বরিশালে বড় সমাবেশের স্বপ্ন, কিন্তু ক্ষমতাসীদলের কৌশলে চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি
শাকিব বিপ্লব, বরিশাল:: বরিশালে বিএনপির গণসমাবেশের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে, উত্তেজনার পারদ ততই উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। ৫ নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় গণসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত করার সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হলেও স্থানীয় বিএনপির মধ্যে শঙ্কা দলীয় এই কর্মসূচি বানচালে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিতে পারে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযোগ জানান দিতে বুধবার অপরাহ্নে বরিশাল প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সমাবেশ নিয়ে আ’লীগের নানা প্রতিবন্ধকতা এবং নেতাকর্মীদের ওপর হামলার বর্ণনা দিয়েছে। সেই সাথে তাদের এই কর্মসূচি সফল করতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
গণসমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির সমন্বয়কারী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দীর্ঘ তিন পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্যে সমাবেশ বানচালে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের চক্রান্ত এবং প্রশাসনের অসহযোগিতার কথা তুলে ধরে বলেন, কোনো বাধাই এই সমাবেশ রোধ করা যাবে না। বরং গণসমাবেশ যে জনসমুদ্রে রুপ নিতে যাচ্ছে তার প্রতিধ্বনি বরিশালের রাজপথে দলীয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত হওয়ার দৃশ্যপটই বলে দেয়। তিনি বিভাগীয় সমাবেশকে গণসমাবেশ বলার কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন- শুধু বিএনপির কর্মী-সমর্থক নয়, সাধারণ মানুষও এই ফ্যাস্টিস আ’লীগ সরকারের ওপর তিক্ত-বিরক্ত। অনেকেই মুখিয়ে আছেন গণসমাবেশের দিকে ধাবিত হতে।
পূর্ব আলামত পেয়ে ক্ষমতাসীন দল প্রথমে পর্দার অন্তরালে থেকে গণসমাবেশের স্থান দিতে প্রশাসনের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কালক্ষেপন করে। পরে তাদের পছন্দের বঙ্গবন্ধু উদ্যান (বেলস পার্ক) নির্ধারন করে দিলেও মাঠের অর্ধাংশ জায়গা জেলা প্রশাসন তাদের দখলে রেখেছে। পাশাপাশি নিজেদের পছন্দের নামকরণে বাস মালিক সমিতি এবং লঞ্চ মালিক পক্ষকে গণসমাবেশের একদিন আগে অর্থাৎ ৪ ও ৫ নভেম্বর ধর্মঘটের ডাক দিতে বাধ্য করেছে। এমনকি শহরের অভ্যন্তরীণ পথে গণপরিবহন চলাচলের ওপর এই দুদিন লিখিতভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শ্রমিকলীগ।
সেলিমা রহমান বলেন, ইতিমধ্যে গণসমাবেশ উপলক্ষে প্রচারণার প্রাক্কালে বরিশালের উজিরপুর-বাকেরগঞ্জ, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলায় দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা নির্যাতন চালিয়ে অন্তত ১৫ জনকে রক্তাক্ত করেছে। এরমধ্যে ভোলায় একজন যুবদল নেতার ওপর যে ধরনের হামলা চালানো হয় তা বর্বরতার সামিল। রাত হলেই শুরু হয় দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িবাড়ি আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ অভিযান। ধরপাকড়ে বরগুনা জেলা যুবদল নেতা মিরাজুর রহমান সৈয়দকে গ্রেপ্তার করা হলেও বরিশালে কোথায় কোনো নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করার সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিতে পারেননি এই নেত্রী।
দুপুরের এই সাংবাদিক সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, যুগ্ম মহাসচিব হাবিবুন নবী সোহেল, দলের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিন এবং অপর দুই সমন্বয়কারী আকন কুদ্দুসুর রহমান ও মাহাবুবুল হক নান্নু। সেলিমা রহমানের বক্তব্যের ফাঁকে অপরাপর নেতৃবৃন্দ বিক্ষিপ্তভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এসময় জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবায়দুল হক চানও বক্তব্য রাখেন।
তাদের সকলেরই অভিন্ন ভাষ্য হচ্ছে- আওয়ামী লীগ দলীয় সন্ত্রাসী ও দলবাজ প্রশাসনের সম্মিলিত অপচেষ্টায় আগামী ৫ নভেম্বরের গণসমাবেশ ভুণ্ডুল করাই হচ্ছে মূল টার্গেট। কিন্তু চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রংপুরের গণসমাবেশ সফলতার পর বরিশালে আহুত কর্মসূচি হবে আরও বৃহৎ এবং এই এখান থেকেই সরকার পতনের ঘণ্টা বেজে উঠতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে দীর্ঘ সারির মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন বরিশাল অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ, যারা কেন্দ্রীয় নেতা। কিন্তু দলের যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ার অনুপস্থিত ছিলেন। তার এই অনুপস্থিতির কারণ এবং দলের মধ্যে বিভাজন রয়েছে কী না- মিডিয়াকর্মীরা এমন প্রশ্ন রাখলে মঞ্চে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ হঠাৎ বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। পরে অনুষ্ঠান সামাল দিতে গণসমাবেশের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন- দলের মধ্যে কোনো বিভক্তি নেই, সকালেও সরোয়ার ও তিনি একত্রিত হয়ে গণসাবেশের প্রচারপত্র বিলি করেছেন। কিন্তু কেন নিজ জেলা শহরের কর্মসূচি নিয়ে আহুত সংবাদ সম্মেলনে দলের এই প্রভাবশালী নেতা অনুপস্থিত থাকলেন সেই প্রশ্নের ব্যাখ্যা না দিয়ে বক্তব্য ভিন্নদিকে ধাবিত করে সমাবেশ সফল করার নানান দিক তুলে ধরেন।
এদিকে, এই গণসমাবেশকে ঘিরে এখন বরিশালে বিএনপি ও আ’লীগ মুখোমুখী অবস্থান নিয়ে আছে। গত দুদিন ধরে আ’লীগ নগরীর ত্রিশটি ওয়ার্ড থেকে সকাল-বিকেল বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করে বিএনপি রাজপথে মিছিল বন্ধ রেখে এখন দলীয় কার্যালয়ের সম্মুখে অবস্থান নিয়ে সেখান থেকেই সমাবেশ সফলের শ্লোগান দিচ্ছে। পাশাপাশি সময় ভেদে চালাচ্ছে প্রচার-প্রচারণা। সেই সাথে দলের অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের এক কাতারে নিয়ে আসার প্রয়াস চালিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল, বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন পূর্ব অশ্বিনী কুমার হল সংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ের সামনে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে যখন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা মুহুমুহু শ্লোগান তুলছিল, ঠিক তখনই মহানগর শ্রমিকলীগের আহ্বায়ক পরিমল চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে একটি খণ্ড মিছিল বের হয়। মিছিলটি সদর রোড অতিক্রমকালে বিএনপির নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে ব্যাঙ্গত্মক শ্লোগান দিতে শোনা যায়। বিএনপির নেতাকর্মীরা নিশ্চুপ থাকায় সেখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। যদিও সকাল থেকে অশ্বিনী কুমার হলের সম্মুখ ভাগসহ আশপাশে পুলিশ ও সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন- গণপরিবহন নিয়ে প্রতিবন্ধকতা এবং রাজপথে আ’লীগের শোডাউন মূলত সংঘাত সৃষ্টির অপচেষ্টা নয়, বরং এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করে সমাবেশস্থলে গণমানুষের উপস্থিতি রোধে কৌশল নিয়েছে সরকারী দল। সেই ফাঁদে পড়ে বিএনপি সমাবেশ নিয়ে তর্জনি-গর্জনি দিলেও আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত পুলিশের বাড়াবাড়িও চোখে পড়ার মতো নয়। তবে ছাত্র-যুব ও শ্রমিকলীগের এলাকাভিত্তিক বেশকিছু ক্যাডার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়ে আছে এবং চৌকি বসিয়ে দূর-দুরন্ত থেকে সমাবেশমুখী বিএনপির কর্মী-সমর্থক ও আমজনতাকে এক ধরনের ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করতে চাইছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। পক্ষান্তরে বিএনপিও বসে নেই।
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, তারাও পাল্টা প্রস্তুতি নিয়ে এলাকাভিত্তিক একত্রিত থাকছে, নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ওপর কোনো প্রকার হামলা হলে তার পাল্টা জবাব দিতে। ৩১ অক্টোবরের পরেই এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারাও অনুরুপ অভিযোগ করে বলেন- সড়কপথে চৌকি বসানো হলেও কর্মী-সমর্থকদের সাথে সাধারণ মানুষের ঢল রোহিত করা যাচ্ছে না। দৃশ্যপট বলছে- কর্মসূচির অন্তত ৫ দিন আগেই দূর-দুরান্ত থেকে অর্থাৎ বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীরা বরিশাল শহরে এসে অবস্থান নিয়ে আছে। সন্ধ্যার পরেই তারা একত্রিত হচ্ছে সমাবেশস্থল বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। দিনের বেলায় কেউ কেউ কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সমাবেশ সফল করার লক্ষে প্রচারণায়ও নামছেন।
সার্বিক পরিস্থিতি হচ্ছে- দলের মধ্যে বিভাজন এবং আওয়ামী লীগের নানা পদক্ষেপে শহরে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকের ধারণা, সমাবেশের দিন অথবা তার পূর্বেই সংঘাত-সংঘর্ষে বরিশাল নগরী উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে বিএনপির বিভাজনের রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের ওপর নাখোশ মজিবর রহমান সরোয়ার সমর্থিতরা নিজস্ব আঙ্গিকে সমাবেশমুখী হতে এলাকাভিত্তিক নিরব প্রচারণার বিষয়টি মহানগরের নেতারা ভাল চোখে নিচ্ছে না। ফলে দুই ধরনের আশঙ্কা এক. আ’লীগের প্রতিবন্ধকতা ও দুই. বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সমূহ বিষ্ফোরণ ঘটলে পরিবেশ-পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে এই গণসমাবেশ কতটা সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমন আলোচনাই শহরজুড়ে ঘুরেফিরে শোনা যাচ্ছে। ফলে সমাবেশের সফলতা নিয়ে বিএনপি যে বড় ধরনের স্বপ্ন দেখছে, তার বাস্তব প্রতিফলন কতটুকু দেখা যাবে তা নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে রাজনৈতিক মহলে কথা উঠেছে। দলীয় নেতৃবৃন্দ এনিয়ে মুখ না খুললেও তাদের মুখবয়ে এই শঙ্কা স্পষ্ট দেখা যায়।
এদিকে আ’লীগ বলছে- বিএনপির সমাবেশকে তারা আমলে নিতে চাচ্ছে না। এমনটি জানিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আগামী ১১ নভেম্বর রাজধানী ঢাকায় যুবলীগের সমাবেশকে সামনে রেখে গত দুদিন ধরে তারা যে কর্মসূচি শুরু করেছে তা ৯ নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এরমধ্যে বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে তার সমুচিত জবাব দেওয়া হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চরণ করেন।
সবকিছু মিলিয়ে বরিশালে বিএনপির গণসমাবেশই এখন স্থানীয় রাজনীতিতে আলোচ্চ্য বিষয় হয়ে দাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান কৌতুহল দেখা দিয়েছে, আগামী ৫ নভেম্বরকে ঘিরে।’
শিরোনামবরিশালের খবর