বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৮:২৬ অপরাহ্ণ, ৩১ মে ২০১৬
বরিশাল: ছয় বছর আগে বাংলাদেশি নারী পাচারকারী চক্রের কবলে পড়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা ভারতীয় এক শিশুকে বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বজরঙ্গী ভাইজান আখ্যা পেয়েছেন বরগুনার জামাল বিন মুসা। তার মানবিকতার অনন্য উদাহারণ ইতোমধ্যেই ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমসহ বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও তুলে ধরা হয়েছে।
জামাল বিন মুসার (৫৫) বাবার বাড়ি সৌদি আরবে। তার নানা বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার গেরামর্দন গ্রামে।
গেরামর্দন গ্রামের তার নানা বাড়ির কাছেই তার বসবাস। তার বাড়ির কাছের মরহুম নূর হোসেনের মেয়ে হাসি বেগমের (৪০) বাড়ি। ওই বাড়ির প্রধান হাসি বেগম ও তার ছয় বোন প্রায়ই ভারতের দিল্লিতে যাওয়া আসা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিল্লির সিমাপুরি এলাকায় থাকেন তারা। এই পরিবারের ভারত যাওয়া আসায় নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ তৈরি হয়। ওই পরিবারের বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলেই তার উপর নেমে আসে মামলা হামলার খড়গ। এমনই এক সময় ২০১০ সালের দিকে রহস্যময় ওই বাড়িতে ছয় বছর বয়সী অপরিচিত একটি শিশুকে দেখতে পায় এলাকাবাসী। অপরিচিত সেই শিশুটির উপর প্রায়ই অমানবিক নির্যাতন চালানোর দৃশ্য ধরা পড়ে গ্রামবাসীর চোখে।
নয়াদিল্লির দিলসাদ গার্ডেন থেকে পাচারকারীদের কবলে পড়ে হারিয়ে যাওয়া ছয় বছরের শিশু অভিরূপ সোনু খোঁজ খবর নিতে গিয়ে একসময় পাচারকারীদের রোষানলে পড়েন জামাল। সেই থেকে একের পর এক মিথ্যে মামলায় পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন জামাল। তারপরেও থেমে থাকেনি তার মিশন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন জামাল। তারপর ভারতের নয়া দিল্লির পথে পথে ঘুরে সোনুর বাবা মাকে খুঁজে পেয়েছেন জামাল।
সম্প্রতি শিশু সোনু এবং হাসি বেগমের অপর এক ছোট বোনের স্বামী জাহাঙ্গিরের দেয়া অস্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে দিল্লির সিমাপুরি এলাকায় দিলসাদ গার্ডেনের সামনে একটি গাড়ির গ্যারেজে সোনুর বাবা মেহবুব মেহমুদের খোঁজ পান জামাল বিন মুসা।
এসময় সোনুর ছবি দেখালে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা মেহবুব মেহমুদ। জামাল বিন মুসা জানান, দিল্লির নিউ সিমাপুরি জুগ্গিজামে মসজিদের পাশে মেহমুদ পরিবারের বাড়ি।
এরপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সোমবার দুপুরে বাংলাদেশে ফিরেছেন তিনি। দেশে ফিরে বিকেলে তিনি দেখা করেন ভারতীয় হাই কমিশনারের সঙ্গে। তারা সবাই সোনুকে তার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে সবরকমের সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের পরামর্শে স্থানীয় সাংসদ ও বরগুনা সমাজ সেবা কার্যালয়ের স্থানীয় কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে বরগুনার আদালতে হাজির করা হয় অভিরূপ সোনুকে। আদালত সোনুকে যশোরের কিশোর উন্নযন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বর্তমানে সোনু সেখানেই রয়েছে।
জামালের স্ত্রী নীরু বেগম জানান, মানবপাচারকারী চক্রের মূল হোতা হাসি বেগম এবং তার পারিবারের অত্যাচার ও নির্যাতন সইতে না পেরে সোনু তিন-তিনবার তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু পালিয়েও হাসির কাছ থেকে নিস্তার পায়নি সোনু। এরপর ছেলেটির ব্যাপারে জানতে চাইলে তার স্বামী ও একমাত্র ছেলের নামে মামলা করেন হাসি। ওই মামলায় তার নিরপরাধ স্বামী ও একমাত্র ছেলে ফেরদৌসকেও জেলের ঘানি টানকে হয়।
গেরামর্দ্দন গ্রামের পরীভানু বলেন, আজ থেকে চার বছর আগে তার ছেলে হাসিবুর রহমানকে (২২) চাকরি দেয়ার কথা বলে ভারত নিয়ে যায় হাসি বেগম। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তার ছেলের আর কোনো খবর নেই বলে তিনি জানান। তার ছেলেকে চাকরি দেয়ার কথা বলে হাসি পাচার করে দিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ছেলের খোঁজ-খবর নেয়ার বিষয়ে থানা-পুলিশের সহযোগিতা নিলে ছেলেকে আর কোনোদিনও দেখতে পাবেনা বলে হুমকি দেন হাসি। তাই ছেলেকে হারানোর ভয়ে পরীভানু কারো সহযোগিতা নেননি বলেও জানান তিনি।
একই এলাকার মো. জুয়েল মিয়া জানান, এলাকায় এমন দুর্ধর্ষ পাচারকারি চক্রের কারণে গ্রামের ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে এই সকল পরিবারই সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। তাই তিনি এই দুর্ধর্ষ পাচারকারী চক্রকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান।
মুঠোফোনে জামাল বিন মুসা জানান, দীর্ঘ চার বছর ধরে যে প্রচেষ্টা আমি চালিয়ে গেছি তার ফল আমি পেয়েছি। দিল্লিতে সোনুর বাবা-মায়ের মুখ দেখে আমার সকল কষ্ট ভুলে গেছি। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ সকল কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আমি মুগ্ধ। বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে আমার মিনতি যাতে, সোনুর পাচারকারীরা পালিয়ে যেতে না পারে। আমার এবং আমার পরিবারের প্রতি যেসব মিথ্যে মামলা দেয়া হয়েছে তা থেকে যাতে পরিত্রাণ পেতে পারি সে বিষয়েও তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সহযোগিতা চেয়েছেন।
জামাল বিন মুসা আরও জানান, বেতাগীর গেরামর্দন গ্রামের হাসি বেগমের পুরো পরিবার মানব পাচারের সাথে জড়িত। সোনুকে পাচারের পর হাসি ও তার লোকজন সোনুর বাবামায়ের কাছে এক লাক টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিলো বলেও তিনি জানান।
এ বিষয়ে হাসি বেগমের বাড়িতে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি।
বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক পিপিএিম জানান, রহস্যময় হাসি বগেমের বাড়ি এবং তার বাড়ির সকল সদস্য পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। আর পুলিশ পুরো বিষয়টিকে খতিয়ে দেখছে বলেও জানান তিনি।