বরিশাল: সংবাদ প্রকাশের পর অবশেষে ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জনতা বাজার এলাকায় হত্যা মামলার আসামির বাড়িতে স্থাপিত অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ওই বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ভোলা সদর মডেল থানার ওসি মীর খায়রুল কবির এ খবর নিশ্চিত করে জানান, একটি জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর রোববার রাজাপুরের নাসির সরদারের বাড়ি থেকে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তবে, প্রতিদিন পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানসহ কয়েকজন পুলিশ রাজাপুরে অবস্থান নিচ্ছে।
ওই এলাকায় এখন স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলেও জানান তিনি। এদিকে, থানায় মামলা না নেওয়ায় স্কুলছাত্র হত্যার চার দিন পর আজ রবিবার আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহত স্কুলছাত্র নোমানের বাবা বেল্লাল জমদ্দার বাদী হয়ে ভোলার অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের বাড়ির মালিক নাসির সরদারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য ভোলা সদর মডেল থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
রাজাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সবুজ জমদ্দার ও আবদুল মতিনসহ স্থানীয়রা জানান, গত ইউপি নির্বাচনের সময় ওই এলাকার ওবায়দুল হক বাবুল মোল্লা স্কুলে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। নির্বাচনের পর ক্যাম্পটি প্রত্যাহারের কথা থাকলেও নৌকা প্রতীকের পরাজিত চেয়ারম্যান মিজান খাঁ তদ্বির করে গত ১৭ মার্চ তার কর্মী হত্যা ও ডাকাতিসহ একাধিক মামলার আসামি নাসির সরদারের বাড়িতে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
আর সেই সুযোগে ওই পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশের সহযোগিতায় নাসির এলাকার সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল। নাসির পুলিশের সহায়তায় সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ব্যাপক চাঁদাবাজি করত। মানুষকে মামলার ভয় দেখিয়ে পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে চাঁদাবাজি ও নির্যাতন চালাত। রাজনৈতিক মামলাসহ বিভিন্ন মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করত। এক পর্যায়ে ওই পুলিশ ক্যাম্পটি টর্সাল সেলে পরিণত হয়ে ওঠে। এতে ক্রমেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ।
তারা আরো জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজাপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে জনতা বাজারস্থ অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের কয়েকজন পুলিশ সাদাপোশাকে রাজাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি মিজানুর রহমানকে আটকের পর জনতা বাজারে নিয়ে বেদম মারধর করে। পরে তাকে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এ খবর পেয়ে ছাত্রদল নেতার স্বজনসহ স্থানীয় লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে রাতে অস্থায়ী ওই পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে হামলা চালায়। তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে অস্থায়ী ক্যাম্পের দরজা-জানালা ভাঙচুর করে। এ সময় ক্যাম্পের কয়েকজন পুলিশ জনতাকে লক্ষ করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ সময় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থানরত ওই বাড়ির মালিক নাসির নিজেই পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে জনতাকে লক্ষ করে গুলি ছোরলে গুলিবিদ্ধ হয়ে স্কুলছাত্র নোমান (১৮) ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
এতে গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় অন্তত ৩০ জন। পরে ভোলা সদর মডেল থানার ওসি মীর খায়রুল কবিরের নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই ঘটনার পর রাজাপুরের অস্থায়ী ক্যাম্পের ১০ পুলিশকে পুলিশ ক্যাম্পের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ভোলা পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়। অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের মালিক নাসিরকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ঘটনায় বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ উপ-পরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আকরাম হোসেন ঘটনার পরদিন শুক্রবার ভোলার রাজাপুরের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি জনতা বাজারে এলে তার সামনেই শত শত নারী-পুরুষ ঘটনার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে। তারা জড়িত পুলিশ সদস্যদেরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত ও ঘটনার মদদদাতা অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের (বাড়ির মালিক) নাসিরসহ জড়িতদের ফাঁসির দাবি করেন। অতিরিক্ত ডিআইজি স্থানীয়দের বক্তব্য শোনেন। এ সময় তার সামনেই স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতিসহ একাধিক মামলার আসামি নাসির তার বাড়িতে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসিয়ে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক চাঁদাবাজি করে আসছিল।
তারা আরো জানান, নাসির, মিজান খাঁ, ওহাব আলী, বাকেরের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এ এলাকার সাধারণ মানুষ। আর ওই চার সন্ত্রাসীকে সহযোগিতা করতো পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যরা। স্থানীয়দের বক্তব্য শোনে অবিলম্বে রাজাপুরের নাসিরের বাড়ি থেকে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প প্রত্যাহার করার আশ্বাষ দেন অতিরিক্ত ডিআইজি আকরাম হোসেন। এ নিয়ে একটি জাতীয় পত্রিকায় ”হত্যা মামলার আসামির বাড়িতে পুলিশ ক্যাম্প!” শিরানোমে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ওই দিন থেকেই হত্যা মামলার আসামি নাসিরের বাড়ি থেকে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প সরিয়ে ফেলা হয়।
তবে নিহত স্কুলছাত্র নোমানের বাবা বেল্লাল জমদ্দার, মিজানুর রহমান ও আরিফুর রহমানসহ স্থানীয়রা জানান, বেশ কয়েকজন পুলিশ এখনো হত্যা মামলার আসামি নাসিরের বাড়িতে অবস্থান করছে।
এদিকে এ বিষয়ে মিজান খাঁর কর্মী রাজাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বলেন, রাজাপুরের ঘটনার প্রতিবাদে রবিবার একটি প্রতিবাদ সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে। তাই মিজান খাঁ থানায় এসেছেন। কিন্তু রবিবার সেই প্রতিবাদ সমাবেশ হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা।