বরিশাল: সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার প্রায় সাড়ে ৩ বছর পর বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ৭১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা এবং তার অনুমোদন নিয়ে তোলপাড় চলছে। জেলা সভাপতি সংসদ সদস্য হাসানাত আবদুল্লাহ’র পরিবারের ৫ জন জায়গা পেয়েছেন কমিটিতে। বাদ পড়েছেন প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরনের অনুসারীরা। ১৯৯৬ সালে যাদের কারণে দেশব্যাপী বিতর্কিত হয়েছিল বরিশাল আওয়ামী লীগ তাদের অনেকেই ঠাঁই পেয়েছেন কমিটিতে। সম্পাদকীয় পদে এসেছেন বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিবের আপন বড় ভাই। দলে অপেক্ষাকৃত নতুন এবং বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা নেতাদেরও দেয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদ। সব মিলিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য ঘোষিত এই কমিটি প্রশ্নে চাপা ক্ষোভ আর অসন্তোষ চলছে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ দেয়ার কথাও ভাবছেন অনেকে।
২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে কেবল সভাপতি আর সম্পাদকের নাম ঘোষণা হয়। আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার দায়িত্ব দেয়া হয় তাদের। নিয়মানুযায়ী ৩ বছর মেয়াদি হয় জেলা কমিটি। সে অনুযায়ী ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর এই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এর ঠিক ৬ মাস পর অর্থাৎ সাড়ে ৩ বছরের মাথায় শনিবার কেন্দ্রের অনুমোদন পায় পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি। ৭১ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটি ঘোষণার পরপরই শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেক ত্যাগী আর পরীক্ষিত নেতার নাম বাদ দিয়ে পারিবারিক এবং একান্ত নিজস্ব অনুসারীদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর মতো প্রভাবশালী নেতার সামনে সরাসরি কিংবা প্রকাশ্যে অভিযোগ করার মতো সাহস পাচ্ছে না কেউ। তবে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ এবং অসন্তোষের বিষয়টি চাপা থাকছে না।
সদ্য ঘোষিত কমিটির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের আপন বড় ভাই সৈয়দ দুলালের সম্পাদকীয় পদ পাওয়া। জেলা আওয়ামী লীগের নাট্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদ পেয়েছেন তিনি। অবশ্য দুলাল জেলা আওয়ামী লীগের বিগত কমিটিতেও একই পদে ছিলেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র স্ত্রী সাহানারা আবদুল্লাহকে করা হয়েছে ১নং সহ-সভাপতি।
বিষয়টি সহজভাবে নিচ্ছে না অনেকেই। তাদের মতে, এই অবস্থানের মানে হচ্ছে প্রকারান্তরে হাসানাত পরিবারেই রইল সভাপতির ক্ষমতা। কেবল এই দু’জনই নয়, হাসানাত পরিবারের আরও ৩ জন জায়গা পেয়েছেন কমিটিতে। এরা হলেন ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে হাসানাত আবদুল্লাহ’র শ্যালক কাজী মফিজুল ইসলাম কামাল, কার্যনির্বাহী সদস্য পদে তার ছেলে আশিক আবদুল্লাহ এবং জ্ঞাতি ভাই রইস সেরনিয়াবাত। এছাড়া কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন সভাপতির সংসদীয় আসনের মোট ১১ জন। জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কখনোই দেখা যায়নি মফিজুল ইসলাম কামালকে। পেশায় ঠিকাদারি এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গেই তার উঠাবসা।’
১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে চলে আসা অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ খান এবং ওয়ান ইলেভেনের সময় হঠাৎ রাজনীতিতে উদয়ের পর প্রথমে কিংস পার্টি এবং পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুকের জেলা কমিটিতে সহ-সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার বিষয়টিকেও ভালো চোখে দেখছেন না অনেকে। নয়া কমিটিতে সবচেয়ে ভাগ্যবান হিসেবে দেখা হচ্ছে জেলা যুবলীগ সভাপতি জাকির হোসেনকে। কোনো রকম সম্মেলন কিংবা নির্বাচন ছাড়াই টানা ২৫/২৬ বছর যুবলীগের সভাপতি পদে থাকা জাকির পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদকের পদ। এছাড়া আওয়ামী লীগের ১৯৯১-৯৬ শাসনামলে যাদের ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে কেবল দক্ষিণাঞ্চলই নয়, দেশজুড়ে বিতর্কিত হয় বরিশালের আওয়ামী লীগ তাদের মধ্যে দু’জন পেয়েছেন জেলা কমিটির সম্পাদকীয় পদ।
ঘোষিত কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র মরহুম শওকত হোসেন হিরনের অনুসারীরা। নতুন কারও জায়গা পাওয়া তো দূরের কথা, আগে যারা জেলা কমিটিতে ছিলেন তারাও বাদ পড়েছেন কমিটি থেকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, বরিশালের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখলেসুর রহমান এবং বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম। এককথায় হিরন অনুসারীমুক্ত করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি। বরিশাল সদর আসনের বর্তমান এমপি প্রয়াত হিরনের স্ত্রী জেবুন্নেসা হিরনকেও রাখা হয়নি কমিটিতে। অবশ্য মহানগরের সভাপতি পদের জন্য লড়াই করছেন জেবুন্নেসা। সেই বিবেচনায় তাকে জেলা কমিটিতে রাখা হয়নি বলে মনে করছেন অনেকে।
এসব বিষয় নিয়ে আলাপকালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগের কোনো নেতা একসঙ্গে একাধিক কমিটির সম্পাদকীয় পদে থাকতে পারেন না। যে কারণে পুরনো কমিটির অনেকেই হয়তো এই কমিটিতে নেই। কমিটি গঠন প্রশ্নে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং যোগ্য নেতাদেরই বিবেচনায় আনা হয়েছে। যারা কমিটিতে এসেছেন তারা তাদের দক্ষতা-যোগ্যতার কারণেই এসেছেন। এক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো কিছুর বিবেচনা হয়নি। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অগণিত যোগ্য লোক রয়েছেন। আর কমিটিতে পদের সংখ্যা মাত্র ৭১। এক্ষেত্রে সবাইকে কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না এটাই স্বাভাবিক। তারপরও আমরা চেষ্টা করেছি দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে যোগ্য নেতাদের পদ-পদবি দেয়ার।