বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১১:৪০ অপরাহ্ণ, ১১ আগস্ট ২০১৬
মার্ক টোয়েনের মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে তিন বার ছাপা হয়েছিল। এখানে মিডিয়ার সাফল্য তিন ভাগের এক ভাগ এবং ব্যর্থতা তিন ভাগের দুইভাগ। কারণ তিনি মারা গেছেন মাত্র একবার- ১৯১০ সালে।
১৮৯৭ সালের ঘটনা। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক জার্নালের লন্ডন প্রতিনিধি ফ্রাঙ্ক মার্শাল হোয়াইট চাউর হয়ে যাওয়া মৃত্যু সংবাদটি সম্পর্কে মার্ক টোয়েনের বক্তব্য কি তা জানার জন্য কর্তৃপক্ষের দ্বারা আদিষ্ট হয়েছিলেন। মৃত্যুর গুজব আগেই ছড়িয়েছিল। তবে পত্রিকায় মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছে শুনে মার্ক টোয়েন মার্শাল হোয়াইটের কাছে একটি লিখিত প্রতিক্রিয়া পাঠান। তিনি লিখলেন, “আমার মৃত্যু সংবাদটি ছিল অতিরঞ্জিত। (The report of my death was an exaggeration.)”। নিউ ইয়র্ক জার্নাল টোয়েনের এই বক্তব্য ছাপিয়েছিল।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের মত প্রভাবশালী পত্রিকাও একবার মার্ক টোয়েনের ভুল মৃত্যু সংবাদ ছাপিয়েছিল। মার্ক টোয়েনের পানসি নৌকাটি অতিমাত্রায় কুয়াশার কারণে সমুদ্রে লোক চক্ষুর আড়ালে চলে গেলে ১৯০৭ সালের ৪ জানুয়ারি নিয়র্ক টাইমসে বলা হয় মার্ক টোয়েন সম্ভবত সমুদ্রে ডুবে গেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় পরদিনই পত্রিকাটির তথ্য ভুল প্রমাণ করে একটি রসিকতাপূর্ণ বর্ণনা প্রদান করেন মার্ক টোয়েন। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত টোয়েনের সেই লেখার শিরোনাম ছিল: “MARK TWAIN INVESTIGATING: And If the Report That He’s Lost at Sea is So, He’ll Let the Public Know.”
মার্ক টোয়েন যেমন রসিক ছিলেন বাংলায় তার পরিচিতিও তেমনি সরস। তাঁর লেখার এক লাইন না পড়েও লাখ লাখ বাঙালি মার্ক টোয়েনের নাম জানে এবং উচ্চারণ করে। বিদেশী লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে তার নামটিই বাংলায় সর্বাধিক উচ্চারিত। কৃতিত্ব ভুপেন হাজারিকার।
পৃথিবীর সর্বকালের সেরাদের তালিকায় স্থান পাওয়া এই মার্কিন নাগরিকের ভুল মৃত্যু সংবাদ সে দেশে কিরকম প্রভাব ফেলতে পারে? ভুল রিপোর্টিং এর শাস্তি কি? না, পত্রিকাকে কিংবা কোনো সাংবাদিককে শাস্তি দেয়নি সরকার। এটা ১০০ বছর আগের আমেরিকার চিত্র।
এর বিপরীতে ২০১৬ সালের বাংলাদেশ কেমন? “বিমান দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয়ের মৃত্যুর গুজব!” শিরোনামে বাংলামেইল ২৪ ডট কম গত রবিবার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের মৃত্যুসংবাদ দিয়ে শিরোনাম করেছে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। নিউজ পোর্টালটি হচ্ছে— টুডেনিউজ৭১.কম। শিরোনাম— বিমান দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী পুত্র “জয়” নিহত।”
এই খবর ছাপা হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বাংলামেইল২৪ডটকমের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মো. সাহাদাত উল্যাহ খান, নির্বাহী সম্পাদক মাকসুদুল হায়দার চৌধুরী ও সহ-সম্পাদক প্রান্ত পলাশকে ধরে নিয়ে যায় র্যাব। তাদের জেলে পাঠানো হয়েছে। বাংলামেইলের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে র্যাব।
বাংলা মেইলের সংবাদ কতজন পাঠক পড়ে তা আমার জানা নেই। আমার বিশ্বাস সজীব ওয়াজেদ জয়ের ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজের যে পরিমাণ সার্কুলেশন আছে তার সম পরিমাণ সার্কুলেশন ঐ অনলাইন নিউজ পোর্টালটির ছিলনা। জয় যদি নিজের পেজে সরস বা নিরস ভাষায় দুই/ দশ লাইন লিখতেন সেটাই কি এধরণের গুজবকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হতোনা?
র্যাব কর্মকর্তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কাছে বাহাদুরি নেয়ার জন্য নিজেরাই এই কাজটি করেছে নাকি এরকম অ্যাকশনের পক্ষে রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল তা আমার জানা নেই। তবে এত বেশি শক্তি প্রয়োগের লাভালাভ নিয়ে আমি চিন্তিত। তিনি বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং প্রচলিত বিশ্বাসে তিনি সম্ভাব্য পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। তার ব্যাপারে (ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত) একটি ভুল নিউজ হয়েছে। তার ফলাফল এই! আমি ভয় পাচ্ছি! একজন সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদ এতে উপকৃত হচ্ছেন, না বিতর্কিত হচ্ছেন? তিনি নিশ্চয় প্রজ্ঞাময়।
শক্তিমান মানুষদের ভুল মৃত্যু সংবাদ ছাপানোর অসংখ্য নজির পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের মৃত্যুর ভুল খবর প্রচার হয়েছিল। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ভুয়া মৃত্যু সংবাদ সিএনএন এ প্রচারিত হয়েছিল।
মৃত্যুর আগেই পোপ জন পলের (দ্বিতীয়) মৃত্যু সংবাদ ১৯৮১ এবং ২০০৩ সালে তিন দফায় প্রকাশ হয়েছিল। ফক্স নিউজ এবং সিএনএন টেলিভিশন পোপের ভুল মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করে বিশ্বব্যপি আলোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল ।
যারা দি রাইম অব এনসিয়েন্ট মেরিনার পড়েছেন কিংবা যারা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র তারা সবাই এস.টি. কলেরিজের নাম জানেন। একদিন একটি হোটেলে বিখ্যাত এই কবি দেখলেন তার সামনেই পত্রিকা হাতে এক ব্যক্তি তার মৃত্যু সংবাদ পড়ছে। তিনি পত্রিকাটি দেখতে চাইলে লোকটি বলল, “দেখুন, কি একটা দু:খজনক ও অস্বাভাবিক খবর ! এতবড় সাফল্যের পর কলেরিজ শেষে আত্মহত্যা করল! অবশ্য বেচারা কলেরিজ সব সময় একটা অদ্ভুত ও পাগল প্রকৃতির লোক ছিল।”
উত্তরে কলেরিজ বললেন, “আসলেইতো অস্বাভাবিক খবর ! কলেরিজ আত্মহত্যার পরও আপনার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে !” প্রকৃত ঘটনা হল, একটি লোক গাছ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল। তার গায়ের জামায় এসটি কলেরিজের নাম লেখা ছিল। কলেরিজের ধারণা হল লোকটি সম্ভবত: তার জামা চুরি করেছিল।
২০০৯ সালে আয়রন ল্যাডি খ্যাত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মৃত্যু সংবাদ চাউর হয়ে গিয়েছিল একটি টেক্সট ম্যাসেজের মাধ্যমে। এই তথ্যের ভিত্তিতে ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার যখন শোক বার্তা তৈরি করছিলেন তখন তাকে জানানো হল, শোকবার্তা প্রদানের দরকার নেই। মার্গারেট থ্যাচার মারা গেছেন ঠিকই। তবে এটা অন্য থ্যাচার। তিনি ব্রিটেনের পরিবহণ মন্ত্রী জন বায়ার্ডের পোষা বিড়াল; প্রধানমন্ত্রী নন।
বাংলাদেশেও এরকম ঘটনা বিরল নয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। আওয়ামীলীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা আব্দুর রাজ্জাক মারা যাওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জন্য শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের পিআইডি থেকেই সেই খবর সরবরাহ করা হয়েছিল এবং সেই সংবাদ রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বিএসএস প্রচার করেছিল। অতি সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও তার দলের একজন নেতা মারা যাওয়ার আগেই মিডিয়ায় শোক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এরকম ভুল মানুষ মাত্রের হতে পারে। কিন্তু লঘু পাপে গুরুদণ্ড দিলে ন্যায়দণ্ডে কালিমা লিপ্ত হয়। ন্যায়দণ্ডের ধারক বাহকরাই এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।
একজন ভাল রাজনীতিবিদ সাংবাদিকদের হয়রানি করে না। এই তিন সাংবাদিককে মুক্তি দেয়া হবে এবং বাংলামেইল খুলে দেয়া হবে সেই প্রত্যাশা করি। সজীব ওয়াজেদ জয় নিজে উদ্যোগ নিয়ে এই তিন সাংবাদিককে মুক্ত করলে এতে তার ইমেজ বৃদ্ধি পাবে। “The report of my death was an exaggeration” -শুধুমাত্র এরকম একটি বাক্য লিখেই এধরণের বিষয় নিষ্পত্তি করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী পুত্র।
পুলক ঘটক, সাংবাদিক