৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

পাহাড়ে জীবন বদলে দিয়েছেন ইতিহাসের যে মহানায়ক

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৩৯ অপরাহ্ণ, ০২ ডিসেম্বর ২০২২

পাহাড়ে জীবন বদলে দিয়েছেন ইতিহাসের যে মহানায়ক

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার পাহাড়ি অধিবাসীরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে বসে। বাঙালির শাসন মানতে তারা সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। চট্টগ্রাম বিভাগের বৃহত্তর পার্বত্য এলাকা আলাদা করে নিজেদের স্বাধীন সাম্রাজ্য ঘোষণা করে নিজেদের পৃথক শাসন চায় পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা; যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের থাকবে না কোনো আধিপত্য কিংবা নিয়ন্ত্রণ। বিচ্ছিন্নতাবাদী উপজাতি নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বিপুল অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ মজুদ করে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান এলাকায় সংগঠিত হয়ে প্রায়ই তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালায় সেনাবাহিনী এবং বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপরে। অপহরণ করে নিয়ে চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায় আর গুম করে ফেলা হয় অনেক সেনা, পুলিশ, আনসার, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বাঙালিদের। বাঙালি সেনাদের সাথে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গুলি বিনিময় এবং দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল একসময়ের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবেলায় ১৯৯৭ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন ইতিহাসের একজন মহানায়ক। দেশের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব এবং বাঙালিকে রক্ষার স্বার্থে নিজের জীবন বিপন্ন করে বীরদর্পে তিনি এগিয়ে যান গহীন পাহাড়ের মৃত্যুপুরীতে। পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে শান্তির বারতা নিয়ে দিনের পর দিন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আর দফায় দফায় বৈঠকের পরে অবশেষে আসে ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের বিধিবিধান ও আইন অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পরে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ইতিহাসের সেই মহানায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পাহাড়ি কথিত শান্তিবাহিনী চরমপন্থীদের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। এটি ছিল ইতিহাসের অনন্য একটি যুগান্তকারী চুক্তি। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলমান এই মহাসঙ্কট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি অতীতের কোনো সরকার। কখনোই রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেয়নি কেউ। বরং কখনো দমন-নিপীড়ন আবার কখনো অগণতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন সরকার। ফলে বাঙালিদের প্রতি পাহাড়িদের ঘৃণা, ক্ষোভ এবং সহিংসতার মাত্রা দিনদিন আরও বাড়তে থাকে।

স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই অশান্ত দেশের পার্বত্য অঞ্চলের সঙ্কট নিরসনে বঙ্গবন্ধু প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার উপজাতি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন তিনি। তবে তাকে সময় দেওয়া হয়নি। এর আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করে ঘাতকের দল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে থেমে যায় পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার সকল কার্যক্রম। এরপরে ২১ বছরের অশান্ত দেশে পাহাড় হয়ে যায় বাঙালিদের জন্য মৃত্যু উপত্যকা। অবশেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেই পার্বত্য জেলায় দীর্ঘমেয়াদি চলমান সংঘাতের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ ধারাবাহিকতায় পাহাড়ি-বাঙালি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখার স্বার্থে শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে আরও বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে জনসংহতি সমিতির প্রায় দুই হাজার সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে। সরকার তাদের পুনর্বাসন করাসহ পুলিশ ও আনসারে ৬৮৫ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন পদে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই পর্যায়ক্রমে চুক্তির বিভিন্ন শর্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বিগত ২৫ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ ধারাই সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। চুক্তির অবশিষ্ট বেশ কিছু ধারা বর্তমানে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার আন্তরিকভাবে বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছে। তথাপিও পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক কুচক্রী গোষ্ঠী সবসময় চক্রান্ত করে আসছে। উপজাতিদের অশান্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল রাখতে পাহাড়িদের নানা উস্কানি দিয়ে চলছে তারা। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর গত ২৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির যে উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেগুলো হলঃ-

☞ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ভূমি কমিশন কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যা সমাধানের কাজ চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা’ প্রণীত হলে ভূমি কমিশনে জমা পড়া বিরোধসংক্রান্ত আবেদনগুলোর শুনানি শুরু হবে।

☞ শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা করে পুলিশ এবং আনসার বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

☞ শান্তিচুক্তি করার পরে ২৫২৪ জনের বিরুদ্ধে ৯৯৯টি মামলার তালিকার মধ্যে ৮৪৪টি মামলা যাচাই-বাছাই করে ৭২০টি মামলা প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

☞ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে।

☞ ১৯৭৬ সালে জারি করা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে।

☞ চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নির্ধারিত কোটা অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।

☞ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মাননীয় সংসদ সদস্যকে প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।

☞ ১৯৯৮ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।

☞ শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য জেলাগুলোতে স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এবং শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের আওতা বৃদ্ধি এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, সেটি সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে রক্তক্ষয়ী যে সংঘাতময় পরিস্থিতি যুগের পর যুগ বিরাজমান ছিল সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। সমস্ত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা এবং রক্তক্ষয়ী সেই সংঘাতময় পরিস্থিতির পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এবং অনন্য এই পার্বত্য শান্তিচুক্তির রূপকার আমাদের বরিশালের সূর্যসন্তান দক্ষিণবঙ্গের আওয়ামী রাজনীতির অভিভাবক জননেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি।

বর্তমানে তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এই পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পৃথিবীর অনেক প্রভাবশালী দেশও যেখানে এখনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দৌরাত্ম্য আর হামলায় দিশেহারা সেখানে বাংলাদেশে এই ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি অনন্য মাইলফলক। বিশ্বশান্তির মডেল হিসেবে বাঙালির গৌরবান্বিত এক চুক্তির নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। তাই এই চুক্তি বাঙালির গৌরব এবং অহংকারের প্রতীক। #

লেখাঃ আরিফ আহমেদ মুন্না (আহমেদ মুন্না)
সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও মানবাধিকার কর্মী।
বাবুগঞ্জঃ ০২ ডিসেম্বর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ।

54 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন