বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ, ১২ অক্টোবর ২০১৬
এগারো দিন থেকে পনের দিন পেড়িয়ে এবারে আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে, ২২ দিন করা হয়েছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসূমে মা ইলিশ রক্ষার কার্যক্রম। এনিয়ে জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন টানা ২২ দিন সাগর-নদীতে জাল ফেলা বন্ধ থাকায়, এর সুফল ভোগ করবে ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা। এটি পূর্ণিমার আগের ৫ দিন এবং পরের ৫ দিন মিলিয়ে মোট ১০ দিন হলেই বেশ হতো। তবে চলতি বছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রজনন কালের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে বলে জানালেন, ইলিশ গবেষক ড. মো আনিচুর রহমান। এদিকে বরাদ্দ এখনো আসেনি বলে মা ইলিশ রক্ষার প্রচারণা কাগজে-কলমে আর নামে মাত্র হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠায় তা অস্বীকার করেন সিনয়র সহকারী পরিচালক আজিজুল হক। টাস্কফোর্সের সভা নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে বলে জানান তিনি।
সমুদ্রে মাছ ধরা এফবি তমা ফিসিং বোটের মাঝি ভোলা সদর উপজেলার রুহুল আমিন মাঝি (৫৩) বলেন, ৩৮ বছর ধরে সাগরে ইলিশ ধরেন তিনি। সারা বছরই কম-বেশী ডিম ছাড়লেও মূলত আশ্বিণ মাসের পূর্ণিমাই হলো প্রধান। ডিম ছাড়ার সময় হলে ইলিশ মাছ সাগর থেকে মিঠা পানিতে উঠে আসে। ডিম ছেড়েই ফের নিজ মর্জি অনুযায়ী দল বেঁধে ফিরে চলে। এই হিসেবে পূর্ণিমার আগের ৫ দিন ও পরের ৫ দিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেই যথেষ্ট। যা নিষেধাজ্ঞা শুরুর বছর ৭ দিন থাকলেও এখন তা ২২ দিন করেছে। এতে করে আমাদের মত জেলেদের অভাব অনটন সঙ্গী করেই চলতে হবে। পাথরঘাটার লিটন কোম্পানীর ট্রলার মাঝি নূর মোহাম্মদ বলেন, তাদের দু’খানি বোটে ২৮ জন জেলের মধ্যে ৮ জনে কার্ডের চাল পাবার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। বৈশাখ থেকে অপেক্ষার পর ভাদ্র মাস জুড়ে বেশ মাছ পড়তে থাকায় এখন ২২ দিনের দীর্ঘ এই অভিযান তাদের রোজগারে বড় ধরণের আঘাত হানবে।
ফিসিং বোটের মালিক বাপ্পি দাস জানান, প্রজনন মৌসূমে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা পনের দিন থাকলেই ভালো হতো। কারণ ২২ দিন বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় জাল ফেলা বন্ধ থাকায় ভারত ও মিয়ানমারের জেলেদের জালে বাড়তি ইলিশ মিলবে। এছাড়াও মহিপুরের বাইরে পশ্চিমে ১৫ ঘন্টা পথ চালালে বঙ্গবন্ধু চরের নামায় সন্ধ্যার পর থেকে ভারতীয় জেলেরা অবৈধভাবে প্রবেশ করে ইলিশ আহরণ করবে। ভারতীয় জেলেদের বোটে ট্রলিং জাহাজের ন্যায় অত্যাধুনিক পদ্ধতি আছে। তাদের বোটে জাটকা ধরার কারেন্ট জাল, আর ২৪ হাত খাড়ার সাদা জাল ও গভীর সমুদ্রে ফেলার জন্য ৮০ হাতের ওপরের লাল জাল রয়েছে। একতরফা নিষেধাজ্ঞার এই সুযোগে ভারতের জেলেরা বাড়তি মাছ পেয়ে লাভবান হবেন বেশি। লিটন মাহমুদ নামে পাথরঘাটা মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য বলেন, কোস্টগার্ডের টহল থাকে পাথরঘাটা থেকে ৬ ঘন্টাপাড়ি দেয়া পথে। গভীর সাগরে দেড়’শ বাম পানি যেখানে ভারতের ফিসিং বোট সেখানে মাছ ধরে। ওই এলাকায় নৌবাহিনী যায় কদাচিৎ। ভাবছিলেন পুরো ভাদ্র মাস জুড়ে ইলিশের দেখা মেলায় বিগত বছরের ১৮ লাখ টাকা দেনার মধ্যে খরচ শেষে ৩ লাখ টাকার দেনা শোধ করেছিলেন। তবে নিষেধাজ্ঞা অভিযান গেল বছরের চেয়ে আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে দেয়ায় মধ্য কার্তিকে ইলিশ মিলবে কিনা এনিয়ে সংশয়ে রয়েছেন এই ব্যবসায়ী।
আঞ্চলিক মৎস্য অফিস থেকে পাওয়া তথ্য হলো, বিভাগের ৬ জেলায় এবারে ইলিশ ধরা নিষেধাজ্ঞার সময়ে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩ পরিবার ২০ কেজি করে ভিজিএফ চাল পাবেন। তবে এই পরিসংখ্যানের বাইরেও সম সংখ্যক শ্রমিক রয়েছেন এই কাজের সাথে জড়িয়ে একথা বলেন জেলা মৎস্য আড়ৎদার এসোসিয়েশনের সভাপতি অজিত কুমার দাস। উপমায় বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডের পাইকারী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ৩ হাজার শ্রমিকের কথা তোলেন, যারা এই ২২ দিন বেকার বসে থাকবেন। তাদের সরকারী চালের সহায়তার আওতায় আনা হয়নি। এই অভিযান বেশি দিন হওয়াতে ব্যবসায়ীদেরও লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখতে বেগ পেতে হবে।
অভিযানের সময় দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে জেলে ও ব্যবসায়ীদের এমন প্রশ্নের জবাবে চাঁদপুর ইলিশ গবেষণা প্রকল্প উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রকল্প পরিচালক ড. মো.আনিচুর রহমান বলেন, সময় নিয়ে তারা এক্সপেরিমেন্ট করছেন। গেল বছর ৪ দিন সময় বাড়িয়ে ১৫ দিন করায় মৎস্য বিভাগের হিসেব অনুযায়ী ৩ লাখ ৮৭ হাজার মে.টন ইলিশ আহোরিত হয়েছিল। আর এবছর ইতিমধ্যেই সাড়ে ৪ লাখ মে.টন ইলিশ পাওয়া গেছে, সামনে আরো মিলবে। এই হিসেবে এবার ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসূম আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে দেখা হচ্ছে মাছের সংখ্যা কেমন বাড়ে। আর ইলিশের ডিম ছাড়ার বিষয়টি নির্ভর করে পানির প্রবাহ, নদীর গভীরতা আর বর্ষার ওপরে। এবছর আবহাওয়া অনুকুলে বলে তিনি মনে করছেন গেল বছরের ৩৬ দশমিক ৬ ভাগ ছাপিয়ে ৪০ ভাগের কাছাকাছি মা ইলিশ ডিম ছাড়বে বলে আশা প্রকাশ করছেন। এই কর্মকর্তা আরো বলেন, মিয়ানমার প্রজনন এলাকা চিহ্নিত করেছে আর ভারত ইতিমধ্যেই প্রজনন মৌসূমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা সময় ঠিক করেছে। তবে তাদের প্রজনন কাল আমাদের চেয়ে আগে অথবা পিছে হওয়াতে সময় একত্রে নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।
এবারে প্রধান প্রজনন মৌসূমে মা ইলিশ ধরা বন্ধের নিষেধাজ্ঞায় প্রচার প্রচারণা নিয়ে কথা উঠেছে। জেলার মেহেন্দগঞ্জ ও হিজলা উপজেলা মেঘনা নদীর তীরবর্তী। যেখানে ইলিশের দেখা মেলে বেশী সেখানে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতির জন্য প্রচারের জন্য মাইকিং, পথসভা, লিফলেট বিতরণ, পোষ্টার, ব্যানার এসব হয়েছে অনেকটা কাগজে কলমে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এনিয়ে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, তিনি টাস্কফোর্সের সভা করেছেন। ৫ ও ৭ অক্টোর সচেতন সভা করেছেন এবং পথসভা করেছেন ৬টি। সাড়ে ৬’শ লিফলেট ফটোকপি করে বিলি করেছেন। ইলিশ ধরা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করা হিজলা উপজেলায় ১ দিন মাত্র মাইকিং হয়েছে বলে জানালেন সেখানের বাসিন্দারা। এছাড়া প্রচারে আর কোন ব্যবস্থা নেয়নি মৎস্য বিভাগ। এই উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার বলেন, তিনি আজ বিকেলেও হরিনাথপুর বাজারে সভা করেছেন।
প্রচারণার অভিযোগ নিয়ে সিনয়র সহকারী পরিচালক আজিজুল হক বলেন, অভিযানের বরদ্দ এখানো আসেনি বলে তাদের কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তারপরও তিনি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দে দিয়েছেন সব ঠিকভাবে চালিয়ে যেতে। বরাদ্দ পৌঁছলেই তারা পেয়ে যাবেন। আর ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষার অভিযান সফল করতে বিভাগের ৬ জেলায় ৮৭ জনের বাড়তি লোকবল আনা হয়েছে। এছাড়াও পরিচালকের কার্যালয়থেকে ৯ জনের টিম থাকছে মাঠে। তিনি মনে করেন অভিযান ভালো ভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন।