৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

বিপ্লবী সাংবাদিক লিটন বাশার, অসময়ে প্রস্থান?

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:২৪ অপরাহ্ণ, ৩০ জুন ২০১৭

বলাই হয়, মৃত্যুর কোনো ব্যাকরণ নেই; দিনক্ষণ নেই। যে কেউ যেকোন সময় যেকোন জায়গায় মরে যতে পারে। অনেক মৃত্যুই হয়তো অযৌক্তিক, অনাকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু বাস্তবতা বড়ই রুঢ়। ফলে ‘অকাল’ বা ‘অসময়ের মৃত্যু’ শব্দগুলো আমাদের জীবনযাপনে অতি পরিচিত হলেও, মৃত্যুর দূতের কাছে এসব ভাবাবেগের কোনো মূল্য নেই।

চীনের একটি প্রবাদ: ‘কোন কোন মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা, কোন মৃত্যু পাহাড়ের চেয়ে ভারী।’ যে বৃদ্ধ পিতাকে তার মাঝবয়সী সন্তানের লাশ কাঁধে নিতে হয়, তার কাছে মৃত্যু পাহাড়ের মতো। কোন স্বান্ত্বনাই তার চোখের জল থামাতে পারে না। প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে তার যে অশ্রু আর রক্তক্ষরণ হয়, সেটি অনেক সময় তার খুব কাছের মানুষও টের পায় না।

মাঝবয়সী সাংবাদিক লিটন বাশারের মৃত্যুও তার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক বৃদ্ধ বাবার কাছে নিশ্চয়ই এরকম পাহাড়ের মতো। যে বয়সে মানুষের মৃত্যু হলে আমরা স্বাভাবিক বলে মানি বা মানতে পারি, লিটন বাশারের বয়স তেমনটি নয়। তিনি মারা গেলেন আজ (মঙ্গলবার) সকালে, যখন তার বয়স ৪৬ বছর।

লিটন ভাইকে প্রথম দেখি ভোলা শহরে। তিনি তখন বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক ‘আজকের বার্তা’র ভোলা ব্যুরো প্রধান। এটা ২০০০ সালের আগে। তিনি মূলত ক্যারিয়ার শুরু করেন এই পত্রিকাটির স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে, বরিশাল শহরেই। পরে তাকে ব্যুরো প্রধান করে পাঠানো হয় ভোলায়। অসংখ্য সাহসী আর জনগুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টের কারণে সেখানে দ্রুত তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। স্বভাবতই অনেক ক্ষমতাবানের চক্ষুশূলও হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে বলা যায় যে তিনি ভোলা ছাড়তে বাধ্য হন এবং চলে আসেন ঢাকায়। যোগ দেন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায়। কিন্তু রাজধানীর আলো-বাতাসে স্বস্তিবোধ করছিলেন না। শেকড়ের টানে ফিরে যান বরিশাল শহরে। কাজ শুরু ইত্তেফাকের ব্যুরো অফিসে। সবশেষ সেখানেই ছিলেন ব্যুরো প্রধানের দায়িত্বে। একইসঙ্গে ‘দখিনের মুখ’ নামে একটি আঞ্চলিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।

২০০৩ সালের ডিসেম্বরে ঝালকাঠির সাংবাদিক হুমায়ূন কবিরের ওপর বিএনপি ক্যাডারদের হামলার প্রতিবাদ এবং এ বিষয়ে প্রথম আলোয় রিপোর্টিংয়ের কারণে যখন হামলা-মামলার শিকার হয়ে নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তখন যে কয়জন মানুষ মানসিক শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিলেন, লিটন বাশার তাঁদের অন্যতম।

আমরা কেন লিটন বাশারকে মনে রাখব? কারণ তিনি এরকমই বিপদগ্রস্ত সাংবাদিকের পাশে থাকতেন, সাহস জোগাতেন। আমরা কেন লিটন বাশারকে মনে রাখব– এই প্রশ্নটি আমি করেছিলাম বরিশালের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, নাট্যজন সৈয়দ দুলালকে। তার ভাষায়, ‘লিটনকে আমরা মনে রাখব কারণ সে ছিলো সাহসী। যা সত্য ও সঠিক, লিটন সেটিই অকপটে বলতো এবং কাউকে কোন ধরনের পরোয়া না করেই। তার এই ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য তার অনেক শত্রুও ছিল। কিন্তু লিটন সব সময়ই ছিল স্পষ্টভাষী।’

সৈয়দ দুলালের মতে, ‘লিটন ছিলো একজন পেশাদার সাংবাদিক। সততা নিয়ে কাজ করেছে। সত্যের পক্ষে থাকার ব্যাপারে সে ছিল নিরাপস। আমার কথায় হয়তো অনেকের মনক্ষুণ্ন হবে, কিন্তু আমি বলি, এখনকার তরুণদের মধ্যে আমি লিটনের মতো এত সাহসিকতা আর স্পষ্টবাদিতা দেখতে পাই না।’

পারিবারিক বা অফিসের কাজে যখনই বরিশাল যেতাম, খুব ব্যতিক্রম না হলে লিটন ভাইয়ের অফিসে এক কাপ চা খাওয়া ছিল অবধারিত। তবে তার সাথে সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনা হত খুবই কম। এমন প্রাণোচ্ছ্বল মানুষের সাথে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় না। আগামী ২ জুলাই বরিশালে যাব। ইচ্ছে ছিল তার সাথে একটু আড্ডা দেব। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি আর দিলেন কই?

বরিশাল শহরে যারা (সিনিয়র-জুনিয়র) সাংবাদিকতা করেন, তাদের মধ্য থেকে লিটন বাশারকে আমরা সহজেই আলাদা করতে পারতাম তার নেতৃত্বের কারণে। সাংবাদিকদের যেকোন দাবি-দাওয়া, সুবিধা-অসুবিধায় তার নেতৃত্ব ছিল অসম সাহসী। তিনি যখন বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, সেই আমলের সঙ্গে অতীতের যেকোন সময়ের পার্থক্যটা খুব স্পষ্ট; এটা লিটন বাশারকে যারা অপছন্দ করেন, সম্ভবত তারাও স্বীকার করবেন। সাংবাদিকতার বাইরেও প্রচুর সামাজিক কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িত ছিলেন।

লিটন ভাইয়ের ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখছি, সবশেষ ২৩ জুন তিনি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন জাকাত ও ফিতরা সম্পর্কে। যেখানে লিখেছেন: ‘যাকাত -ফেতরা ও দান খয়রাত পেশাদার ভিক্ষুক ও চাঁদাবাজ মোল্লাদের পরিবর্তে আপনার আশে-পাশে কিছু মানুষ আছে যারা লাজ লজ্জায় কারো কাছে কিছু চাইতে পারেন না। হাত পেতে নিতেও পারেন না আবার খেতেও পারেন না। নিজের অবুঝ সন্তানদের লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেন না। শুধু কষ্ট বুকে চাপা রেখেই এদের জীবন চলে যায়। সকলের অগোচরে নিরবে চোখের জল ফেলেন। পেশাদার ভিখারীরা আপনার অপরিচিত হলেও তাদের দক্ষ উপস্থাপনায় কল্পকাহিনী আপনার আমার মন গলে যায়। অথচ কতটা সত্য মিথ্যা আমরা যাচাই করি না। তাই মানুষের সমস্যা জেনে নিকটবর্তী সমস্যাগ্রস্ত লোককে সাহায্য করাই উত্তম বলে আমার মনে হয়।’

জাকাত-ফিতরার নামে যে লোক দেখানেপনা আর নৈরাজ্য চলে, তার সমাধান তিনি দিচ্ছেন খুব সহজে। যদিও এটা সহজ নয়। সামাজিক এরকম নানা অসঙ্গতির বিষয়ে তিনি ফেসবুকে লিখতেন-যা তিনি বিশ্বাস করতেন, যা তিনি সংবাদপত্রের পাতায় লিখতে পারতেন না।

লিটন বাশারের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। তবে একথাও বলতে চাই, এরকম একজন মাঝবয়সী সাংবাদিকের মৃত্যু শুধু ওই পরিবার বা ম্যাক্রো লেভেলে গণমাধ্যমেরই ক্ষতি নয়; বরং মাইক্রো লেভেলে ওই প্রতিষ্ঠানটিরও বড় ক্ষতি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণ সাংবাদিকদের মৃত্যু প্রমাণ করে, কর্মক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপের পরও তাদের অনেকেরই পর্যাপ্ত মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই এটা জরুরি। কেননা সাংবাদিকরা যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলছেন, যে সাংবাদিকরা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখছেন, তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কাজটা নিতে হলে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। না হলে আখেরে ক্ষতিটা ওই পুঁজিরই।

44 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন