বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১০:৩১ অপরাহ্ণ, ২৪ মে ২০১৬
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডবের ক্ষত ক্রমেই বের হয়ে আসছে। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেঙে পড়া সড়ক ও কালভার্ট দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন আছে বেশ কিছু এলাকা। বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসল, মাছের ঘের ভেসে গেছে। অনেক এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলো আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়লেও জলাবদ্ধতা আর বিধ্বস্ত বাড়িঘর ঠিক করতে না পারায় স্বজনদের আশ্রয়ে দিন কাটাচ্ছে। বেড়িবাঁধ বিলীন হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে চরম ভোগান্তির আশঙ্কা করছে তারা। এখনো বিদ্যুত্হীন অবস্থায় আছে অন্তত ১২টি উপজেলা। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে যাওয়ায় কবে অন্ধকার দূর হবে, তাও কেউ বলতে পারছে না।
ঝড় উপকূলীয় আট জেলায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করার কাজ শুরু হলেও ত্রাণ দেওয়ার নাম নেই। জনপ্রতিনিধিরাও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াননি। ত্রাণ না পেয়ে বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার করছে ক্ষতিগ্রস্তরা।
ঘের ভেসে, ফসল তালিয়ে, দোকানপাট বিধ্বস্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবেও পঙ্গু হয়ে গেছে অনেক পরিবার। এর আগের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে অনেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আবার তাদের কোমড় ভেঙে দিল।
পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বেশ কিছু এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার চেয়েও মানুষ এলাকার রক্ষাবাঁধ, সড়কসহ অবকাঠামোর ক্ষতিতে বেশি চিন্তিত। তারা বলছে, যেসব বাঁধ তাদের এলাকা রক্ষা করে আশ্রয় নিশ্চিত করত, তা বিপন্ন হলে তাদের আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না।
ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান আর মানুষের দুুর্ভোগের সার্বিক চিত্র জানাচ্ছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা।
চট্টগ্রাম : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর থাবায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম সহসাই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। বঙ্গোপসাগরের তীরে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এলাকার মানুষ সাগরের জোয়ারে ভাসছে, ভাটায় জেগে উঠছে। পাশাপাশি গাছপালা বিধ্বস্ত, সড়ক ভেঙে যাওয়া এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু না হওয়া, প্রত্যন্ত গ্রামে এখনো সড়ক যোগাযোগ চালু না হওয়া এবং পানীয় জলের সংকটে পড়ে দুর্গতদের নাভিশ্বাস উঠেছে।
গতকাল সোমবার চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা, বাঁশখালী এবং নগরের পতেঙ্গা জেলেপাড়া এলাকায় দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
নগরের পতেঙ্গা জেলেপাড়ার বাসিন্দা সুদীপ জলদাসের ঘর ভেসে গেছে পানির তোড়ে। সেই থেকেই তিনি পরিবারের চার সদস্য নিয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও কুঁড়েঘর যাওয়ার কারণে তাঁর খুব একটা আক্ষেপ নেই। তিনি বলেন, ‘গেছে তো কুঁড়েঘর। এখন আবার কয়টি খুঁটি এবং পাঁচ-ছয়টি টিন পেলেই নতুন করে বেঁধে নেব।’ তাঁর কণ্ঠে ভরসা শোনা গেলেও স্ত্রীর কণ্ঠে শোনা গেল আক্ষেপ। তিনি স্বামীকে কিছুটা কটাক্ষ করে করলেন, ‘হ, কয়টা খুঁটি আর টিন পেলে ঘর হবে, কৈ পাবে খুঁটি-টিন?’ স্ত্রীর কথায় কান না দিয়ে সাগরের জীবনযোদ্ধা সুদীপ পুনরায় বলেন, ‘এই রকম কত ঝড় যাচ্ছে, তাতে কী?’
পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের ব্যবসায়ী আবদুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পাওয়ার পরপরই দোকানের মাল সরিয়ে নিয়েছিলাম। আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দোকান রক্ষা হয়নি। ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এখন নতুন করে দোকান তৈরি করতে হবে। কিন্তু নতুন দোকান তৈরির মতো পুঁজি এই মুহূর্তে হাতে নেই। তাঁর পাশের দোকানদার পলাশ বিশ্বাস বলেন, ‘ঝিনুক বেঁচে সংসার চলত। এখন দোকান কিভাবে বাঁধব, সেই চিন্তা করছি।’
পতেঙ্গা জেলেপাড়াসহ আশপাশের বেড়িবাঁধ এলাকায় দেখা গেছে, শহর রক্ষা বাঁধ বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকটি স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড মেরামতের কাজও করছে। কিন্তু এই বাঁধটি এখন আর চট্টগ্রাম শহরকে রক্ষা করতে পারছে না। সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাঁধও যেন অকেজো হয়ে যাচ্ছে। যদিও বাঁধের কিছু অংশে বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা নূরুল আনোয়ার দুর্ভোগ-দশার বর্ণনা দিয়ে বলেন, উপজেলার রায়পুর, মালিপাড়া, বার আউলিয়া, ঘাটকুল, তেলিপাড়া, পার্কি সৈকত, গহিরা, সরেঙ্গা, জুঁইদণ্ডী এলাকায় বঙ্গোপসাগরের বেড়িবাঁধ ভেঙেছে। ফলে এখানে জোয়ারের পানি গ্রামে প্রবেশ করছে এবং গ্রামের মানুষ ভাসছে। তিনি বলেন, সাগরের লবণাক্ত পানির কারণে ব্যবহারযোগ্য পানি এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
আনোয়ারার স্থানীয় সাংবাদিক নূরুল ইসলাম দুর্গতদের বর্ণনা দিয়ে বলেন, দুর্গত মানুষ এখন পানীয় জলের সংকটে আছে। সরকারি বা কোনো ত্রাণ এখনো দুর্গম-দুর্গত অঞ্চলে পৌঁছেনি। ফলে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেক মানুষ না খেয়ে আছে। তাদের ঘর ভেঙে যাওয়ার কারণে খাবারও নষ্ট হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় দুর্গত মানুষের আহাজারি বাড়ছে।
জেলা প্রশাসনের তৈরীকৃত তালিকা অনুযায়ী, ৮৩ হাজার ৬৬০টি পরিবারের চার লাখ ৮৩ হাজার ৮৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৪৬ হাজার ৬৫৮টি ঘর সম্পূর্ণ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুই হাজার ৬৮৬ একর ফসলি জমির ফসল, ৮০টি গবাদি পশু এবং ৪০ হাজার ৫৫০টি হাঁস-মুরগির মারা গেছে। এ ছাড়া ৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়ক ভেঙেছে ১৯১ কিলোমিটার। আর ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ এবং ৬৬ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বেড়িবাঁধ কবে নাগাদ মেরামত করা হবে—জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ড-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার তাহের সোমবার রাতে বলেন, সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান বেড়িবাঁধগুলোতে খুব বেশি সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আগামীতে অন্তত ১৫ ফুট উঁচু করে বেড়িবাঁধ তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, ভেঙে যাওয়ার বেড়িবাঁধের অংশ দিয়ে যাতে জোয়ার-ভাটার পানি জনপদে প্রবেশ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা হবে। পরবর্তীতে শুষ্ক মৌসুমে স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে।’
নোয়াখালী : রোয়ানুর আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নও বিধ্বস্ত হয়েছে। পূর্ণিমার জোয়ারের পাশাপাশি রোয়ানুর ছোবলে পাঁচ থেকে ছয় ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, জাহাজমারা, নলচিরা, চরঈশ্বর, সুখচর, সোনাদিয়া ও তমরুদ্দিন ইউনিয়নের বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে যায়। এতে ওই সব ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। পানি ধীরে নামতে শুরু করলেও জলাবদ্ধতায় সেখানে গৃহহারা মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে। রোয়ানুর হাত থেকে বাঁচতে যারা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা কেন্দ্র ছাড়লেও বাড়িঘরে উঠতে পারেনি অনেকে। যাদের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে তারা বেড়িবাঁধের পাশে, আবার কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সবার দাবি, ত্রাণসামগ্রী নয়, অবিলম্বে ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামত করে দেওয়ার। পানি জমে থাকায় রবিশস্য ও আউশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জলোচ্ছ্বাস ও ঝোড়ো বাতাসে হাতিয়ার প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে ৫০টি গ্রাম সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়। সেখানে এখনো নিম্নাঞ্চলের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছে। রোয়ানুর আঘাতে ঝোড়ো বাতাস ও প্রবল জোয়ারে বেড়িবাঁধের বাইরে সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এ ছাড়া জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বেড়িবাঁধ ভেঙে সেখানেও ১০ হাজার মানুষ জলাবদ্ধতায় এখন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
চরঈশ্বর গ্রামের বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা ভূমিহীন নুর হোসেন জানান, ঝড়ের আঘাতে সব হারিয়ে তিনি উঠেছেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। বেড়িবাঁধ ভেঙে সব ডুবে যাওয়ায় তিনি চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।
হাতিয়ার তমরুদ্দিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ফারুখ জানান, রোয়ানুর প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে তাঁর এলাকাসহ পুরো হাতিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুরনো বেড়িবাঁধ সংস্কার না করায় এবং নূতন বেড়িবাঁধ তৈরির আগেই জলোচ্ছ্বাসে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, রোয়ানুতে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তিন কোটি ৯৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা প্রাথমিক তথ্য দিয়েছে।
নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, মূলত পুরনো বেড়িবাঁধের পাশাপাশি নতুন কিছু বেড়িবাঁধ জোয়ারের তোড়ে ভেঙে যাওয়ায় অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে আছে। সেখানকার মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। তিনি আরো জানান, হাতিয়ায় যে ৯ কিলোমিটার নতুন বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা ছিল, ৩০ মের মধ্যে ঠিকাদারদের কাজ শেষে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল; ইতিমধ্যে বাঁধের কাজ প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেই বেড়িবাঁধের বেশির ভাগই জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। কোথাও কোথাও বাঁধ সমতলভূমিতে পরিণত হয়। বিধ্বস্ত এই বেড়িবাঁধ আবার মেরামত না করলে চলতি দুর্যোগ মৌসুমে আরো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। তবে প্রায় চার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছেন।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসান মো. মাইনুদ্দিন জানান, তাঁরা প্রাথমিকভাবে একটি ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করেছেন। এতে প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়, সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে সহস্রাধিক ঘরবাড়ি, অর্ধবিধ্বস্ত ৯ হাজার ঘরবাড়ি। এ ছাড়া ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জলাবদ্ধতায় এখন নাকাল অবস্থা মানুষের। তবে তিনি বলেন, পানি নামছে ধীরে, এ জন্য দুর্ভোগ আছে। দুই-এক দিনের মধ্যে সমস্যা আর থাকবে না বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ভোলা : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে ভোলা সদর, বোরহানউদ্দিন, দৌলতখান ও তজুমদ্দিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ঝড়ের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তজুমদ্দিন। এ উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের শশীগঞ্জ গ্রাম ও উপজেলা সদরের বাজার লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এতে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছে। তবে প্রশাসন এখনো পুরো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে পারেনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ভোলার নির্বাহী প্রকৌশলী বাবুল আক্তার গতকাল সোমবার দুপুরে জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে ভোলায় পাউবোর প্রায় ৬৫০ মিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাড়ে আট কিলোমিটার রাস্তা ভেঙে গেছে। এ ছাড়া দুই কিলোমিটার ক্লোজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় পাঁচ কোটি ২৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তজুমদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, শনিবার রাত ৩টার দিকে টর্নেডোর আঘাতে বাজারের তিন শতাধিক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে তাঁদের প্রায় ৫০ কোটি টাকার মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন। উপজেলার দক্ষিণে বেড়িবাঁধ না থাকায় ওই বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ভেতরে ঢুকে প্রায় ২৬ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তা আমির হোসেন। তিনি আরো জানান, ঝড়ে ৮৫টি মাছ ধরার ট্রলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১৭ লাখ টাকা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, রোয়ানুর প্রভাবে ভোলা জেলায় চার হাজার ৩৫৯টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এর মধ্যে মনপুরা উপজেলায় আড়াই হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়া ৩৪৪টি ট্রলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ১৭ কোটি ২২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারের আটটি উপজেলার ৩১টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ হাজার ঘরবাড়ি। এ কারণে গৃহহারা হয়ে পড়েছে ২৮ হাজার ৭২৫ জন। সেই সঙ্গে ১৬ হাজার ঘরবাড়ি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ে এ পর্যন্ত কক্সবাজারে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচজনে। তাঁদের মধ্যে কুতুবদিয়া দ্বীপে চারজন ও মহেশখালী দ্বীপে একজন।
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে কুতুবদিয়া ও মহেশখালী। কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালেহী তানভীর গাজী জানান, প্রাথমিক তথ্যে দ্বীপের ছয়টি ইউনিয়নে কমপক্ষে ছয় হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো চার হাজার ঘরবাড়ি। দ্বীপের বাসিন্দারা জানায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে পড়েছিল। সেই বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মিত না হওয়ায় সাগরের জোয়ারের পানিতে প্রতিনিয়ত সয়লাব হচ্ছে দ্বীপের নিম্নাঞ্চল।
ঘূর্ণিঝড়ের পর কুতুবদিয়া দ্বীপের বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করে এসে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা গতকাল বলেন, ‘দ্বীপের সাগরপারের ইউনিয়ন আলী আকবর ডেইল বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। শত শত ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে লোকজন খোলা আকাশের নিচেই অবস্থান করছে। নিজের চোখে না দেখলে এ রকম ভয়াল অবস্থার বিবরণ দেওয়াও মুশকিল।’ তিনি আরো বলেন, কুতুবদিয়া দ্বীপের বাসিন্দাদের বাঁচানোর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণে হাত দেওয়া।
মহেশখালী দ্বীপের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন হচ্ছে মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা। ঝড়ে দ্বীপে কমপক্ষে চার হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি। মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম জানান, যদিও দ্বীপের পাঁচটি ইউনিয়ন কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তবে ধলঘাটা-মাতারবাড়ী জলোচ্ছ্বাসের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এখানকার ক্ষতির পরিমাণই বেশি। ধলঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধলঘাটার তিন হাজার ঘরবাড়ির অর্ধেকই সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। কমপক্ষে ১০ হাজার লোক বর্তমানে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে।’
ধলঘাটার বাসিন্দা সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এম ওসমান গনি, কক্সবাজার জেলা যুবলীগ নেতা কামাল উদ্দিন ও কায়সারুল ইসলাম রবিবার কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ধলঘাটা ইউনিয়নের ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জলোচ্ছ্বাসের থাবায় বিলীন হয়ে গেছে। এ কারণে সাগরপারের এই ইউনিয়ন অরক্ষিত হয়ে পড়ায় জোয়ার-ভাটার সঙ্গে একাকার হয়ে পড়েছে। তাঁরা জানান, দ্বীপের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর পড়ালেখাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য। এলাকার ৩০ হাজার লোক মূলত চিংড়ি ও লবণ চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় কমপক্ষে তিন হাজার একর ঘেরে চিংড়ি চাষও অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছে।
মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদুল্লাহ বলেন, ‘শনিবারের জলোচ্ছ্বাসের পরও এখনো প্রতিদিনের জোয়ারের পানিতে ডুবছে মাতারবাড়ীর বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা। এসব এলাকা সাগরের পানিতে ডুবে রয়েছে। এ কারণে গৃহহারা লোকজন এখনো নতুন করে জীবন গড়ার কাজও করতে পারছে না।’ মাতারবাড়ী এলাকার বাসিন্দা আবু সালেক জানান, গৃহহারা লোকজন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে গিয়ে এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। যাদের ভিটা উঁচুতে তারাই নতুন করে ঘর করার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু নিচু এলাকার লোকজন অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। তিনি বলেন, জলোচ্ছ্বাসের পানিতে মহেশখালী দ্বীপের নলবিলা-মাতারবাড়ীর একমাত্র সড়কটি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে এই সড়ক মেরামত করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
ঝালকাঠি : ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদীতীরবর্তী ২৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধটি ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতবিক্ষত হয়। প্রায় ৯ বছর পার হলেও বাঁধটি সংস্কার করা হয়নি। স্থানীয়রা বাঁধটি কোনো রকমের সংস্কার করে নদীতীরে বসবাস করছিল। আশপাশে ফসলও ফলাত তারা। টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে বেড়িবাঁধের মাটি নরম হয়ে যায়। সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া ও জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যায় বেড়িবাঁধের ৩০০ মিটার এলাকা। মুহূর্তের মধ্যে পানি প্রবেশ করে নদীতীরবর্তী প্রায় ২০টি গ্রামে। তলিয়ে যায় ফসলের মাঠ ও বসতঘর। বিষখালী নদীর তীরবর্তী কাঁঠালিয়ার পাঁচটি ইউনিয়নের দুই শতাধিক পরিবার এখনো পানিবন্দি রয়েছে। এখানকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তথ্যানুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে বেড়িবাঁধ ভেঙে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁঠালিয়া সদর ইউনিয়নের লঞ্চঘাট এলাকা, বড় কাঁঠালিয়া, মশাবুনিয়া, জয়খালী ও চিংড়াখালী গ্রাম, শৌলজালিয়া ইউনিয়নের রগুয়ার চর, দড়ির চর, তালগাছিয়া, আওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া ও উত্তর আওড়াবুনিয়া, চেঁচরিরামপুর ইউনিয়নের বানাই, দক্ষিণ চেঁচরিরামপুর ও মহিষকান্দি, পাটিখালঘাটা ইউনিয়নের জোরখালী, নেয়ামতপুড়া ও তারাবুনিয়া এবং আমুয়া ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ডাকবাংলো ও আমুয়া ফেরিঘাট এলাকা।
এ ছাড়া পানিতে ভেসে গেছে শতাধিক ঘেরের মাছ। উপজেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, পাটিখালঘাটা, শৌলজালিয়া ও আওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল নদীতীরবর্তী ৬১০ জন বাসিন্দা। পানিতে তাদের বসতঘর তলিয়ে যাওয়ায় এখনো বাড়ি ফিরতে পারছে না তারা।
বিষখালী নদীর তীরের বাসিন্দা কৃষক মানিক খান বলেন, ‘বেড়িবাঁধের অপেক্ষায় আমাগো ৪৫ বছর শ্যাষ অইয়্যা গ্যাছে। কবে সরকার আমাগো মুখের দিকে চাইবে জানি না। দুর্যোগের সময় পানিতে বাঁধ ভাইঙ্গা তলাইয়্যা যায় সব কিছু। চার দিন অইছে আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। এহনো বাড়ি যাইতে পারি নাই। পানিতে ঘর ও তিলক্ষেত তলাইয়্যা গ্যাছে।’
কাঁঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. শরীফ মুহম্মদ ফয়েজুল আলম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু মোকাবিলায় আমরা আগাম প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তাই এখানে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে বিষখালী নদীর তীরবর্তী ৩০০ মিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে পানি প্রবেশ করে পাঁচটি ইউনিয়নের ফসল ও অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুস সালাম বলেন, দীর্ঘদিন এ প্রকল্পের ফাইল মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আটকে ছিল। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে পানিসম্পদমন্ত্রী এ ব্যাপারে সংশিষ্ট সচিবকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানি।
পটুয়াখালী : জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীতে ৮৫৬টি কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। রাঙ্গাবালী ও কলাপাড়া উপজেলার ১৩টি বেরিবাঁধের মোট ৯ কিলোমিটার বিধস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে দুই হাজার ৩০২টি মাছের ঘের ও পুকুর। এ ছাড়া ১০৮টি কাঁকড়ার ঘের প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চাষি। টাকার অঙ্কে মাছ ও কাঁকড়াচাষিদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাত কোটি। জেলা মত্স্য অফিসার ড. মো. আবুল হাসানাত বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য দেওয়া হবে কি না এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেবে।’ এ ছাড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মরিচ, তিল, বাদাম, গ্রীষ্মকালীন সবজি, আউশের বীজতলা ও পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ক্ষয়ক্ষতির তালিকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর : জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেলা সদর, রামগতি, কমলনগর, রায়পুরে ঝড়ে তিন শতাধিক ছোট-বড় বিভিন্ন গাছ উপড়ে পড়েছে। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে ২০০ হেক্টর সবজি ও ৩০০ হেক্টর আউশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শনিবার ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে রামগতির চরআলগী, চরআব্দুল্লাহ, চরগাজী, চরজারিয়া ও মৌলভীর চর, কমলনগরের চরকালকিনি, চরফলকন, সদরের চররমণী মোহন ও রায়পুরের দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সোমবার অধিকাংশ গ্রামের পানি নেমে গেছে।
রায়পুর উপজেলার মেঘনা উপকূলীয় দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরুল মমিন জানান, ফসলের মাঠ থেকে পানি নামছে, তবে আরো দুই-এক দিন পানি জমে থাকলে আউশ ধানের পুরোপুরি ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বরিশাল : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রবল বর্ষণে মাঠের ফসল, পানবরজ, বীজতলা, সবজি ক্ষেত, পুকুর ও ঘেরের মাছ, গাছপালা, কাঁচা-পাকা সড়ক এবং ঘরবাড়িসহ বৈদ্যুতিক লাইনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারি হিসাব মতে জেলার ১০ উপজেলায় এ পর্যন্ত ২৩০ কিলোমিটার সড়ক ও আট শ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে রয়েছে।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের কট্রোল রুম সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বরিশাল জেলার ১০ উপজেলায় ২৮ হাজার পরিবার আক্রান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় আট শ কাঁচা ও আধা কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২৩০ কিলোমিটার কাঁচা ও আধা পাকা রাস্তার ও সাত কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের মধ্যে রয়েছে বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ও কাউয়ারচর এলাকার কীর্তনখোলা নদীর বাঁধ। এ ছাড়া কমবেশি ১০ উপজেলার বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা উপড়ে পড়েছে।
বাগেরহাট : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শরণখোলায় বলেশ্বর নদের তাফালবাড়ী এলাকায় বেড়িবাঁধের একাংশ ভেঙে গেছে। বাঁধের কোনো কোনো এলাকায় সিমেন্ট-বালি দিয়ে তৈরি করা ব্লক সরে গেছে। যেকোনো সময় বলেশ্বর নদের ঝুঁকিপূর্ণ ওই বাঁধ ভেঙে গ্রামে পানি ঢুকে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বিভাগ।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম মিয়া জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বৃষ্টি এবং নদ-নদীতে প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে বাগেরহাট সদর উপজেলা, শরণখোলা, চিতলমারী, মোরেলগঞ্জ এবং মোল্লাহাট উপজেলায় ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব বাঁধ দ্রুত মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রবিবার একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) : রোয়ানু তাণ্ডব চালিয়ে চলে গেলেও বাঁশখালী উপকূলের লাখো মানুষ এখনো সামুদ্রিক লোনা পানিতে বন্দি হয়ে পড়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছে জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত ৪২ হাজার পরিবার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত দেখানো হয়েছে খানখানাবাদ, ছনুয়া ও গণ্ডামারা ইউনিয়নকে। এ ছাড়া বাঁশখালীর ১৪ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার সব জায়গায় কমবেশি ক্ষতি দেখানো হয়েছে। রোয়ানুর আঘাতে শুক্রবার রাত থেকে বাঁশখালীর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রবিবার রাতে উপজেলা সদরের অল্প কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব হলেও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তারের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় পুরো বাঁশখালীতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
গতকাল সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জ্বল হোসেন চৌধুরী, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে প্রেমাশিয়া গ্রাম পরিদর্শন করেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য-সহযোগিতা ও শিগগিরই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের প্রেমাশিয়া, কদম রসুল, খানখানাবাদ, ছনুয়া ইউনিয়নের খুদুকখালী, ছেমটখালী, ছোটছনুয়া ও গণ্ডামারা ইউনিয়নের গণ্ডামারা ও বড়ঘোনাসহ বিভিন্ন গ্রামে বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট। খাদ্যাভাবে পানিবন্দি পরিবারগুলোতে দুর্ভোগের অন্ত নেই। বাড়ির আঙিনায় কথা হয় ছোটছনুয়া এলাকার মহিবুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব এলাকার পুকুর ও নলকূপ ডুবে রয়েছে। কোটি কোটি টাকার মাছ ও লবণ মাঠের লবণ ভেসে গেছে। রাস্তাঘাট ভেঙে চৌচির। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে রাস্তার ইট ও মাটি। কোথাও কোথাও কালভার্টও। বসতভিটা ও ঘর-বাড়িতে পলিমাটি জমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে।
সরকারি তথ্যে জানা গেছে, বাঁশখালী উপকূলে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস ও দমকা হাওয়ায় কৃষি, মত্স্য, লবণ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে উপকূলের দুই লাখ ৫০ হাজার বাসিন্দার ৪২ হাজার পরিবার কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১০ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, ১২ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত, ২০ হাজার পরিবার অন্যান্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, পানির স্রোতে সাত কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ এবং ১৫ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত, পাকা রাস্তা ২০ কিলোমিটার, কাঁচা রাস্তা ১৫০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত, লবণের ক্ষতি চার হাজার একর, মত্স্য দুই হাজার একর ও কৃষি খাতে ছয় হাজার একর জমির, গভীর নলকূপ ২৫০টি।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ও পূর্ণিমার প্রভাবে উত্তাল নদ-নদীর পানির চাপে উপজেলার চম্পাপুর, মহিপুর, লালুয়া এবং ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত হওয়া বাঁধগুলো হচ্ছে চম্পাপুর ইউনিয়নের দেবপুর পয়েন্ট, মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর পয়েন্ট, লালুয়া ইউনিয়নের চারিপাড়া ও মুন্সিপাড়া পয়েন্ট, ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের রমজানপুর গ্রাম পয়েন্ট। এ ছাড়া নীলগঞ্জ ইউনিয়নের উমেদপুর, নিজকাটা, দৌলতপুরে স্লুইসগেট ভেঙে গেছে। উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪০০ পুকুর ও ঘের জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মত্স্যচাষিরা।