নূর হোসেন মেজর (অব.) আরিফ হোসেনের মোবাইলে কল করে কথা বলেছেন ১২ বার। এর মধ্যে ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টা ৩৩ মিনিট থেকে রাত ১০টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ৫ বার ও নূর হোসেন ৫ বার কল করে কথা বলেছিলেন।
চার্জশিটে এও বলা হয়, নূর হোসেন অবৈধভাবে জমি দখল, শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডে চাঁদা আদায়, কাচপুর ব্রিজের নিচে পাথর বালুর ব্যবসা, মাছের আড়ত, চিটাগাং রোডে যাত্রার নামে হাউজি, ওয়ান টেন জুয়া খেলাসহ প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করে প্রতিদিন প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টাকা আয় করতো। মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও সিও লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও অনৈতিকভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার জন্য নূর হোসেনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। নূর হোসেন তাদের অফিসে আসা যাওয়ার অন্তরালে কাউন্সিলর নজরুলকে টাকার বিনিময়ে অপহরণ, হত্যা ও গুমের প্রস্তাব দেয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের জেরার সময়ে রাষ্ট্রপক্ষে থাকা পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন, সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা হতে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে সাত খুনের দুটি মামলায় গ্রেফতারকৃত নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাসহ ২৩ আসামির উপস্থিতিতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডলকে জেরা করা হয়।
সোমবার নূর হোসেন ছাড়াও অপর আসামি র্যাবের এস আই পূর্ণেন্দু বালার পক্ষে তার আইনজীবী আহসানউল্লাহ তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জেরা করেন। এর আগের তিনটি ধার্য তারিখে র্যাবের চাকরিচ্যুত তিনজন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানার পক্ষে জেরা সম্পন্ন হয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডল বর্তমানে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক হিসেবে রয়েছেন যিনি সাত খুনের মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়ার সময়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এদিকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আসামিদের রাখার কাঠগড়ার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। দ্বিগুণ করা হয়েছে কাঠগড়ার লোহার খাঁচাটি। এর আগের জেরাতে সাবেক র্যাব কর্মকর্তা এমএম রানাসহ অন্যরা ছোট আকৃতির কাঠগড়ায় ২৩ আসামির দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে ক্ষোভের কথা জানান। এছাড়া খাবার নিয়ে সেখানে নূর হোসেনের সঙ্গে র্যাবের হাবিলদার এমদাদ হোসেনের হাতাহাতি ও চপেটাঘাতের ঘটনাও ঘটে।
নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক সোহেল আলম জানান, অনেক মামলায় কাঠগড়ায় অতিরিক্ত আসামি হলে গাদাগাদি করে রাখা হয়। সে কারণেই কাঠগড়ার পরিধি বড় করা হয়েছে।
জানা গেছে, সাত খুনের ঘটনায় দুটি মামলা হয়। একটি মামলার বাদী নিহত আইনজী চন্দন সরকারের মেয়ে জামাতা বিজয় কুমার পাল ও অপর বাদী নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। দুটি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী হলো ১২৭জন করে। এখন পর্যন্ত সাত খুনের দুটি মামলায় অভিন্ন ১২৭ সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন শেষে জেরা শুরু হয়েছে।
জাতীয় খবর