বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১০:২২ অপরাহ্ণ, ০২ মার্চ ২০২১
বরিশালে তিন তরুণ সাংবাদিকের ওপর ডিজিটাল আইনের মামলার খড়গ, তবুও সত্যের পক্ষে আপসহীন
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল >> বরিশালে প্রথম মিডিয়াকর্মীদের মধ্যে ডিজিটাল আইনে সম্ভাবত মামলা হয়েছিলো লোকমান হোসেনের বিরুদ্ধে। তার সম্পাদিত সময়ের বার্তা পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে একজন বিচারককে সংশ্লিষ্ট করায় তিনি নিপিড়নজনক এই মামলা জুড়ে দেওয়ার পর পুলিশের অতি উৎসাহী দৌড়ঝাপের মুখে লোকমান হোসেনকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। সাময়িক সময়ের জন্য তার পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ রাখতে হয়। এরপরই পর্বতশৃঙ্গের জমাট বাঁধা বরফ গলে প্রাকৃতিক ঝর্ণায় অঝোর ধারায় জলপ্রবাহে ধাবিত হওয়ার ন্যয় ধীরে ধীরে বরিশালে মিডিয়াকর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের প্রবণতা শুরু হয়। যার ফলে ৩ তরুণ সাংবাদিক শাকিব বিপ্লব , হাসিবুল ইসলাম ও খন্দকার রাকিবের বিরুদ্ধে এক নয়, একাধিক মামলা দায়ের হয়। সব কটি মামলা দায়েরপূর্বে কোনো তদন্ত ছাড়াই অভিযোগ গ্রহণ করে থানা পুলিশ। এর মধ্যে একজন স্বনামধন্য কবি ও সাহিত্যিকের বিরুদ্ধেও একই ধারায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। এবং নাটকীয় কায়দায় এই মামলা দায়েরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্বাধীনচেতা লেখক হেনরি স্বপনকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে। হেনরি স্বপন সাময়িক সময়ের জন্য কারান্তরীণ থাকলেও আত্মসমর্পণকারী লোকমান হোসেন দীর্ঘসময় কারাবন্দী ছিলেন।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, হেনরী স্বপনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর মিডিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশ ও সাংস্কৃতিক মনস্ক কয়েক ব্যক্তি প্রথমে প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও পরে চুপসে যায়। কিন্তু আঞ্চলিক পত্রিকার তরুণবয়সী সম্পাদক লোকমান হোসেনের স্বপক্ষে মিডিয়া ছিলো একেবারেই নিশ্চুপ, যেনো পক্ষপাতমূলক ভূমিকায়। এরপরই সত্য প্রকাশে সংক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের মূল শাখা মহানগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা এই আইনে মিডিয়াকর্মীদের দমনে অগ্রসর হয়। এমনকি আ’লীগ ঘরনার আইনজীবীরাও দলীয় স্বার্থে এধরনের মামলার বাদী হয়েছেন। এনিয়ে পুুলিশ রাজনৈতিক চাপের মুখে থাকায় সহসাই এধরনের মামলা দায়েরে সহায়ক হয়েছে বলে ঘটনা প্রবাহে প্রমাণ মেলে।
দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে, বরিশাল পরিস্থিতিতে এধরনের মামলা সচরাচর দায়েরের ক্ষেত্রে মিডিয়ার বিভাজনকে ক্ষমতাসীন মহল মোক্ষম সুযোগ এবং তাদের সহায়তা পাওয়ায় সত্য প্রকাশে মত প্রকাশ থেকে বিরত রাখতে, বিশেষ করে তরুণ সাহসী সাংবাদিকদের নিপিড়নজনক এই মামলার আসামী করতে আস্কারা দেখায়। বিপরীতে প্রতিদানস্বরূপ ক্ষমতাসীন দলের সহায়তা নিয়ে মিডিয়ার নেতৃত্ব ও নীতিগত লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে সংবাদকর্মীরাও সহকর্র্মীদের দমনে একই ধারায় মামলা দায়েরের পথে হাঁটতে শুরু করে।
যার ফলশ্রুতিতে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলর বাহার এবং মহানগর ছাত্রলীগ নেতা জিন্নাহ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অনলাইন দৈনিক পোর্টাল ‘বরিশালক্রাইম নিউজ’র প্রকাশক-সম্পাদক খন্দকার রাকিবের বিরুদ্ধে পরপর দুটি মামলা দায়ের করার পর একই পথে হাঁটা এক সাংবাদিক নেতা প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে অনলাইন পোর্টাল ‘বরিশালটাইমসের’ বার্তা সম্পাদক হাসিবুল ইসলামসহ তার সঙ্গী খন্দকার রাকিবের বিরুদ্ধে কোতয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করে। অবশ্য এর পূর্বে ওই একই নেতা সংঘাতের অভিযোগে কাউনিয়া থানায় একটি মামলায় এই দুই তরুণ সাংবাদিককে আসামী করে।
বরিশালে ডিজিটাল আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহকর্মীদের মামলায় পার্শ্ববর্তী উপজেলার ক্ষমতাসীন দলীয় নেতৃবৃন্দও শহর কেন্দ্রিক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে এককদম পা বাড়াতে সাহস নেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে , সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করলে সহকর্মীদের পক্ষ থেকে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম থাকবে না, এমনটি আঁচ করে এবং অভয় পেয়ে বরিশালটাইমসের সম্পাদক শাকিব বিপ্লব ও বার্তা সম্পাদক হাসিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে মেহেন্দীগঞ্জ থানায় দায়ের হয় একটি ডিজিটাল আইনে মামলা। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলীয় সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে একজন বিধবা নারী বঞ্চনা এবং লাঞ্চনার অভিযোগ এনে বরিশাল আদালতে নালিশ জানালে, তার সূত্র ধরে সেই ঘটনা ‘বরিশালটাইমসে’ তুলে ধরা হয়েছিলো।
ওই সংবাদে সাংসদকে জড়িয়ে কোনরূপ আক্রমণাত্মক তথ্য প্রকাশ না করে শুধুমাত্র নারীর নালিশ উপস্থাপন করা হয় মাত্র। সেই সাথে সাংসদ ও তার অনুসারী স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতার দ্বিমুখী ভাষ্য তুলে ধরা হলে তা সাংঘর্ষিক হয়ে দাড়ায় এবং প্রমাণ বহন করে যে, ওই নারীর অভিযোগ অমূলক নয়। আদালতের কাগজপত্রের বুনিয়াদে এবং নারীর সাথে কথোপকথনের সূত্রে সংবাদ প্রকাশ করা হলেও সাংসদ বিরাগভাজন হন। সূত্র জানায়, সাংসদ নিজে নেপথ্যে থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম ভুলুকে বাদী করে মেহেন্দীগঞ্জ থানায় বরিশালের এই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা দায়ের করে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অনেকটা প্রভাব খাটানোর ফলে এধারায় মামলা গ্রহণের আইনগত দিক না থাকলেও পুলিশ তা আমলে নিতে বাধ্য হয়।
সবচেয়ে আলোচনার জন্ম দেয় বরিশালটাইমসে নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাদ সাদিক আব্দুল্লাহকে নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সংশ্লিষ্ট অনলাইন দৈনিকটির সস্পাদক শাকিব বিপ্লবের বিরুদ্ধে এই নেতা এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে, অন্তত ৩৫ জন নেতা-কর্মীকে কোতয়ালি মডেল থানায় পাঠিয়ে পুলিশকে বাধ্য করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই সাহসী সাংবাদিককে এককভাবে আসামী করতে। গত একপক্ষকাল আগে দায়েরকৃত এই মামলাটি গ্রহণে পুলিশ প্রথমে অস্বীকৃতি জানালে পরে চাপের মুখে ফেলে। এমন তথ্য দিয়ে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দল সংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গভীর রাতে মামলাটি দায়ের করেন মেয়রের পক্ষে আ’লীগ সমর্থিত আইনজীবী রকি।
লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিলো, মামলাটি দায়েরের পরপরই এবিষয়ে সংবাদ তৈরী করে বরিশালের প্রতিটি মিডিয়া কার্যালয়ে মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর শ্যালকের সম্পাদনায় স্থানীয় একটি সহযোগী দৈনিক পত্রিকা থেকে মেইল পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পাশাপাশি শাকিব বিপ্লবের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের সম্পর্কিত সংবাদটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশে মেয়রের পক্ষে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা গভীর রাত পর্যন্ত অনুরোধ রাখেন। বিভাজন বরিশাল মিডিয়ার মধ্যে জাতীয় পত্রিকা ব্যতীত পরদিন অধিকাংশ আঞ্চলিক পত্রিকায় সেই সংবাদ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায়।
সচেতন মহল ও আইনবিজ্ঞরা বলছে, ডিজিটাল আইনে মামলা গুরুতর এবং স্পর্শকাতর হওয়ায় মূলত এই মামলাটি ঢাকা সাইবার আদালতে দায়ের অথবা অভিযোগকারীর পক্ষ থেকে পুলিশের হেডকোয়ার্টারে আবেদন পাঠানোর পর সায় মিললে স্থানীয় থানা পুলিশ মামলাটি গ্রহণে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। বাস্তবে উল্টো চিত্র দেখা যায়। সরাসরি পুলিশ মামলা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলীয় নেতৃবৃন্দ বা প্রভাবশালীদের চাপের মুখে। যেকারণে বরিশালে ডিজিটাল আইনে সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রবণতা অনেক জেলা অপেক্ষা তুলনামূলক বেশী। কিন্তু বরিশালের ডিজিটাল আইনের মামলার পরিসংখ্যা বা তথ্যাদি ঢাকার কোনো সংস্থার কাছে নেই। এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, জাতীয় পত্রিকায় স্থানীয় প্রতিনিধিরা তাদের সহকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এধরনের মামলা সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশ থেকে রহস্যজনক কারণে বিরত রয়েছে। তার বড় উদাহরণ দেশ ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গেও লেখক হিসেবে জনপ্রিয় হেনরী স্বপনের বিরুদ্ধে এরূপ মামলা নিয়েও কোনো সংবাদ প্রকাশ হয়নি। কারণ নেপথ্যে মামলার বাদী স্বগোত্রীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের স্থানীয় ক্যাথলিক চার্চের বিশপ’র বিরুদ্ধে ফেসবুকে সত্য ভাষণ দেওয়ায় এই প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতার বিষয়টি মূল্যায়ন, পক্ষান্তরে করা হয় সহযোগী লেখকের প্রতি সহানুভূতির বিষয়টি।
চলতি সপ্তাহে ঢাকার কাশিমপুর কারাগারে দেশের আলোচিত লেখক ও উদ্যোক্তা ডিজিটাল আইনে কারাবন্দী থাকা অবস্থায় মৃত্যুতে এই আইনটি বাতিলের দাবি ও মৃত্যুর প্রতিবাদে সচেতন নাগরিক সমাজ ও সাং¯কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক ঘরনার নেতৃবৃন্দর দেশব্যাপী আন্দোলনে এখন উত্তাল। এই পরিস্থিতিতে বরিশালের ৩ তরুণ সাংবাদিক শাকিব বিপ্লব, হাসিবুল ইসলাম ও খন্দকার রাকিবের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনের মামলা নিয়েও কথা উঠেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য মিডিয়ার সাথে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সখ্যতা এবং নানান আন্দোলন সংগ্রামে একমঞ্চে থাকলেও বরিশালে অন্তত ব্যতিক্রম দেখা গেলো স্থানীয় সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনের মামলা নিয়ে সোচ্চারতা থেকে বিরত থাকায়। গত কয়েকদিন ধরে লেখক মোশতাক আহমেদের মৃত্যু নিয়ে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বাম রাজনৈতিক দলগুলো মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করলেও, সেখানে স্থানীয় সাংবাদিকদের ওপর নিপিড়নের বিষয় নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই।
এই অবস্থায় বরিশালের মূল ধারার সাংবাদিকতায় অবদান রাখা তিন তরুণ সাংবাদিক আইনী লড়াইয়ে নিজেরাই লড়ছে নিজেদের অবস্থান থেকে। এবং আপসহীন থেকে সত্য প্রকাশে অবিচল রয়েছে। ব্যতিক্রম বা আশ্বস্তের বিষয় হলো, অন্যান্য স্থানের ন্যায় বরিশালে পুলিশ এই মামলা গ্রহণ করলেও সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনায় সহানুভূতির চোখে দেখছে তরুণদের সাহসিকতা এবং স্বচ্ছ অবস্থান। যেকারণে হয়রানির শিকার তুলনামূলক কম।’