৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

বরিশালে পুলিশের ‘টর্চার সেল’

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৫২ অপরাহ্ণ, ০৬ আগস্ট ২০১৬

বরিশাল: বরিশাল মহানগরের কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা একটি মামলার আসামি শৈশব। চলতি বছরের ২৪ জুলাই উপপরিদর্শক (এসআই ) আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে জনা ছয়েক পুলিশ সদস্য নগরীর মুসলিম গোরস্তান রোডের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। এর কিছু পরে থানায় ছুটে আসেন তার মা, খালা ও বোনে সুইটি। তারা দেখতে পান, শৈশবকে হাজতে না রেখে দোতলায় এসআই  মান্নানের কক্ষে নির্যাতন করা হচ্ছে। তা দেখে তার মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

এসআই মান্নান তাদেরকে অকথ্য গালিগালাজ করে থানা থেকে বের করে দেন। কিছু সময়ে পরে থানা থেকে তাদের মোবাইলে কল আসে। রিসিভ করতেই শুনতে পান শৈশবের আর্তনাদ। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শৈশব বলে, ‘আপু আমাকে বাঁচাও!’ শৈশবের মা ও বোন আবার থানায় গেলে এসআই  মান্নান বলেন, ‘আপনার ভাইকে এখনো বেশি মারি নাই, রাতে আরো মারবো।’

অনেক অনুনয়-বিনয় করলেও এসআইয়ের মান্নান নির্যাতন থামাননি। এই ঘটনায় উর্দ্ধতন পর্যায়ে অভিযোগ করা হলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

বরিশাল মহানগর পুলিশের (বিএমপি) বেশিরভাগ থানায় প্রায়ই আসামিকে নির্যাতন করার ঘটনা ঘটছে। নির্যাতনের ভয়-ভীতি দেখিয়ে বন্দীর স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগও আছে। পুলিশের নির্যাতনের কারণে অনেকে প্রতিবন্ধী হড়ে পড়ছেন।

ভূক্তভোগীদের দাবি, থানার এসআইদের কক্ষগুলো কিছু পুলিশ কর্মকর্তা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করছেন।

নির্যাতিত অনেকেই নতুন করে রোষে না পড়তে কোথাও অভিযোগ করেন না। অভিযোগ করেও সেভাবে সুফল মেলে না। কারণ অভিযোগ প্রমাণিত হলে কখনো তিরস্কার, কখনো সাময়িক বরখাস্তের মতো ‘নরম’ শাস্তি পান দায়ী পুলিশ কর্মকর্তারা। আইনের ফাঁক থাকায় তাদের সেভাবে বিচারের মুখোমুখিও দাঁড়াতে হয় না।

অভিযোগ স্বীকার করে বরিশাল পুলিশের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বললেন, ‘পুলিশের কোনো কর্মকর্তা একই স্থানে অনেক দিন কাজ করলে অসৎ পথে জড়িয়ে পড়তে পারেন। অবস্থানগত স্থিতাবস্থা বেশি হলে অপরাধে জড়ানোটা অস্বাভাবিক নয়।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশে অপরাধ স্বীকারের প্রবণতা কম। আবার কোনো কোনো আসামি বিভ্রান্তিকর তথ্যও দেয়। এজন্যে অনেক সময় সঠিক তথ্য বের করতে তাদের কৌশলে কাজ করতে হয়।

জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে আদালতের অনুমতির পর হেফাজতে নিয়েও আসামিকে নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য বের করার কৌশল আইন ও সংবিধানবিরোধী পদক্ষেপ বলে জানিয়েছেন বরিশাল জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর গিয়াস উদ্দিন কাবুল। তিনি বলেন, রিমান্ডে আসামিকে আইন অনুসারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এর বাইরে অন্য কিছু হলে আইন লঙ্ঘন করা হবে।

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর ও বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারন সম্পাদক লস্কর নুরুল হক বললেন, ‘রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ধরনের কাজ করার অনুমতি রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। যেসব পুলিশ কর্মকর্তারা আইন ভঙ্গ করে তাদের বিধি অনুযায়ী শাস্তি হওয়া উচিত।’

পলিশের কিছু সদস্য আইন লঙ্ঘন করছে- এই অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বিএমপির সহকারী কমিশনার ফরহাদ সরদার বলেন, অভিযুক্ত কিছু পুলিশ সদস্যর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তারা দোষী প্রমাণিত হলে বিভাগীয় মামলা করা হবে। অপকর্মে পুলিশ কখনো উৎসাহ দেয় না। কারণ পুলিশের কেউ অন্যায় করলে পুরো পুলিশ বাহিনীর সুনাম নষ্ট হয়।

বিএমপির কমিশনার এস এম রুহুল আমিন পুলিশ সদস্যদের সুপথে থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমার সময়ে পুলিশের কেউ বিপথগামী হলে পার পাবে না। তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তবে পুলিশের নির্যাতকের ভূমিকা নেয়ার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে নিয়ে আসামী নির্যাতন ও ঘুষ নেয়ার অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেই।’

পুলিশের নির্যাতন থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার চেষ্টা!

বরিশাল গোয়েন্দা পুলিশের কিছু সদস্যের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে নিজ ঘরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন নগরের বেলতলা খেয়াঘাটের বাসিন্দা মাসুদ হাওলাদার। তিনি জানান, ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে ঢাকা থেকে বরিশালের বাসায় আসেন। সকাল ১০টার দিকে ডিবি পুলিশ তার বাড়ি ঘেরাও করে। তারা প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালায়। টের পেয়ে মাসুদ যে কক্ষে ঘুমিয়ে ছিল সেই কক্ষের দরজা আটকে দেয়। ডিবি পুলিশ ওই কক্ষের দরজা ভাঙার চেষ্টা চালায় এবং দরজার ফাঁক দিয়ে মাসুদকে তাদের সঙ্গে থাকা ইয়াবার প্যাকেট দেখায়। এটা দিয়ে তাকে আটকের ভয় দেখালে মাসুদ তার কক্ষে রক্ষিত চাকু হাতে নেন। এরপর ডিবির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আটক করলে আত্মহত্যার চেষ্টা করবেন।

মাসুদ অভিযোগ করেন, এই ঘটনার আগেও ডিবি পুলিশের কিছু সদস্য তার ঘরে অভিযান চালায়। কোনো কিছু না পেলেও অভিভাবকদের সামনে বেদম মারধর করে ২০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। এলাকাবাসী তা দেখে ফেললে ডিবি সদস্যরা মাসুদকে ধরে নিয়ে অন্য এক এলাকায় ছেড়ে দিয়ে বলে, সে যেন কিছুদিন বরিশালের বাইরে থাকে।

এখনো খুঁড়িয়ে হাঁটেন জিহাদ

২০১৫ সালের ৪ মার্চের ঘটনা। কোতোয়ালি থানা হেফাজতে থাকা আমানতগঞ্জের লিটু সিকদার জিহাদ নামে এক যুবককে নির্যাতন করে পা ভেঙ্গে দেয় পুলিশ। তবে পুলিশ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিলো, থানা হেফাজতে জিহাদের পা ভাঙ্গেনি। কিভাবে পা ভেঙ্গেছে তাও জানা নেই তাদের।

বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে (শেবাচিম) হাসপাতালে চিকিৎসা নেন জিহাদ। তার পরিবার জানায়, ফজলুল হক এভিনিউ রোডের সিদ্দিক ষ্টোর্সের কর্মচারী ছিলেন তিনি। জিহাদ নিহত স্বর্ণ ব্যবসায়ী রুবেল সিকদারে চাচাতো ভাই। এই হত্যা রহস্য বের করতে জিহাদকে থানায় দেখা করার নিদের্শ দেন কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাখাওয়াত হোসেন। ৪ মার্চ সন্ধ্যায় জিহাদ থানায় গেলে তাকে একটি কক্ষে আটকে রেখে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতন চালানো হয়। এভাবে তার দুই পা থেতলে দেয়া হয়। ৫ মার্চ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরদিন উন্নত চিকিৎসার জন্য শেবাচিম হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগে পাঠানো হয় তাকে। এরই মধ্যে নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে মুখ না খোলার জন্য বাসায় এসে জিহাদের পরিবারকে ভয় দেখিয়ে যান পুলিশের কর্মকর্তারা। জিহাদের পা পুরোপুরি সারেনি। এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন তিনি।

পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, আদালতের শুনানির নির্দেশ

মুলাদি চরকালেখান আইডিয়াল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র মিঠু হত্যা মামলায় আসামী তারেক খানকে নির্যাতন করা হয় পুলিশ হেফাজতে। এর সঙ্গে জড়িত মুলাদি থানার এসআই মিজানুর রহমান। তারেককে আটকের পর গত ২৮ জুলাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করে পুলিশ। তা মঞ্জুর করেন আদালত।

পরের দিন হেফাজতে নিয়ে তারেককে নির্যাতন করেন এসআই মিজানুর রহমান। এতে তার মাথায় জখম তৈরি হয়। এই ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়। ৩১ জুলাই আবেদনটি জেলা জজ আদালতে মামলার মূল নথির সঙ্গে সামিল করা হয়। শুনানির জন্য দিন ধার্য রাখারও নির্দেশ দেন আদালত।

67 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন