বরিশাল: ঘোষিত অভয়াশ্রমের বাইরে বিভিন্ন শাখা নদীতেও বিচরণ করছে ইলিশ। সুরক্ষার অভাবে প্রজনন মৌসুমেও এসব বিচরণক্ষেত্রে জাল ফেলছেন জেলে। নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা থাকলেও বিতরণে রয়েছে অনিয়ম। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা নদীকেন্দ্রীক বিভিন্ন স্থাপনাও বাধাগ্রস্ত করছে ইলিশের প্রজননক্ষেত্র। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের মাছকাটা নদীর জেলে জসিম উদ্দিন হাওলাদার। তিন বছর আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাক্ষাতকার নিয়ে সরকারি চালসহায়তার জন্য একটি কাগজ (স্লিপ) দেন তাকে। কিন্তু পরবর্তীতে এ স্লিপ নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) মেম্বারের কাছে গেলে তাকে কার্ড দেয়া হয়নি। মেম্বারকে উপঢৌকন না দেয়ায় সরকারি চালসহায়তা থেকে এখনো বঞ্চিত জসিম উদ্দিন।
একই অবস্থা মাছকাটা নদীর স্টিমারঘাট এলাকার মোশারেফ, রুবেল মাঝি, খোরশেদ সরদার, কামাল, সেকুল রাঢ়ীসহ ১৩ জেলের। শুধু এ এলাকায়ই নয়, সরকারি চালসহায়তা থেকে বঞ্চিত দেশের ৫৮ শতাংশ জেলে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়জুড়ে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। এজন্য বছরের মার্চ থেকে জুন এ চার মাস জেলেদের চালসহায়তা দিয়ে থাকে সরকার। এ সহায়তা পেতে সংশ্লিষ্ট ইউএনওর সুপারিশক্রমে স্থানীয় ইউপি সদস্য থেকে এ-সম্পর্কিত কার্ড সংগ্রহ করতে হয়।
কিন্তু এ প্রক্রিয়াতেই বাদ পড়ে যান বিপুল সংখ্যক জেলে। আর কার্ড পেলেও চাল বিতরণ পর্যায়ে ঘটা নানা অনিয়মের কারণে বঞ্চিত হওয়ার ভবিতব্য থেকে বাঁচতে পারেন না জেলেরা। ফলে অনেক জেলেকেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে আহরণ-নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরতে হয়। ‘সাসটেইনেবল লাইভলিহুড অপশনস ফর ফিশারিজ ডিউরিং দ্য ইলিশ ব্যান পিরিয়ড’ শীর্ষক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) যৌথভাবে এ গবেষণা করেছে। একাধিক জেলে জানান, ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে তারা নদী থেকে মাছ আহরণ করছেন। কিন্তু স্থানীয় ইউপি মেম্বারদের ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা না দিলে কার্ড পাওয়া যায় না। ফলে সরকার মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও কখনো কখনো নির্দেশনা উপেক্ষা করেই মাছ ধরতে হয় তাদের। গবেষণার তথ্যমতে- দেশে জাটকা আহরণকারী জেলের সংখ্যা ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪।
কিন্তু গত অর্থবছরে মাত্র ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৬ জন জেলে সরকারের সহায়তা পেয়েছেন। এ হিসাবে ৫৮ শতাংশ জেলেই সহায়তা বঞ্চিত। আর সরকারি সহায়তার এ চালের ৮২ শতাংশই বিতরণ হচ্ছে অনিয়মের মাধ্যমে। এর মধ্যে গুদাম থেকে কম চাল পাচ্ছেন ২১ শতাংশ জেলে। এছাড়া ইউপি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে ২৩ শতাংশ, রাজনৈতিক প্রভাবে ২০, ইউপি চেয়ারম্যানের দুর্নীতিতে ৬ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রায় ২১ শতাংশ জেলে অনিয়মের শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়ে বরিশাল ক্ষুদ্র মৎস্য জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সিকদার জানান- ইলিশ রক্ষায় জেলেদের মধ্যে চাল বিতরণ নিয়ে চলে মহাদুর্নীতি। মার্চ থেকে জুন সময়ে এ চাল দেয়ার কথা থাকলেও ইউএনও, চেয়ারম্যান, মেম্বাররা তা তিন-চার মাস পরে দেন। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে চাল না পাওয়ায় তাতে জেলেদের কোনো লাভ হয় না। নির্ধারিত সময়ের পর চাল বিতরণ করলেও পরিমাণে কম দেয়া হয়।
এমনকি চার মাসের স্থলে দুই মাস দিয়ে চাল বিতরণ বন্ধ করা হয়। এদিকে সরকারি চালসহায়তার আওতা ও এর পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ মত্স্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তর থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশে জাটকা আহরণকারী জেলের সংখ্যা ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪। কিন্তু গত অর্থবছর মাত্র ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৬ জন জেলেকে ৪০ কেজি হারে চার মাসে মোট ৩৭ হাজার ৭৮৮ টন চাল প্রদান করা হয়। এদিকে জেলেদের ওপর মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় বাড়লেও বাড়েনি প্রদানকৃত চালের পরিমাণ। এমনকি জনপ্রতি হিসাবেও প্রদানকৃত এ চালের পরিমাণ কম।
এতে বলা হয়, দৈনিক একজন ব্যক্তির ৫০০-৭০০ গ্রাম চালের প্রয়োজন হয়। ফলে কমপক্ষে চার সদস্যবিশিষ্ট পরিবারে ৩০ দিনে অন্তত ৬০ কেজি চালের প্রয়োজন হলেও দেয়া হচ্ছে ৪০ কেজি হারে। যদিও এ চাল পেতেও তাদের নানা অনিয়মের শিকার হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং গবেষণা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবিএম জাহিদ হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১৫ সালের জেলা সম্মেলনে জেলেদের চালের পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়। সেটি বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
জেলেদের বর্তমান অবস্থা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ২৮ জেলার ১১৬ উপজেলায় ৮০ কেজি হিসাবে চালের চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে। এ হিসাবে এ বছর ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪ জনকে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮১ টন চালসহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে জেলেদের জাটকা ধরা থেকে বিরত রাখতে বিকল্প কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে বলে মনে করেন মত্স্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে। তাহলে এসব জেলে অনিয়ন্ত্রিভাবে মাছ ধরতে চাইবেন না। এতে সারা বছরই মাছের উত্পাদন স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে। জেলেদের চালের পরিবর্তে অর্থসহায়তা দিতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, চরম দরিদ্রদের মধ্যে অন্যতম ইলিশ জেলে। তাদের জন্য বিদ্যমান সহায়তা কার্যক্রম পর্যাপ্ত নয়। একই সঙ্গে বিতরণ পর্যায়ে অনিয়মের কারণে এসব সহায়তা কার্যত তাদের কোনো উপকারে আসছে না। নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হলে ওই সময়ে জেলেদের সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি বিতরণ প্রক্রিয়ায়ও সচ্ছতা আনতে হবে। এজন্য চালের সঙ্গে নগদ অর্থ প্রদান ও বিতরণ এলাকায় জেলে সংগঠনগুলোকে আরো কার্যকর করা যেতে পারে।
খবর বিজ্ঞপ্তি, টাইমস স্পেশাল