বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ, ৩০ মার্চ ২০১৭
৭১’র মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭ বছরের শিশুর নাম মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় থাকা নিয়ে পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলায় তোলপাড় অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ওই সময়ে ৭ বছরের শিশু কিভাবে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিল এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করল তা নিয়ে রীতিমত হতবাক-বাকরুদ্ধ সুশিল সমাজ।
৭ বছর বয়সী ওই শিশু বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করাসহ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতাও তুলছেন।
সবাইকে তাক লাগানো এই বিস্ময়কর মুক্তিযোদ্ধা হলেন- ইন্দুরকানী উপজেলার বালিপাড়া গ্রামের মৃত্যু ছৈয়দ আলী সেপাইর ছেলে মো. আবু হানিফ।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার বয়স নূন্যতম ১৩ বছর থাকা প্রয়োজন। কিন্তু মো. আবু হানিফ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজের নাম ঠিক রাখার জন্য বয়স জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দীর্ঘ বছর ধরে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসছেন। এলাকায় হানিফ সেপাই নামে তিনি পরিচিত।
বর্তমানে তিনি উপজেলার উত্তর বালিপাড়া রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (নব জাতীয়করণ) একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তার স্কুল কোড নং-৯৯৫০২০৭৯০০১। এসএসসির সনদ অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৬৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি।”
বাগেরহাট জেলার শরনখোলা উপজেলার জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৮১ সালে মানবিক শাখায় তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। যার রোল নং- রায়েন্দা ৫৩৫, সনদ নং-০৬৪৪৮, নিবন্ধন নং-৪২৪৯১/১৯৭৭-৭৮। এই সনদ দিয়েই তিনি ১৯৮১ সালের ১ জুলাই সহকারী শিক্ষক পদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। জন্ম তারিখ অনুযায়ী চাকরিতে যোগদানের সময় তার বয়স ছিল ১৭ বছর ৪ মাস ২৫ দিন।”
এছাড়া ২০০৮ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পরীক্ষা দিয়ে ১.৭৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন। শুধু মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তভুক্তিই নয়, ১৮ বছরপূর্ণ হওয়ার আগে কিভাবে তিনি চাকরিতে প্রবেশ করলেন তা নিয়েও এখন নানা প্রশ্ন উঠেছে।’
এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বয়স এসএসসি সনদ অনুযায়ী একই। তার এনআইডি নাম্বার ৭৯১৯০১৫৭০৫৭২১।”
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে- মুক্তিযুদ্ধ বিষায়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স প্রমাণের জন্য বিগত কয়েক বছর পূর্বে একাডেমিক সনদ চাইলে আবু হানিফ নিজের অরজিনাল বয়স আড়াল করে এসএসসি সনদ না দিয়ে তিনি জালিয়াতি করে অস্টম শ্রেণির সনদ জমা দেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। আর ওই সনদে তিনি ১৩ বছর বয়স পূর্ণ করে জমা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাময়িক সনদ আনেন মন্ত্রণালয় থেকে।”
মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আবু হানিফের মুক্তিযোদ্ধা আইডি নং- ০১০৬০৫০০৬৪, গেজেট নং-২৪৬৮ এবং মুক্তিবার্তা নং-০৬০৫০৩০০২৪। আবু হানিফের মুক্তিযোদ্ধা ডাটাবেইজ ও শিক্ষাগত পেশার ডাটাবেইজের বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্যে গড়মিল রয়েছে। যদি তার সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা অস্টম শ্রেণি পাশ হয়, তাহলে তিনি কি করে এই সনদে সহকারি শিক্ষক পদে চাকরি নিলেন এমন প্রশ্ন তুলেছেন কয়েকজন শিক্ষক।”
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যদি তার বয়স নূন্যতম ১৩ বছর থাকতো তাহলে ২০১৭ সালে তার অবসর গ্রহণের কথা ছিল। বিধিমতে ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন ওই সব মুক্তিযোদ্ধা। যারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেছেন তারা ২০১৭ সালের মধ্যে অবসরে যাবেন।
এছাড়া তিনি সাধারণ চাকরিজীবীদের চাইতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি আরও ১ বছর সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পেতে পারেন। সে হিসেবেও ২০১৮ সালে তার অবসর গ্রহণের কথা।
কিন্তু এখনও তার অবসর গ্রহণের সময় রয়েছে সাধারণ কোটায় ৬ বছর এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বাড়তি ১ বছর মিলিয়ে মোট ৭ বছর। বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য শিক্ষকতা পেশা থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন বলে অনেকের কাছে বলে বেড়ালেও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তার অবসর গ্রহণের জন্য এখনও ৭ বছর সময় রয়েছে।”
আবু হানিফ ভিন্ন পন্থায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন বলে এলাকাবাসী অনেকের মন্তব্য। একই গ্রামের এক বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধার সহায়তায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তিনি মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে।’’
এই সনদ দিয়েই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তার সন্তানরাও ইতিমধ্যে সরকারি চাকরি নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবু হানিফের ব্যাপারে উত্তর বালিপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা বরিশালটাইমসকে জানান- মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আবু হানিফ শিশু ছিলেন। শিশু বয়সে কিভাবে তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেন তা বোধগম্য নয়। তাছাড়া বহু বছর পূর্বে দুটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয় তার কাছ থেকে।”
এলাকায় তিনি প্রভাবশালী প্রভাব বিস্তার করে চলেন বিধায় স্থানীয়রা প্রকাশ্যে তার ব্যাপারে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আবু হানিফের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।’
পিরোজপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ মজুমদারের কাছে অভিযুক্ত শিক্ষক আবু হানিফের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বরিশালটাইমসকে বলেন- আমরা ওই শিক্ষকের বিষয়টি শুনেছি। খোঁজখবর নিয়ে তার কাগজপত্র যাচাই-বাচাই করার প্রস্তুতি চলছে।”
এ ব্যাপারে ইন্দুরকানী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বেলায়েত হোসেন বরিশালটাইমসকে বলেন- উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আবু হানিফের নাম রয়েছে। তবে তার জন্ম তারিখে বয়সের কোন হেরফের থেকে থাকলে সেটা আমার জানা নেই।”
পিরোজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সমীর কুমার বাচ্চুর বরিশালটাইমসকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষায়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধার বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছেন নূন্যতম ১৩ বছর। ১৩ বছরের কম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।’
এর কম যদি কারো বয়স হয় কিংবা কেউ যদি জালিয়াতি করে বয়স বাড়ায় সেটা প্রমাণ হলে তালিকা থেকে তিনি বাদ পড়বেন।”
এ ব্যাপারে ইন্দুরকানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নুরুল হুদা বরিশালটাইমসকে বলেন- কোন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এরকম কোন তথ্য গোপনের অভিযোগ পেলে কাগজপত্রের সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”