১১ ঘণ্টা আগের আপডেট সকাল ৯:৩৮ ; বৃহস্পতিবার ; নভেম্বর ৩০, ২০২৩
EN Download App
Youtube google+ twitter facebook
×

বাংলার বাঘ শেরে বাংলা মুকুটহীন সম্রাট

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
৭:২২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৭, ২০১৭

আজ ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবের ৫৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। রাজনৈতিক নেতার ওয়ারিশ হলো তার রাজনৈতিক সংগঠন। সাধারণত দলীয় উদ্যোগেই প্রয়াত নেতার স্মরণ সভা-সেমিনার ইত্যাদি হয়ে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে শেরে বাংলার দলটাকে তার অনুসারীরা তার মৃত্যুর পর বেচনা-কেনা করে কলঙ্কিতও করেছে আবার তামাদি করেও রেখে গেছে। অথচ দলটা অবিভক্ত বাংলায় ক্ষমতাশীনও ছিল, শেরে বাংলা এ দলের নেতা হিসাবে অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ারও ছিলেন।

মওলানা ভাসানীর দল ন্যাপেরও একই অবস্থা। তার মৃত্যুর পর মশিউর রহমান যাদু মিঞা উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামরিক স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের কাছে সিনিয়র মিনিস্টারের পদের লোভে ন্যাপকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এখন শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি আর মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অস্তিত্ব নেই। মওলানা ভাসানীর কিছু ভক্ত অনুসারী এখন বেতের টুপি মাথায় দিয়ে তোপখানা রোডে ঘুরাঘুরি করে তাদের শেষ অভিলাষ কী কে জানে।

এমন এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যারা দলের ঊর্ধ্বে, কালের ঊর্ধ্বে। মহাকাল তাদের অস্তিত্বকে নিঃশেষ করতে পারে না। এরা কাল উত্তীর্ণ মহাপুরুষ। জাতিই তাদেরকে স্মরণ করে। বাঙালি জাতির কৃতজ্ঞতাবোধ কম। এখানেই সংকট।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোনায় শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর খাজা নাজিম উদ্দীনের কবর। তিনজনই অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার ছিলেন। সেখানে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাদের কবরের ওপর সমাধি তৈরি করেছেন। যে অবকাঠামোতে সমাধি তৈরি করা হয়েছে তা দেখলে সমাধি বলে মনে হয় না। কাঠামোটা দেখতে কোনও জাদুঘরের কাঠামোর মতো।

এ উপমহাদেশে উৎকৃষ্ট সমাধি সৌধ হলো তাজমহল। অত-টাকা ব্যয় করে না হোক কম টাকা ব্যয় করে অনুরূপ সমাধি সৌধ বানানোই উত্তম ছিল। এখন কোনও অজানা লোক পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় বুঝতে পারে না যে এখানে তিন মহান ব্যক্তি চির নিদ্রায় শায়িত। শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহারাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এরা জাতির প্রেরণার স্থল। এদের সমাধি সৌধকে প্রেরণা জাগানো অবকাঠামোয় রাখা উচিৎ।

ব্রিটিশেরা এ উপ-মহাদেশের শাসনভার নিয়েছিলো মুসলমান শাসকদের হাত থেকে। বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব ছিলেন সিরাজদ্দৌল্লাহ্, মাহীশুরের রাজা ছিলেন টিপু সুলতান, অযোধ্যার নবাব ছিলেন ওয়াজেদ আলী খাঁন। সারা ভারতেই ছিল মুসলিম শাসকদের অধীন। রাজ্য হারা মুসলমানেরা সহজে ব্রিটিশ রাজকে মেনে নেয়নি। মুসলমানেরা শত শত বার বিদ্রোহ করেছে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহী মুসলমান দীর্ঘদিন বিদ্রোহী থেকে শেষে হলো বিপর্যস্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ কয় দশকে বিপন্ন মুসলমানদেরকে উদ্ধার করার জন্য যে কয়জন মনীষী এগিয়ে আসনে তারা ছিলেন নবাব আব্দুল লতিফ, জাস্টিস আমির আলী, স্যার সৈয়দ আহাম্মদ খাঁন দেহলভী, বিংশ শতাব্দীতে এসে যোগ দিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক, স্যার সিকান্দার প্রমুখ। এদের মাঝে স্যার সৈয়দ আহাম্মদ খাঁন দেহলভী ও শেরে বাংলা ফজলুল হক মুসলমানকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা ছিল ঐতিহাসিক এবং সফলকাম।

১৯২০ সালে যখন স্কুল কলেজ বয়কট করার আন্দোলন শুরু করেছিলেন ভারতীয় নেতারা তখন কিন্তু শেরে বাংলা ফজলুল হক ছাত্রদেরকে লেখাপড়া ছেড়ে আন্দোলন যোগদান না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বার বার। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯২০ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে মিটিং করেছিলেন এবং এ মিটিংয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন মূল বক্তা। সভায় বক্তারা স্কুল কলেজ ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সভার শেষভাগে এসে শেরে বাংলা সব ছাত্রকে স্কুল কলেজ ত্যাগ না করার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা দিলেন।

তিনি মুসলমান ছাত্রদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন মুসলমানেরা শিক্ষায় পিছিয়ে আছে তাদের স্কুল কলেজ বয়কট করার প্রশ্নই আসে না। বয়কট আন্দোলনের সময়েই শেরে বাংলা ১৯২৪ সালে ১ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। মন্ত্রীত্ব দীর্ঘ সময় করতে পারেননি। কিন্তু সল্প সময়ের মন্ত্রীত্বেই তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। ১৯১৬ সালে হক সাহেব কলকাতায় টেইলর হোস্টেল ও কারমাইকেল হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ হোস্টেল দুটি স্থাপন করায় বাংলার বিভিন্ন জেলার মুসলিম ছাত্ররা এসে কলকাতায় লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখনকার দিনে কলকাতায় আবাসিক সংকট ছিল।

শেরে বাংলা ছিলেন সব সময় কৃষক প্রজার অনুকূলে অবস্থান নেওয়া নেতা। যদিও বা তিনি একাধারে মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন আবার নিখিল ভারত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। কিন্তু নবাব জমিদারে ভরা উভয় দলে তার অবস্থানকে তিনি কখনও গরিব কৃষক প্রজার অনুকূলে হীতকর কিছু করার উপযুক্ত পরিবেশ বলে বিবেচনা করেননি। তাই তিনি মনে মনে স্থির করেছিলেন কৃষক প্রজার স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি একটা সংগঠন গড়ে তুলবেন। তিনি তার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে কিছু কিছু প্রজা সম্মেলনেও বিভিন্ন জেলায় করেছিলেন।

১৯২৬ সালে মানিকগঞ্জের ঘিওর হাটের সম্মেলন থেকে কৃষক প্রজা পার্টি যাত্রা শুরু। ঘিওর হাটের সম্মেলনের উদ্যোগতারা ছিলেন আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, মাহাবুব আলী খাঁন মজলিস, খাঁন বাহাদুর আওলাদ হোসেন, ইসহাক খাঁন মজলিশ, ডাক্তার তাফাজ্জল হোসেন, রেজাই করিম, আব্দুলস সামাদ মোক্তার, সুন্দর আলী গান্ধী, আব্দুল কাদের সর্দ্দার, নইমুদ্দীন আহাম্মদ, আব্দুল হাকিম বিক্রমপুরী প্রমুখ। এ সম্মেলনে লক্ষাধিক কৃষক প্রজা উপস্থিত হয়েছিলো। ১৯২৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গীয় কৃষক প্রজা পার্টি’ গঠনের ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। এ পার্টির সভাপতিও ছিলেন তিনি নিজেই। নেতা ছিলেন সৈয়দ নওশের আলী, নির্মল কুমার ঘোষ, আসাদ উদ্দৌলা সিরাজী, মওলানা আহাম্মদ আলী, পীর বাদশা মিঞা বিরাট চন্দ্র মশুল, রজীব উদ্দীন তরফতার, প্রভাতচন্দ্র লাহিড়ী, হাজী লাল মুহাম্মদ আবুল হোসেন সরকার, কাজী এমদাদুল হক, মাওলানা আব্দুল্লাহিল বাকী, আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী, শাহেদ আলী, মাওলানা গোলাম সত্তার, মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামবাদী প্রমুখ।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টি সমান সমান আসন পেয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। মন্ত্রী হয়েছিলেন নবাব হাবিবুল্লাহ বাহাদুর, স্যার নাজিম উদ্দীন, সৈয়দ নওশের আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব মোশারফ হোসেন, বাবু নলিনী রঞ্জন সরকার, স্যার বিপি সিং রায়, মহারাজ শীষ চন্দ্র নন্দী, মি. মুকুন্দ বিহারী মল্লিক এবং মি. প্রসন্ন দেব রায়কত।

বাংলার বিশেষ করে পূর্ব বাংলার কৃষক কূল ছিল ঋণে জর্জরিত। জমিদারের খাজনার অত্যাচার আর মহাজনী ঋণ এ দুই সমস্যায় কৃষকেরা ছিল অস্থির। খাই খালাসী, জয়সুদী, পাট্টা, কবুলিয়ত কত রকমের ফাঁদ ছিল সুদী ব্যবস্থায় মহাজনদের। হক সাহেব সর্বপ্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করে মহাজনদের হাত থেকে কৃষককে রক্ষার জন্য ঋণ সালিশি বোর্ড ও মহাজনী আইন করার উদ্যোগ নিলেন। এই আইনই বাংলার কৃষক সমাজকে সাইলকী প্রথা থেকে মুক্তি দিয়ে ছিল। এমন এক চক্রের মাঝে কৃষকেরা আবদ্ধ ছিল যে তার থেকে বের হওয়াই ছিল মুশকিল। হক সাহেব ছিল উকিল। আইনটি এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছিলো যে সব সুবিধাই ছিল কৃষকের অনুকূলে। এ আইন কার্যকর হওয়ার পর সমগ্র বাংলাদেশে হক সাহেব কৃষকদের কাছে মুকুটহীন সম্রাট  হয়ে উঠলেন। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করার কথা দিয়েছিলেন হক সাহেব। কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় জমিদের সংখ্যাই বেশি তবুও তিনি বিষয়টি একটা সুশৃঙ্খল সমাধানের জন্য কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের চেয়ারম্যান করেছিলেন স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডকে। জমিদারদের পক্ষে ছিলেন বর্ধমানের জমিদার স্যার বিজয় চাঁদ মাহাতাব, গৌরীপুরের জমিদার বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, কৃষক প্রজাদের পক্ষে ছিলেন খাঁন বাহাদুর হাসেম আলী খাঁন, খাঁন বাহাদুর আব্দুল মোমেন ও খাঁন বাহাদুর মোয়াজ্জেম হোসেন। ফ্লাউড কমিশন কাজ করেছিলেন অনেকদিন।

শেরে বাংলা ফজলুল হকের জীবন এত দীর্ঘ ও এত ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত যে তার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে গেলে কয়েক খণ্ডে পুস্তক রচনা করতে হয়। ওনার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে এ পর্যন্ত আলোচনা করলাম। পরবর্তীতে হয়তো আবারও লিখব। তবে এ কথাটা সত্য যে হক সাহেবের মতো ব্রিটিশের সময়ে কোনও নেতাই কোনও প্রেসিডেন্সির প্রিমিয়ার হয়ে মানুষের এত উপকার করতে পারেননি।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com

কলাম

আপনার ত লিখুন :

 
ভারপ্রাপ্ত-সম্পাদকঃ শাকিব বিপ্লব
© কপিরাইট বরিশালটাইমস ২০১২-২০১৮ | বরিশালটাইমস.কম
বরিশালটাইমস মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
ইসরাফিল ভিলা (তৃতীয় তলা), ফলপট্টি রোড, বরিশাল ৮২০০।
ফোন: +৮৮০২৪৭৮৮৩০৫৪৫, মোবাইল: ০১৮৭৬৮৩৪৭৫৪
ই-মেইল: barishaltimes@gmail.com, bslhasib@gmail.com
© কপিরাইট বরিশালটাইমস ২০১২-২০১৮
টপ
  নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এরশাদপত্নী রওশন  'স্বতন্ত্র-মতন্ত্র চিনি না, মাইরের ওপর কোনো ওষুধ নাই'  আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর মনোনয়ন জমা  বাকেরগঞ্জে উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেলেন মিজানুর রহমান  বরিশালে লাইসেন্স না থাকায় ৭ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা  জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধের দাবিতে কলাপাড়ায় র‌্যালি  শান্তি-সমাবেশের ব্যানারে সাদিক আব্দুল্লাহ’র নির্বাচনী মহড়া (!)  বরিশালে অটোপাসের আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে মিছিলে গেলেন প্রধান শিক্ষক  হিজলায় নৌকা প্রতিকের মনোনয়ন পত্র দাখিল সম্পন্ন  বরিশালে মিছিল থেকে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কসহ গ্রেপ্তার ৫