বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৬:০০ অপরাহ্ণ, ৩১ অক্টোবর ২০১৬
বরগুনার সদরঘাট জামে মসজিদের বিতর্কিত ঈমাম মো. জাহিদুল ইসলামের (৪৫) বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
রোববার রাতে বরগুনা সদর থানায় সাধারণ ডায়েরীটি করেন বরগুনা শহরের নজরুল ইসলাম সড়কের বাসিন্দা মো. মনিরুল ইসলাম (৪৮)। সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয় ইমাম জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হজ্ব পালনের নামে স্থানীয় এক দম্পতির সাথে প্রতারণার অভিযোগ থাকায় তাকে মসজিদের ইমামের পদ থেকে অপসারণের জন্য কেন্দ্রীয় (সদরঘাট) মসজিদের সভাপতি ও বরগুনার জেলা প্রাশাসক ড. মহা. বশিরুল আলমসহ বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবং বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক পিপিএম এর কাছে তারা আবেদন করেন।’
এতে ইমাম জাহিদুল ইসলাম তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে রোববার রাতে বরগুনা সোনাখালী এলাকার মারকাস মসজিদে গিয়ে তার (জাহেদুলের) সহযোগী আলহাজ্ব আবুল হোসেন জমাদ্দার (৭০), আমজাদ হোসেন (৫০), সাবু (৪৬) ও জসিম উদ্দীনকে (৪৫) সঙ্গে নিয়ে তাকে খুন ও আঘাতসহ বিভিন্ন ভাবে ক্ষতি সাধনের জন্য ভয়ভীতি দেখান।’
এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরির কথা স্বীকার করে বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রিয়াজ হোসেন বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রসঙ্গত বরগুনার কেন্দ্রিয় (সদরঘাট) জামে মসজিদের ঈমাম জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হজ পালনের নামে বাণিজ্যের পাশাপাশি মসজিদের অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা এবং জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।’
চলতি বছর প্রতারণার মাধ্যমে বরগুনার এক অসুস্থ গৃহবধুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার স্বামীকে পৃথক দলে হজে পাঠিয়ে ওই গৃহবধুর মাহরাম (বৈধ অভিবাবক) সেজে হজে যান ঈমাম জাহিদুল। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক ও কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সভাপতি ড. মহা বশিরুল আলমের কাছে ঈমাম জাহিদুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী দম্পতিসহ স্থানীয় মুসুল্লীরা।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য বাতায়ন থেকে তথ্য কারচুপি: পবিত্র হজ পালনকে কেন্দ্র করে বরগুনার এক নিরীহ দম্পতির সাথে প্রতারণার তথ্য ফাঁস হওয়ার পরে এ বিষয়ে প্রথম শ্রেনীর একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর বরগুনার কেন্দ্রীয় (সদরঘাট) জামে মসজিদের পেশ ঈমাম মো. জাহিদুল ইসলাম ওরফে গোলাম মাওলা জাহিদকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে বরগুনায়।’’
ভুক্তভোগী দম্পতির সাথে কথা বলে জানা গেছে, লামারাস এভিয়েশন নামের একটি ট্রাভেল এজেন্সীর পক্ষে বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে চলতি বছর প্রতারণার মাধ্যমে বরগুনার কেজি স্কুল সড়কের অসুস্থ গৃহবধু রিফাত আরা মুকুলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার স্বামীকে পৃথক দলে হজে পাঠিয়ে ওই গৃহবধুর মাহরাম (বৈধ অভিবাবক) সেজে হজে যান ঈমাম জাহিদুল।’
এ বিষয়ে ঈমাম জাহিদুলের কাছে জানতে চাইলে স্থানীয় মুসুল্লীদের কাছে বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন জাহিদুল। তিনি কারও মাহরাম (বৈধ) হয়ে হজে যাননি বলে জানান জাহিদুল। পরে বাংলাদেশ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য বাতায়নে রিফাত আরা মুকুলের প্রাক নিবন্ধনে সুস্পষ্টভাবে রিফাত আরা মুকুলের ‘মাহরাম এজ আঙ্কেল’ হিসেবে ঈমাম জাহিদুলের নাম লেখা দেখে ঈমাম জাহিদুলের অসত্য তথ্য ও প্রতারণার বিষয়ে নিশ্চিৎ হন মসজিদ কমিটির সংশ্লিষ্ট সদস্য ও মুসুল্লীরা। এসময় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য বাতায়নে রিফাত আরা মুকুলের প্রাক নিবন্ধনের স্ক্রিণ শর্ট তুলে রাখেন স্থানীয়রা। পরে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও শেয়ার করেন অনেকেই।’
এসব তত্যের ভিত্তিতেই ওই পত্রিকায় প্রতিবেদন তৈরী করা হয়। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে ঈমাম জাহিদুলের প্রতারণার বিষয়টি সু-স্পষ্টভাবে প্রমানিত হলে ফেঁসে যান জাহিদুল। পরে লামারাস ট্রাভেল এজেন্সী ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আইটি বিভাগের অসাধু কর্মচারীদের যোগসাজশে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য বাতায়নে প্রকাশিত পূর্বেকার তথ্য পরিবর্তন করেন জাহিদুল। সোমবার সকাল থেকে ওই তথ্য বাতায়নে রিফাত আরা মুকুলের প্রাক নিবন্ধন থেকে ‘মাহরাম এজ আঙ্কেল’ হিসেবে কৌশলে জাহিদুলের নাম মুছে দেয়া হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসুস্থ ও বয়স্ক গৃহবধু রিফাত আরা মুকুলের বাম হাতে সমস্যা রয়েছে। নিজের কাপড় নিজে পরতে কষ্ট হয় তাঁর। এমন পরিস্থিতিতে আকষ্মিকভাবে স্বামীছাড়া অজানা অচেনা পথে একাকী ফ্লাইটে হজ যাত্রায় এবং সহ¯্র মানুষের ভিড়ে একাকী ওমরা হজ পালনে চরম ভোগান্তির শিকার হন তিনি। এ বিষয়ে বরগুনার কেন্দ্রীয় (সদরঘাট) জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির নির্বাচিত কোষাধ্যক্ষ হাফেজ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, দালালী, ব্যবসা কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে একই ব্যক্তির বারবার হজে যাওয়াকে পারমিট করে না ইমিগ্রেশনাল আইন/পুলিশ। তাই চতুর্থবারের মত হজে যেতেই বাণিজ্যিক স্বার্থে ঈমাম জাহিদুল প্রতারণার মাধ্যমে নিজেকে রিফাত আরা মুকুলের মাহরাম বানিয়েছেন।’
এবং বঞ্চিত করেছেন ওই দম্পতিকে। ঈমাম জাহিদুলের প্রতারণার বিষয়ে বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান বাহাদুর বলেন, ‘সৈয়দ ওয়ালী উল্যাহর বিখ্যাত উপন্যাস লালসালুর ধর্মব্যবসায়ী মজিদ আর বরগুনার বর্তমান ঈমাম জহিদুল আলাদা কিছুই না। মজিদ তৎকালীন ধর্ম ভিরু নিরিহ কিছু মানুষের আবেগকে পুঁজি করে মাজার বানিয়েছিলো। আর বর্তমান যুগের জাহিদ শিক্ষিত কিছু ধর্ম ভিরু মানুষের আবেগকে পূজি করে হজ মৌসুমে ব্যবসায় নেমে পড়েন। এরা সবাই শান্তির ধর্ম ইসলামের শত্র“।’
এ বিষয়ে বরগুনার কেন্দ্রীয় (সদরঘাট) জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সুচতুর প্রতারক ও ধর্মব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলামের হাত এতই লম্বা যে তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। বরগুনার শতশত মানুষ বেশ কয়েকদিন ধরে যে তথ্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেখলো তা নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল জাহিদুলের গোপন কারসাজিতে।’ তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সেকোন্ড ইন কমান্ড জাহিদুল দীর্ঘদিন ধরে বরগুনায় ধর্ম প্রচারের নামে অতি গোপনে সুকৌশলে একটি বিরাট সংখ্যক তরুণকে উগ্রবাদী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীর দিকে টেনে নিচ্ছেন, যা সুস্পষ্ট। আর তার এ কাজে তাকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছে বরগুনার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিবৃন্দ। স্থানীয় প্রশাসনও সবকিছু জেনে শুনে নির্বিকার রয়েছেন।’
ভুক্তভোগী দম্পতির বক্তব্য: ভুক্তভোগী গৃহবধু রিফাত আরা মুকুল জানান, জাহিদুলের প্রতারণার বিষয়ে অভিযোগ জানানোর পর থেকে জাহিদুল তার অনুসারীদের নিয়ে মিথ্যে মামলা করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে তার সাথে প্রতারণার সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তার অভিযোগ ও কালেরকণ্ঠের ওই প্রতিবেদনকে মিথ্যে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন জাহিদুল ও তার অনুসারীরা।
প্রতারণার বিষয়টি আড়াল করতে জাহিদুলের কারসাজিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য বাতায়ন থেকে তথ্য বিকৃত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, তার প্রাক নিবন্ধনে সুস্পষ্টভাবে জাহিদুলের নাম তার মাহরাম
হিসেবে লেখা ছিলো। সোমবার থেকে তার প্রাক নিবন্ধন থেকে মাহরাম হিসেবে জাহিদুলের নাম সরিয়ে দেয়া হয়েছে। রিফাত আরা মুকুল আরও বলেন, ‘হজের উদ্দেশ্যে যে সব নারী স্বামীর সাথে হজ্বে যান তাদের ভিসায় মাহরাম (বৈধ অভিভাবক) হিসেবে স্বামীর নাম লেখা থাকে।
কিন্তু তাঁর ভিসায় মাহরাম হিসেবে তার স্বামীর নাম কেন লেখা নেই? তাছাড়া হজ যাত্রার তিন মাস আগে (১৯ মে ২০১৬ তারিখ) যখন হজ যাত্রীদের প্রাক নিবন্ধন করা হয় তখন নিবন্ধনে মাহরাম (বৈধ অভিভাবক) হিসেবে তার স্বামীর নাম উল্লেখ না করে ঈমাম জাহিদুলের নাম কে দিয়েছিলো।
যদি বিষয়টি শুধুই ট্রাভেল এজেন্সীর কারসাজী হয়ে থাকে তবে সেখানে অন্য কারও নাম না এসে ঈমাম জাহিদুল ইসলামের নাম এল কিভাবে। তাছাড়া প্রাক নিবন্ধনের আগে আগে মাহরাম হওয়ার জন্যে লামারাস এভিয়েশনের স্বত্বাধিকারী মো. সেলিম এবং ঈমাম জাহিদুল তাদের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন কেন।রিফাত আরা মুকুলের স্বামী আনোয়ার হোসেন মাষ্টার বলেন, বিমান বন্দরে (৬ আগষ্ট ২০১৬) ইমিগ্রেশনাল পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সময় ঈমাম জাহিদুল ইসলাম কেন ভুক্তভোগী তার স্ত্রী রিফাত আরা মুকুলকে কেন খালা হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। আনোয়ার হোসেন মাষ্টার আরও বলেন, স্বামী-স্ত্রী একত্রে হজে যাবেন বলে ট্রাভেল এজেন্সীর দাবিকৃত টাকা পয়সা এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঠিক সময়ে জমা দিয়েছিলেন তারা। অথচ তাকে তার স্ত্রীর সাথে না দিয়ে গাইড ভিসায় হজ্বে পাঠানো হয়। যা ঈমাম জাহিদুল এবং লামারাস এভিয়েশনের সত্বাধিকারী মো. সেলিমের সুস্পষ্ট প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আনোয়ার হোসেন মাষ্টার আরও বলেন, তার স্ত্রী রিফাত আরা মুকুল আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। তর বাম হাত অনেকটাই অচল। নিজের কাপড় নিজে পড়তে কষ্ট হয় তাঁর। এমন পরিস্থিতিতে আকষ্মিকভাবে স্বামীছাড়া অজানা অচেনা পথে একাকী ফ্লাইটে হজে যাওয়া এবং ওমরা হজ পালন করা ছিলো চরম ভোগান্তির বিষয়।
আনোয়ার হোসেন মাষ্টার আরও বলেন, ‘ প্রত্যেক স্বচ্ছল মুসলমানের জন্যে জীবনে এক বার মাত্র হজ্ব ফরজ। কিন্তু প্রতিবছরই কেন হজ্বে যান ঈমাম জাহিদুল।’
তাছাড়া ঈমাম জাহিদুল যখন যেখানে মাহফিল করেন সেখানে কেনই বা লামারাস ট্রাভেল এজেন্সীর বিজ্ঞাপন টানানো থাকে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেলেই ঈমাম জাহিদুলের প্রতরাণার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত হবে।
ঈমাম জাহিদুলের এ প্রতারণার বিচার চেয়ে আনোয়ার দম্পতি বলেন, একজন মুফতি, একজন পেশ ঈমাম, যার পিছনে প্রতিদিন শতশত মানুষ নামাজ পড়েন, যাকে অনুসরণ করে ইসলামের পথে এগুবে মানুষ, ধর্মের নামে তার এ প্রতারণামূলক কর্মকান্ডের অবশ্যই বিচার চান তারা।