বরিশালের সংস্কৃতিজন শান্তি দাস গত ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ আলতাফ মাহামুদ মাহমুদ স্মৃতিপদকে ভুষিত হয়েছেন। ২৭টি সংগঠনের জোট বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস উদযাপন উপলক্ষে চার দিনব্যাপী আয়োজনের সমাপনী অনুষ্ঠানে তাকে এ পদক প্রদান করা হয়।
ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বরিশাল-২ আসনের সাংসদ। অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস। একই অনুষ্ঠানে পদক পেয়েছেন ভাষাসৈনিক ইউসুফ হোসেন কালু।
শান্তি দাস বরিশালের সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব শান্তি দাস। বরিশালের সামাজিক সাংস্কৃতিক বিকাশের চলমান কর্মকান্ডে সেই ৭০ দশক থেকে তিনি নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ এবং পরক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন।
১৯৪৮ সালে ১২ই জানুয়ারী বরিশালের হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের বদপুর নামে গ্রামে এক কৃষক পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। কৃষিকাজের পাশাপাশি তাঁর পিতা আয়ুর্বেদিক ও কাকা এ্যালেপ্যাথিক ডাক্তার হিসেবে গ্রামের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করতেন।
৬ ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শান্তি দাস ও তাঁর পরিবার ভাগ্যক্রমে ৫০ এর দাঙ্গায় বেঁচে যান। কিন্তু সেই সময় তার পরিবার আর্থিক ও সামাজিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে তাদের বসতঘরসহ ওই গ্রামটিই মেঘনায় তলিয়ে যায়।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে অধ্যায়নের সময়ে তিনি বিডি হাবিবুল্লাহ পল্লীমঙ্গল নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যুক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন সময় বিদ্যালয় ও এলাকার কাবের মাধ্যমে নাটক, আবৃত্তি ও খেলাধুলার কার্যক্রম চালিয়ে যান। তাঁকে এসব কার্যক্রম প্রথম অবস্থায় সহায়তা করেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী আনোয়ার হোসেন, কাজী ইদ্রিস, আবুল বাশার প্রমুখ।
১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করে তিনি এলাকায় শিক্ষকতা পেশায় মেনে পড়েন। শিক্ষকতার পেশায় সততা, স্বচ্ছতা ও আদর্শ শিক্ষকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।
চাকুরীরত অবস্থায় এম এ-বিএড-সি এন এড ডিগ্রী অর্জন করেন। শান্তি দাস গ্রামে ছাত্রাবস্থায় কমরেড সোলায়মানের অনুপ্রেরণায় বাম রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হন।
তাঁর এলাকায় তিনি বামধারায় কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে সংঘঠিত করেন। তিনি পরবর্তীতে এলাকার যুবসমাজের সাথে একত্রিত হয়ে স্বাধীকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে নিয়োজিত হন। ৬৯ এর গণ অভ্যূথনে শান্তি তার নিজ এলাকায় আন্দোলনে যুক্ত হন।
‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এলাকায় আব্দুল বারেক’র (সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) নেতৃত্বে যুব সমাজ স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। এদের সাথে শান্তি দাস এলাকায় এলাকায় জনসচেতনতাসহ মানুষকে সংঘঠিত করার কাজে ভূমিকা রাখেন। তবে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেয়ার জন্য শান্তি দাস কখনও চেষ্টা করেননি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি এলাকার রিলিফ কমিটি সদস্য হিসেবে আত্মমানবতার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ’৭৩ সালে শান্তি দাস বরিশালে বদলী হয়ে আসেন।
মহাবাজের সরকারি উলালঘুনী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরীকালীন তিনি শিশু সংগঠন খেলাঘর’র শাখা ছায়াবিথী খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। পরবর্তীকালে তিনি শিশু সংগঠন চাঁদেরহাট জেলা সাংগঠনিক কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত থাকার পাশাপাশি তিনি পরিচ্ছন্ন বাম রাজনীতির সাথেও সংশ্লিষ্টতা বজায় রাখেন। তারই সুবাধে একই ধারার কিছু ব্যক্তি নিয়ে ৮০ দশকের শুরুতে গড়ে ওঠে সৃজনী নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। তিনি এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
পরবর্তীকালে ৮২ সালে সৃজনী বিলুপ্ত করে গণশিল্পী সংস্থা বরিশাল শাখা গঠন করা হয়। পরবর্তীতে তিনি এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং বর্তমানে তিনি এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সৃজনী ও গণশিল্পী সংস্থার মাধ্যমে প্রগতিশীল অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি এতে কখনো সংগঠক, কখনো অভিনেতা, কখনো প্রম্পটার হিসেবে কাজ করেছেন। নাট্যজীবনের শুরুতে তিনি নারী চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। ৯০ দশকের পর গণশিল্পী সংস্থা নাটকের চেয়ে গণসঙ্গীতকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।
এক্ষেত্রে শান্তি দাসকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন প্রয়াত সয়ম্ভু সরকার। তিনি গণশিল্পী নামে একটি লিটেল ম্যাগাজিন বিভিন্ন সময় সম্পাদনা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নতুন নতুন লেখক সৃষ্টি করতে কাজ করেছেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি শান্তি দাস একজন শিক্ষক নেতা হিসেবেও সমধিক পরিচিত। তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের বিভিন্ন সঙ্কটকালীন অবস্থায় বরিশালে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ০৫ সালে চাকুরী থেকে অবসরের সময় তিনি বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, বরিশাল মহানগর শাখার সভাপতি ছিলেন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি অধিকাংশ সময় নেপথ্যে থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ন কাজ করেছেন। অবসরের পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি করে যাচ্ছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির বরিশাল মহানগর কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বের সাথে কাজ করছেন।
তিনি ’৭১এর ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক; সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১’র বিভাগীয় কমিটির অন্যতম সদস্য। শান্তি দাস নজরুল সাংস্কৃতিক জোট বরিশাল এর সভাপতি এবং বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান অন্যতম সদস্য। সমন্বয় পরিষদের তিন দশকের আন্দোরন সংগ্রামে তিনি ব্যপক অবদান রেখেছেন।
শান্তি দাস কিশোর বয়স থেকে আজ অবধি একটি সুখী সুন্দর, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।’
শিরোনামখবর বিজ্ঞপ্তি, টাইমস স্পেশাল, বরিশালের খবর