বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৮:২৭ অপরাহ্ণ, ২৮ মার্চ ২০২৪
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: বরিশাল নগরীর দক্ষিণ রুপাতলীর সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আব্দুল মন্নান খান বাদশা মিয়ার বাসার সম্মুখে নামকরণে নির্মিত স্মৃতি ফলক নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছেই। প্রথমে হুমকি-ধামকি এবং পরবর্তীতে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনকে ব্যবহার করে গেটটি ভাঙা বা অপসারণে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবিরোধী অংশটি কৌশলী পথে হাটতে শুরু করেছে। সরকারি সড়কে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার গেট নির্মাণ করে আটকে রেখেছে এমন অভিযোগ এনে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে। বরিশাল প্রেসক্লাবে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন স্থানীয় শামীম খান নামের এক যুবক, যিনি কী না ব্যাংক ডাকাতি এবং পুলিশ পেটানোসহ একাধিক মামলার আসামী। একজন চিহ্নিত অপরাধীর স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের প্রতি বিরুদ্ধাচারণকে সমাজের অধঃপতন হিসেবে দেখছে মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটি।
অবশ্য এ ইস্যুতে ইতিমধ্যে আলোচিত এই সংগঠনটি রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে বরিশালের রুপাতলীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি নিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ জানানোসহ প্রতিরোধে উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীকে অবহিত করার কথা জানানো হয়। সেই সংবাদ সম্মেলনের খবর বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি বিভিন্ন পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হয়েছে। বিষয়টি আলোচনায় আসার পরে বরিশালে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে চেপে ধরতে চাইছে স্থানীয় সুবিধাবাদী মহলটি, যার অগ্রভাগে আছেন পুলিশ পেটানো মামলার আসামি শামীম খান।
জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবিরোধী ওই সংবাদ সম্মেলনে আব্দুর রশিদ আকন, শেখ মো. সালাম, হাবিল খান, হাবিব খান, সোহরাব খান এবং তার ছেলে সাদ্দাম অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় রশিদ আকন নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করলেও তার মর্যাদা নিয়ে ঢের বিতর্ক রয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এই রশিদ আকনের সরকারি ভাতা আপাতত বন্ধ আছে, যা তিনি নিজেও স্বীকার করেন।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই চক্রটি শুধু মুক্তিযোদ্ধার নিজের ভূমিতে থাকা নামফলকটি ভাঙতে চাইছে না, এমনকি বীর সন্তানের বাসার ভেতর থেকে তাদের সুবিধার্থে একটি সড়কও করে নিতে চাইছেন। অভিযোগ আছে, তাদের এই মিশন বাস্তবায়ন করা গেলে শেখ সালামসহ সকলের ভূমির মূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এবং পরবর্তীতে তারা অতিরিক্ত দামে ভূসম্পত্তি বিক্রি করতে পারবেন। মূলত এই ধান্দায়ই গ্রুপটি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, দেখাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি ফলক ভাঙার মত ধৃষ্টতা।
উল্লেখ্য, এই গ্রুপটি কিছুদিন পূর্বে অনুরুপ অভিযোগ করেছিল বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে, যা সার্ভেয়ার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা তদন্ত করলেও মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির ওপর দিতে চলাচলের কোনো পথের অস্থিত্ব পাননি। তবে তিনি প্রতিবেদনে প্লান বহির্ভুতভাবে মুক্তিযোদ্ধার নামকরণে গেট নির্মাণের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ফাতেমা বেগম জানান, অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা উভয়পক্ষকে ডেকে শুনানী করেছেন। সেখানে কোনো সুরহা না হওয়ায় পরবর্তীতে বিষয়টি দেখভালের জন্য ২৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফিরোজ আহম্মেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাউন্সিলর পরবর্তীতে উভয়পক্ষকে নিয়ে বসার সিদ্ধান্ত নিলেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আব্দুল্লাহ নাঈম রয়েলকে হয়রানির ওপর রাখছে। এমনকি বৃহস্পতিবার বরিশাল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তাকে কালোবাজারিও বলা হয়েছে, কিন্তু তাকে কি ভাবে এই তকমা দেওয়া হলো তা ব্যাখ্যা করতে পারেননি ব্যাংক ডাকাতি মামলার আসামি আলোচ্চ্য শামীম খান।
রয়েলকে কালোবাজারি কেন বলা হয়েছে, সেই বিষয়ে জানতে শামীমের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাতে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে শামীম তার নিজের বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতি এবং পুলিশ পেটানো মামলা চলার কথা স্বীকার করেছেন। এবং বলছেন, রয়েলের বাবা বাদশা মিয়া তার বাসার ওপর দিয়ে হাঁটাচলা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেই স্থানটি তারা সড়ক হিসেবে চাইছেন।
কিন্তু সিটি কর্পোরেশন যেখানে কাউন্সিলরকে সুরহার দায়িত্ব দিয়েছে, সেখানে তার কাছে না গিয়ে কেনো মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে কেনো- এমন প্রশ্নে খেই হারিয়ে ফেলেন শামীম। বলেন, কাউন্সিলর ফিরোজ বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত, এ কারণে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে কিছু বলতে পারছেন না।
তবে কাউন্সিলর ফিরোজ আহম্মেদ বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা বাদশা মিয়ার বাড়ির ভেতর দিয়ে রেকর্ডীয় কোনো সড়ক নেই, তবে তিনি জীবিত থাকাকালীন কাউকে চলাচলে বাঁধা দেননি। তিনি মারা গেলে সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাওয়ায় সন্তানেরা যে যার মতো করে বাড়িঘর করায় জায়গা সংকুচিত হয়ে এসেছে। তার মধ্যে থেকে চলাচল করতে চাইছেন পেছনের বাসিন্দারা। এই সড়কটি বাদ দিলেও তাদের চলাচলে আরও দুটি সড়ক থাকছে, কিন্তু এখানে অনেকের বৃহৎ স্বার্থ আছে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির ভেতর থেকে রাস্তাটি নেওয়া গেলে অনেকের ভূমির মূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে, এমন ধান্দায়ও অনেকে আইন না বুঝে লাফালাফি করছে। এতে কোনো লাভ নেই মন্তব্য করে কাউন্সিলর বলেন, যদি মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সাথে বসে আপসরফা না করা যায় তাহলে রাস্তা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার বাসার ভেতর থেকে রাস্তা নেওয়া নিয়ে যারা মাঠে নেমেছে, তাদের মধ্যেও ইতিমধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবু আকন এই অনৈতিক দাবি থেকে সরে আসায় তাকে কদিন আগে মারধর করেছে রশিদ আকন এবং তার ছেলে-সন্তানেরা। ভুক্তভোগী আকন সেই ঘটনায় কোতয়ালি মডেল থানা পুলিশের কাছে একটি অভিযোগও করেছেন, যা এসআই পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা তদন্ত করছেন বলে জানা গেছে।
বরিশালের এই মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে অব্যাহত হয়রানির এই ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটি এবং রাইট টক বাংলাদেশ দু দফা সংবাদ সম্মেলন করে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে, যা পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হওয়ার পর গোটা দেশব্যাপি আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে বিষয়টি নিয়ে বরিশাল প্রশাসনও নড়েচড়ে বসেছে, কী ভাবে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবারকে এতটা হয়রানির ওপর রাখা যায় সেই ভাবনায়।
এরই মধ্যে স্বার্থান্বেষী মহলের সংবাদ সম্মেলন বিষয়টির গুরুত্ব যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি উল্লেখিত সংগঠন দুটিও মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি রক্ষায় যথার্থ পথে সামনে অগ্রসর হওয়ার কথা জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
বরিশালের এই ঘটনায় ক্ষোভপ্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটি সভাপতি জাফর ইকবাল নান্টু বলেন, পুরো বিষয়টি তাদের পর্যবেক্ষণে আছে। এবং এনিয়ে তাদের সংগঠন প্রতিবাদও জানিয়েছে। কিন্তু ভূমিদস্যুরা উল্টো পথেই হাঁটছে। সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণসহ জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন এই শীর্ষ নেতা।’