১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

বাকেরগঞ্জ যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে!

বরিশালটাইমস, ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৩৯ অপরাহ্ণ, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বাকেরগঞ্জ যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে!

জিয়াউল হক, বরিশাল। বরিশাল জেলার ১০ টি উপজেলার একমাত্র যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১৯৯৬ সালে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাকেরগঞ্জে নির্মিত হয়। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের বেকার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা। কিন্তু বর্তমানে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। এখন আর আগের মত প্রশিক্ষণার্থীরা ভর্তি হচ্ছেন না।

জেলার একমাত্র এই যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার পর এ কেন্দ্রে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা, মৎস্য চাষ ও কৃষিবিষয়ক আড়াই মাসের চারটি কোর্স ছাড়াও বছরে দুই-তিনটি হাঁস-মুরগি পালন, মাংস প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনের ওপর এক মাসের কোর্স চালু করা হয়।

এখন নানা সমস্যায় জজরিত বাকেরগঞ্জ যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষনার্থীরা। আবাসিক-অনাবাসিক ট্রেডের দুর্বল ব্যবস্থাপনায় সঠিক শিক্ষা দান পদ্ধতি থেকে পিছিয়ে পড়ছে কর্তৃপক্ষ। নোংরা পরিবেশে ক্লাস করতে হচ্ছে প্রশিক্ষনার্থীদের। বর্ষা মৌসুমে ক্লাসরুমের উপরে টিনের চালা থেকে বৃষ্টির পানি পড়ে ক্লাস রুম ভিজে যায়। ক্লাসরুমের বারান্দায় বৃষ্টির পানি জমে থাকে। প্রত্যেকটি ট্রেডেই প্রশিক্ষক, শ্রেণী কক্ষ সংকট সহ ভর্তি সংক্রান্ত নানা জটিলতায় ভুগছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে দক্ষ আত্মকর্মী হিসেবে গড়ে উঠতে নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হচ্ছে প্রশিক্ষার্থীদের।

২১ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত মৎস হ্যাচারি চালু হয়নি। বহুদিনের অযত্নে আর অবহেলায় পানি আর মাছ শুন্য হ্যাচারী জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। পোল্টিহীন খামার ঘর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। গোয়াল ঘর ব্যবহৃত হচ্ছে কর্মকর্দের নিজস্ব গবাদিপশু লালন পালনে। প্রশিক্ষনার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য গবাদি পশু হাঁস মুরগি থাকার কথা থাকলেও তা নেই। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পুকুরে প্রশিক্ষনার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণের জন্য মৎস্য চাষ করার কথা থাকলেও সেটাও রয়েছে মৎস্য শূন্য। অনাবাসিক ট্রেডেও নেই কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন। ডাইনিং রুমে পুরানো ভাঙ্গা হাড়ি পাতিল দিয়ে চালিত হচ্ছে প্রতিদিনের রান্নাবান্নার কাজ। খাবার রুমে ভাঙ্গাচুরা টেবিল থাকলেও নেই বসার চেয়ার।

এখন আবাসিক ট্রেডে গবাদী পশু, হাঁস মুরগি পালন প্রাথমিক চিকিৎসা, মৎস্য চাষ ও কৃষি খাতে প্রশিক্ষক দ্বারা প্রশিক্ষণ আর দেয়া হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যাদের মধ্যে সফলতার গল্পও সৃষ্টি করেছেন অনেকে। বর্তমানে এ কেন্দ্রে ৩ মাস মেয়াদী কোর্সে ১০২ তম ব্যাচের প্রায় ৬০ যুবক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ক্লাসরুমে প্রবেশ করে দেখা যায় ১৪ জন প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে এরমধ্যে ৩ জন মেয়ে রয়েছেন।

ছেলেদের জন্য তিনতলা আবাসিক হোস্টেলের জানালা ও বারান্দার লোহার গ্রিলগুলো মরিচা ধরে খয়ে যাচ্ছে। এমনকি আবাসিক হোস্টেলের রুমগুলোর পলেস্তারা খসে পরছে। ভবনের অনেক কলামের ঢালাইয়ে ধরেছে ফাঁটল। তিনতলার ছাদে বৃষ্টির পানি জমে চুইয়ে নিচের রুমে ঝড়ে পরছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে কেন্দ্রটির দোতলা বিশিষ্ট ছাত্রী হোস্টেল ও কর্মকর্তাদের ডরমিটরিতে।

ছাত্রদের সরকারীভাবে বিছানা, চেয়ার-টেবিল, তোষক ও ফ্যান দেওয়া হলেও সেগুলো অনেক পুরাতন হয়ে গেছে। এত খারাপ অবস্থার মধ্যে ছাত্ররা আবাসিক হোস্টেলে থাকলেও ছাত্রীরা থাকছেন না। ওই হোস্টেলের নিচ তলায় ১০০০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে কেন্দ্রটির দুইজন কর্মচারীর পরিবার কোনোভাবে বসবাস করছেন। একইভাবে ডরমিটরির দোতলায়ও কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা দুটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন।

সীমানা প্রাচীর থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির গার্ড রুম, পানির পাম্প রুম, মসজিদসহ সবকিছুরই বেহাল দশা। এমনকি প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যবহারিকের জন্য তৈরি গোয়াল ঘর, হাঁস-মুরগির শেড, হ্যাচারি-পানির ট্যাংকি সবকিছুই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। গোয়ল ঘরের কোথাও মাটি ডেবে গেছে, দেয়াল ফেঁটে বিশাল ফাঁকা হয়ে গেছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন থেকে মালির পথ শূণ্য থাকায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির পুরো এলাকাতেই জঙ্গলের কারণে রাস্তা দিয়ে হাঁটা চলাও দুরহৃ হয়ে উঠেছে।

চলমান ব্যাচের প্রশিক্ষনার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় অনেক শিক্ষার্থীরা চলে গেছে। সরকারিভাবে আবাসিক শিক্ষার্থীদের খাবারের ব্যবস্থা করা হলেও সেখানে রয়েছে বড় অনিয়। শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের খাবার দেয়া হয়। তাই অনেকে বাহিরের হোটেল থেকেই খাবার কিনে খাচ্ছে। আর এসব কারণে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষার্থীরা এখন আর আসতে চায় না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভবন সংস্কারের জন্য ১৩ লাখ টাকা এবং ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হোটেলের জন্য লেপ, তোশক, বালিশ, বেডসিট ক্রয়ের জন্য ৫ লাখ টাকা। মোট ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। গত মে মাসে বদলি হয়ে যাওয়া বাকেরগঞ্জ যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কো- অর্ডিনেটর মো. মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ভবন সংস্কারে ১৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও নামমাত্র সংস্কার করে বেশিরভাগ টাকা লুটপাট করেছেন তিনি । একইভাবে ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হোটেলের জন্য লেপ, তোশক, বালিশ, বেডসিট ক্রয়ের জন্য বরাদ্দের ৫ লাখ টাকায় নিম্নমানের মালামাল ক্রয় করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করছেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ঐ কো- অর্ডিনেটর মো. মিজানুর রহমান।

প্রতিষ্ঠানটিতে মে মাসে যোগদানকৃত কো-অর্ডিনেটর মিলন চন্দ্র দাস বলেন, দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে কেন্দ্রের এমন দুরাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারপরেও আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণার্থীরাও ভর্তি হচ্ছেন এখানকার বিভিন্ন কোর্সে। তাদের সকল সমস্যার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাধিকবার অবহিত করা হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় সার্ভিস দিতে পারছি না এটা সত্য।

এর জন্য সরকার চালিত লজিস্টিক ব্যবস্থাই দায়ি। প্রশিক্ষণপ্রার্থীদের ডাইনিং রুমে বসার চেয়ার পর্যন্ত নেই এটা সত্যতা স্বীকার করেন তিনি। তবে খামারে কর্মকর্তাদের যে গরু রয়েছে সে বিষয়ে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথাও বলবেন। এবং প্রশিক্ষণপ্রার্থীদের জন্য খামারে গরুর না থাকার কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন একটি লোনের জন্য আবেদন করা হয়েছে লোনটি পেলেই গবাদিপশু ক্রয় করা হবে। কর্তৃপক্ষ অচিরেই এসব সমস্যার সমাধান করে প্রতিষ্ঠানটির সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনবেন এমনটাই প্রত্যাশা সকল প্রশিক্ষনার্থীদের।

 

240 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন