সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প বরিশালবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ২০১৯ সালের মধ্যে এটি চালুর টার্গেট রয়েছে। প্রকল্পের নদীশাসন কার্যক্রম চলমান রাখতে অতিরিক্ত ১১৬২.৬৭ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে দরকার আরও ১৪০০ কোটি টাকা। অন্যথায় প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না বলে পরিকল্পনা কমিশনকে জানিয়েছে সেতু বিভাগ। সেখানে বলা হয়- ‘অতিরিক্ত জমির অনুমোদন এখনো না পাওয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ প্যাকেজ নদীশাসন কাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম’। শুক্রবার এ সংক্রান্ত চিঠি দেখা গেছে পরিকল্পনা কমিশনে।
এদিকে প্রকল্পের নদীশাসন কাজ ব্যাহত হচ্ছে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের অভাবে। ড্রেজিং ডিসপোজালের জন্য অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ ও বরাদ্দের অনুমোদন এখনো না পাওয়ার যুক্তি দেখানো হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে।
প্রকল্পকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপিতে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ১৫৩০.৫৪ হেক্টর। কিন্তু দেরিতে কাজ শুরুর কারণে নদীর গতি-প্রকৃতি পাল্টে যায়। ফলে দেখা দেয় অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। তাই ১১ অক্টোবর পাঠানো ওই প্রস্তাবের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে চিঠি দেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি প্রতিনিধি দল। তবে তাদের সুপারিশে অতিরিক্ত ৯৩৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
অবশ্য আইএমইডির সাম্প্রতিক এই সুপারিশের সঙ্গে একমত না হয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রস্তাবিত জমির পরিমাণ কমানোর সুযোগ নেই। শুধু তা-ই নয়, ডিপিপি সংশোধন সময়সাপেক্ষ হওয়ায় জমির অধিগ্রহণজনিত ব্যয় বৃদ্ধির আগাম অনুমতি দিতে বলা হয়েছে। তবে এ নিয়ে সেতু বিভাগ ও প্রকল্প কর্মকর্তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের কাছে সেতু বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, পদ্মা সেতুর অনুমোদিত ডিপিপি ব্যয়ের (২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা) সঙ্গে অতিরিক্ত ১৪০০ কোটি টাকা যোগ করা হলে মোট প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ হবে ৪.৮৬ শতাংশ। অতিরিক্ত জমির জন্য এ মেগা প্রকল্পটির ডিপিপি এ পর্যায়ে সংশোধন সময়সাপেক্ষ। তাই পূর্বানুমতি দিতে বলা হয়। সেক্ষেত্রে পরিপত্রের নির্দেশনা বিবেচনায় নিতে অনুরোধ করেছে সেতু বিভাগ।
সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি সংক্রান্ত পরিপত্রের ১৬.১৯ নং অনুচ্ছেদে বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য সীমিত আকারে (মোট প্রকল্প ব্যয়ের অনূর্ধ্ব ৫ শতাংশ) অনুমোদিত অঙ্গের ব্যয়/পরিমাণের কোনো পরিবর্তন জরুরি প্রয়োজন হলে এবং প্রকল্প সংশোধন সময়সাপেক্ষ হলে পরিকল্পনা কমিশনের পূর্ব অনুমোদন গ্রহণপূর্বক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে।
সূত্রমতে, ২০১১ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। এর দেখাদেখি অন্য দাতা সংস্থাগুলো সরে যায়। এরপর নানা ঘটনা শেষে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের পথে হাঁটে সরকার। বিলম্বজনিত কারণে বাড়তে থাকে প্রকল্প ব্যয়। এই সময়ে পরিবর্তন আসে নদীর গতি-প্রকৃতিতেও। ফলে দেখা দেয় নতুন করে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। তা ছাড়া বিলম্বজনিত কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দাবির শঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটিতে এ পর্যন্ত দুই দফা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবে অনুমোদন মিললে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াবে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে পাঠানো এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছেÑ প্রকল্পের ডিটেইল ডিজাইন হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। নদীশাসন কাজের চুক্তিতে ৬ কোটি ঘনমিটার বা ২১২ কোটি ঘনফুট ড্রেজিং স্পয়েল ডিসপোজাল করার কথা রয়েছে। এজন্য প্রকল্পের ডিজাইনে জাজিরা প্রান্তের মূল সেতুর উজান ও ভাটির ডুবোচর এলাকায় কিছু স্থান নির্ধারণ করা ছিল। এরপর ডিপিপির দ্বিতীয় সংশোধনী হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে।
চিহ্নিত স্থানগুলো তখনো ডুবোচর এবং সেখানে কোনো চাষাবাদ বা জনবসতি ছিল না। নির্ধারিত সময়ে ড্রেজিং কাজ শুরু না হওয়ায় ২য় সংশোধনীতে আলাদাভাবে জমি অধিগ্রহণ/হুকুমদখলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। দাতাসংস্থাগুলো ঋণচুক্তি স্থগিত করায় এতদিনে ডিজাইন পর্যায় থেকে বাস্তবায়ন পর্যায় পর্যন্ত সময়ে নদীর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মূল ডিজাইনে চিহ্নিত স্থানগুলো ভরাট হয়ে যায়। জমির মালিকরা ভরাট জমিতে বসতি স্থাপন এবং চাষাবাদ শুরু করে। তাই নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
প্রকল্প কর্তারা আরও উল্লেখ করেন, ড্রেজিং স্পয়েল ডিসপোজাল করা যাচ্ছে না অধিগ্রহণকৃত জমির অভাবে। আবার ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ড্রেজিং স্পয়েল ডিজপোজাল করলে স্থানীয়দের বাধা আসছে।
এ বাস্তবতায় বিলম্বের কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ক্লেইম (ক্ষতিপূরণ চাওয়া) করা নিয়েও চিন্তায় রয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। নির্ধারিত সময়ে জমির দখল হস্তান্তর করা সম্ভব না হলে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ পাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে প্রকল্প তথা সরকারের বড় আর্থিক ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে ডুবোচর জেগে ওঠার পর জমি পয়স্তি হয়েছে।
ড্রেজিং স্পয়েল ডিজপোজালের জন্য মাদারীপুরের শিবচরে এবং মূল নদীশাসন কাজে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে জমির প্রস্তাব করা হয়েছে। লৌহজংয়ের জমির ব্যাপারে বলা হয়েছে- মাওয়া প্রান্তে নদীশাসন কাজের উজানের শেষ সীমানায় নদীভাঙনের ফলে আগে অধিগ্রহণকৃত জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় নতুন করে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো জমি সিকস্তি হলে জেলা প্রশাসন এডি লাইন টেনে জমির খাজনা বন্ধ রাখা হয়। ওই জমি ৩০ বছরের মধ্যে পয়স্তি না হলে তার মালিকানা সরকারের অনুকূলে ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। ৩০ বছরের মধ্যে জমি পয়স্তি হলে জমির মালিকানা জমির রেকর্ড অনুযায়ী বর্তাবে।
আর চরের জমির মালিকানা নির্ধারণের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত। সব দিক বিবেচনায় রেখে দ্রুত অতিরিক্ত জমির অনুমোদন দিতে পরিকল্পনা কমিশনকে তাগিদ দিয়েছে সেতু বিভাগ।”
সৌজন্য: আমাদের সময়
শিরোনামবরিশালের খবর