বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৩:১৪ অপরাহ্ণ, ০৫ জুন ২০১৭
বরগুনায় স্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগে মাসুম বিল্লাহ নামের এক ভুয়া ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দীর্ঘদিন ধরে ধরে মাসুম বিল্লাহ নিজেকে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বলে পরিচয় দিয়ে বরগুনা শহরে প্রতারণার মাধ্যমে চিকিৎসা বাণিজ্য চালিয়ে আসছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে। গত এক বছর ধরে বরগুনা শহরের একটি ভাড়া বাসায় তালাবন্দি রেখে গোপনে নিজের স্ত্রীকে নির্মম নির্যাতন করে আসছিলেন তিনি। রোববার বিকেলে বাড়ির মালিক পক্ষের তথ্যের ভিত্তিতে বরগুনার বাজার সড়কের পাঁচ তলা ভবন ‘গোলাপ প্লাজা’র একটি ফ্ল্যাট থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে বরগুনা থানার পুলিশ।
নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ কানিজ ফাতিমা সোনিয়া (২২) জানান, দীর্ঘ এক বছর ধরে তাকে একটি ফ্ল্যাটে তালাবদ্ধ রেখে নির্মম নির্যাতন করে আসছিলো মাসুম বিল্লাহ। তিনি আরও বলেন, নিজেকে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে আজ থেকে ১৪ মাস আগে ফুসলিয়ে তাকে বিয়ে করেন মাসুম। বিয়ের পরে তিনি জানতে পারেন যে, শিশু বিশেষজ্ঞ তো দূরের কথা মাসুম বিল্লাহ কোন ডাক্তারই নন। কিছুদিন আগেও বরগুনার একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মো. আলমগীর হোসেনের চেম্বারে ফুট ফরমাসের কাজ করতেন মাসুম বিল্লাহ।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কানিজ ফাতিমা সোনিয়া বলেন, এর আগে তিনি বিবাহিতা ছিলেন। তার স্বামী বিদেশ থাকতেন। তার একটি শিশু পুত্র রয়েছে। বছর দেড়েক আগে তার সাথে মাসুম বিল্লাহর পরিচয় হয়। সেই থেকে নিজেকে একজন বড় মাপের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিচয় দিয়ে মুঠোফোনে তাকে বিভিন্ন সময়ে প্রেমের প্রস্তাব দিতে থাকেন মাসুম। এক পর্যায়ে ২০১৬ সালের ৫ মার্চ তাকে ব্লাক মেইল করে বিয়ে করেন মাসুম বিল্লাহ।
বিয়ের পর থেকেই মাসুম বিল্লাহ তাকে যৌতুকের জন্যে শারীরিকভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন করতে থাকে। এরপর ছ’মাস ১০দিন পরে ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কানিজ ফাতিমা সোনিয়াকে তালাক দেন মাসুম বিল্লাহ।
নির্যাতিত সোনিয়া আরও জানান- তাকে তালাক দেয়ার পরপরই সব কিছু গোপন রেখে মাসুম বিল্লাহ বরগুনার পাতাকাটা এলাকায় তার আপন এক মামাত বোনকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পর সেই মামাত বোনকেও তালাক দেন মাসুম বিল্লাহ।
এসময় সোনিয়া পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় তার খালু বাড়ি অবস্থান করেন। এরপর পূনরায় সেই খালু বাড়ি গিয়ে খালা খালুর হাতে পায়ে ধরে কানিজ ফাতিমা সোনিয়াকে বরগুনায় নিয়ে আসেন মাসুম বিল্লাহ। এরপর আবারও বাসায় স্থানীয় একজন কাজি শহিদুল ইসলামকে ডেকে জোরপূর্বক তার স্বাক্ষর নেন মাসুম। কিন্তু বিয়ের রেজিস্ট্রেশন, কাবিন নামা এমনকি তালাকের কোন কাগজপত্র তাকে কাজি দেয়নি বলে জানান সোনিয়া। সোনিয়া আরও জানান, বিয়ের পরে এক পর্যায়ে তিনি সন্তান সম্ভবা হলে জোরপূর্বক তাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে গর্ভপাত করান মাসুম। এ ঘটনার পরে তিনি অনেক দিন অসুস্থ ছিলেন বলে জানান সোনিয়া।
বরগুনা শহরের বাজার সড়কে গোলাপ প্লাজার মালিক আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী সামসুন্নাহার (৫০) জানান, গত এক বছর ধরে তাদের ভবনের পাঁচ তলার একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রী কানিজ ফাতিমা সোনিয়াকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন মাসুম বিল্লাহ। প্রায় প্রতিদিনই মাসুম বিল্লাহ তার স্ত্রী সোনিয়াকে শারীরিক নির্যাতন করে তালাবদ্ধ করে রেখে যেতেন। প্রথম দিকে বিষয়টি বুঝতে পারেননি তারা। রবিবার বিকেলে পূণরায় স্ত্রী সোনিয়াকে নির্মম নির্যাতন শুরু করলে তিনি পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে মাসুম বিল্লাহকে গেপ্তার করে নিয়ে যায়।
এদিকে গ্রাম ডাক্তার সমিতির সভাপতি গ্রাম ডাক্তার এম এ মোতালেব জানান- মাসুম বিল্লাহ বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের খাকবুনিয়া গ্রামের একিন আলী পহলানের ছেলে। নিজেকে ডিএমএফ এবং ডিএমসিএইচ পাশ একজন ডাক্তার বলে পরিচয় দিয়ে বরগুনা শহরে ডাক্তারী করে আসছে সে। অথচ তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, তিনি কোন বিষয়েই ডাক্তারি পড়াশোনা করেন নি।
কোন সার্টিফিকেট যদি মাসুম বিল্লাহ যোগাড় করেও থাকেন তা বানোয়াট ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, বছর কয়েক আগেও বরগুনার শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আলমগীর হোসেনের চেম্বারের একজন পিওন ছিলেন মাসুম বিল্লাহ। এ কারণে তাকে গ্রাম ডাক্তার সমিতির সদস্যও করা হয়নি।
বরগুনার গ্রাম ডাক্তার সমিতির সাধারণ সম্পাদক গ্রাম ডাক্তার আনোয়ার হোসেন শিমুল জানান, ভুল চিকিৎসায় এক দরিদ্র নারীর মৃত্যুর অভিযোগে মাসুম বিল্লাহর বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলা রয়েছে। তিনি আরও জানান, এর আগে মাসুম বিল্লাহ তার চেম্বারে কর্মরত একজন দরিদ্র নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। পরে টাকা পয়সা দিয়ে সে ঘটনাকে ধামাচাপা দেন মাসুম বিল্লাহ।
মাসুম বিল্লাহর গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের খাকবুনিয়া গ্রামের ৫ নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ মোঃ জালাল আহমেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাসুম বিল্লাহর ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে স্থানীয় অধিবাসী শাহিন খানের স্ত্রী ফরিদা বেগমের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মাসুম বিল্লাহর বিরুদ্ধে সে সময় বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছিলো বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদুজ্জামান বলেন- নির্যাতনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে নির্যাতিত স্ত্রীকে উদ্ধারের পর অভিযুক্ত মাসুম বিল্লাহকে গ্রেপ্তার করে বরগুনা থানার পুলিশ। এ বিষয়ে নির্যাতিত গৃহবধু কানিজ ফাতিমা সোনিয়া বাদী হয়ে রোববার রাতেই বরগুনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।’’