সাভারে বেদেপল্লীতে যৌতুকবিহীন ব্যতিক্রমী গণবিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমানের উদ্যোগে ও সাভারের পোড়াবাড়ি উত্তরণ ফ্যাশনের আয়োজনে শুক্রবার পোড়াবাড়ি ঈদগাঁহ মাঠে এ বিয়ের আয়োজন করা হয়।
ব্যতিক্রমী এ বিয়ের আয়োজন দেখতে ওই এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়।
বেদে সম্প্রদায়ের উত্তরণ ফ্যাশনের তিন নারীশ্রমিক মাছেনা (১৯), লিমা খাতুন (১৯) ও মজিরন আক্তারের (১৮) বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। পোড়াবাড়ি এলাকার বাবুল মিয়ার মেয়ে মাছেনার সঙ্গে সাপুরে কাওছার (২২)-এর, আরকান মিয়ার মেয়ে লিমার সঙ্গে গাড়ির চালক সাদ্দাম হোসেন (২২)-এর ও ওমরপুর এলাকার মোস্তাকিনের মেয়ে মজিরনের সঙ্গে মুদি ব্যবসায়ী সাদ্দাম মিয়ার (২৩) বিয়ে দেওয়া হয়।
এ সময় তাদের বিয়ে পড়ান কাজী মাওলানা আব্দুল হাবিব। বিয়ের পরে পুলিশ ও উত্তরণ ফ্যাশনের উদ্যোগে নব দম্পতিদের উপহার হিসেবে নগদ অর্থ ও আসবাবপত্র দেওয়া হয়।
মজিরন আক্তারের বাবা মোস্তাকিন মিয়া জানান, দুই বছর আগে অভাব দরিদ্রতার কারণে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তখন মজিরনের বয়স কম হওয়ায় হাবিব স্যার আমার বাড়িতে বিয়েটি স্থগিত করে দেন। এ সময় তিনি বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে আমাকে বোঝান এবং মেয়ের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেন। তার দেওয়া কথা রাখতেই মেয়ের প্রাপ্ত বয়স হওয়ার পর আমাদের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গেই মজিরনের বিয়ে হচ্ছে। তাদের প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন হাবিব স্যার।
পোড়াবাড়ি সমাজকল্যাণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক রমজান আহমেদ জানান, হাবিব স্যার ঢাকা জেলার এসপি থাকা অবস্থাতেই বেদেদের জীবন-মান উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তার হাত ধরেই বদলে গেছে বেদেপল্লী। উত্তরণ নামের একটি পোশাক তৈরি কারখানা স্থাপন করা হয়েছে এখানে। যেখানে কাজ করছেন অসংখ্য বেদে নারী। নিজেরাই হয়েছেন সচ্ছল।
মজিরন আক্তারের স্বামী ছাদ্দাম হোসেন জানান, আজকের দিনটি আমাদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আমাদের বিয়েতে ১০ হাজার টাকা করে উপহার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের বড় বড় মানুষেরা আমাদের বিয়েতে অতিথি হয়ে আসায় আমরা খুবই আনন্দিত।
পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজ হাবিবুর রহমান জানান, আমি ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে অপরাধ দমনে খোঁজ নিতে বেদে পল্লীতে যাই। তখন বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনেরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। সমাজ স্বীকৃত কোনো কাজ করতো না তারা। বিভিন্ন জায়গায় সাপ খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। গত বছর দুটি মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল। বয়স কম থাকায় আমরা বিয়ের পিঁড়ি থেকে তাদেরকে তুলে নিয়ে গেছি। তাদেরকে বুঝিয়েছি বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে। আজকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর সেই বর এবং সেই কনের সঙ্গেই বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। আগে কাবিন রেজিস্ট্রি ছাড়াই বেদে সম্প্রদায়ে বিয়ে সম্পন্ন হলেও আজকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী সরকারি আইন মেনে বৈধভাবে বিয়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে।
হাবিবুর রহমান জানান, তাদের বিয়েতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের গণ্যমান্য লোকজন উপস্থিত থাকায় তারা অত্যন্ত আনন্দিত। তারা হয়তো কোনোদিন কল্পনাও করেননি তাদের বিয়েতে এত লোকজন হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি জানান, বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনেরা চিন্তাচেতনা ও সামাজিকভাবে যাতে অন্যদের মতো মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে। শিক্ষাদীক্ষা, অর্জনের মাধ্যমে কুসংস্কার ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বের হয়ে এসে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে এটাই তার মূল লক্ষ্য।
আয়োজিত বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন-ঢাকা-১৯ আসনের এমপি ডা. এনামুর রহমান, ঢাকা-২০ আসনের এমপি আব্দুল মালেক, ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান, গাজীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল শেখ, সাভার মডেল থানার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মাহাবুবুর রহামনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।