কানামাছি খেলার দিন হয়তো গত হয়েছে আগেই। হারিয়ে গেছে হাডু-ডু খেলার মতো খোলা মাঠ। চোর-পুলিশ খেলায় ‘চোর’ হবার সঙ্গী মেলাও এখন ভার। প্রতিদিনই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মশগুল নগর শিশুরা। ইনডোরে নয়, পিসিতে বা মোবাইলে।
শহরের গন্ডি পেরিয়ে এখন গ্রামেও গেম পৌঁছে গেছে মুঠোফোনে। বাবল বল, ক্যান্ডি ক্র্যাশ ও ক্লাস অব ক্লান্স এর মতো আঙুলের ছোঁয়ায় উত্তেজনা ছড়ানো গেম। আর পিসি ব্যবহারকারীদের কাছে কল অব ডিউটি, মেডেল অব অনার, ব্যাটল ফিল্ড, টম ক্লায়ান্সই যেন অবলম্বন।
এসব খেলায় উত্তেজনা থাকলেও কী যেন নেই! শেকড়ের টানের নিদারুণ অভাব। দিন শেষে এ যেনো গড়পড়তা বিনোদিত হবার উপকরণ; খেলা-খেলা। অনুভূতিহীন এক ক্রীড়া। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরেই বহেমিয়ান ক্রীড়ায় বেড়ে উঠছিলো প্রযুক্তি প্রজন্ম। অবশ্য সেই অভাবটা কিছুটা হলেও ঘুচাতে শুরু করেছে আমাদের টেক-যোদ্ধারা।
পিসি আর মুঠোফোনেই প্রকাশ করছেন বইয়ের পাতার ভাঁজে চাপা পড়ে থাকা গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উপজীব্য করে তৈরি করছেন গেম/অ্যাপ্লিকেশন। ঝড় তুলে শুরুর গেমটি হারিয়ে গেলেও ইতিমধ্যে প্রযুক্তি প্রজন্মের কাছে আলোড়ন তুলেছে তিনটি গেম। আর তা খেলছে দেশের সীমানার ওপারের শিশুরাও।
লিবারেশন ৭১
মাইক্রোসফট উইন্ডোজ প্ল্যাটফর্মে তৈরি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রথম পিসি গেম লিবারেশন ৭১। গেমটি খেলতে গিয়ে যোদ্ধার প্রয়োজন হবে না অত্যাধুনিক গেজেটের। কিংবা হাই-ফাই অস্ত্র। আর আধুনিক যুদ্ধ ট্রেনিং; তারও দরকার নেই। প্রয়োজন হবে শুধু দেশের জন্য অসীম ভালোবাসা এবং সাহসী অন্তর। লুঙ্গী পেঁচিয়ে আর শরীরে শুধু একটি সেন্ডো গেন্জি জড়িয়ে নেমে পড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধে!
দুর্দান্ত এই ফাস্ট পারসন শুটার ভিডিও গেমটি তৈরি করে ‘টিম ৭১’ দল। গেম তৈরির শুরুটা হয়েছিলো ২০১২ সালে। ফেসবুক ভিত্তিক গেমার কমিউনিটি গ্রুপ ‘গেমার জোন’ এর কয়েকজন তরুণ উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গেম তৈরির। এই দলে ছিলেন ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী। এরা সবাই তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। পড়া-লেখার চাপ আর আর্থিক অস্বচ্ছলতার বাধা পেরিয়ে মাইক্রোসফট উইন্ডোজ প্লাটফর্মের জন্য তারা এই ফাস্ট পারসন শ্যুাটার ভিডিও গেমটি সাজায় মুক্তিযুদ্ধের ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (মিশন) নিয়ে।
২ বছর পর ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ অবমুক্ত হয় ‘লিবারেশন ৭১’এর একটি ডেমো। এরপর ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয় সিক্যুয়াল গেমটির প্রথম পর্ব ‘রাজারবাগ’। এসময় আবেগ আর বাস্তবতার সংকীর্ণ পথ ধরে হাটতে গিয়ে কিছুটা হোঁচট খেতে হয় তাদের। জীবনের বাস্তবতায় স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকেই ফিরে যান ক্যারিয়ার গঠনে। ফলে সামনের দীর্ঘ পথ হাঁটতে একটি নিবন্ধিত গ্রুপ হিসেবে পেশাদার গেম ডেভেলপার হিসেবে আবির্ভূত হয় টিম ৭১।
চার স্বোচ্ছাসেবী বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর বনশ্রীতে অফিস নিয়ে নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করেন টিম ৭১’র প্রধান নির্বাহী ফারহাদ রাকিব। তিনি ব্রেকিংনিউজকে বলেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতা জয় করে ধারাবাহিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পিসি গেম তৈরিতে কাজ করছি আমরা। আমাদের গেমগুলো বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত আনরিয়েল গেম ইঞ্জিনে ডেভেলপ করা হচ্ছে। এগুলো থার্ড পারসন শ্যুটার গেম।
আর প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থানা পরিচালক ফয়সাল আহমেদ জানান, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গেম সবার কাছে সহজে পৌঁছে দিতে সম্প্রতি তারা ‘খেলো বাংলাদেশ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে গেম প্রকাশের সহযোগী হিসেবে নিয়েছেন।
জানা যায়, আগামী ১৬ ডিসেম্বর টিম ৭১ অবমুক্ত করতে যাচ্ছে লিবারেশন ৭১ এর দ্বিতীয় কিস্তি-বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ পর্ব। এই পর্বে ল্যান্সনায়ক আব্দুর রউফ হয়ে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে গেমারদের। এরপরই আগামী বছর ২৬ মার্চের দিকে প্রকাশ করা হবে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান’ পর্ব। এই পর্বের মাধ্যমে আকাশ পথে আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ভিত্তিক প্রথম কোনো গেম পাবে বাংলাদেশ।
হিরোস অব ৭১
১৯৭১ সাল। ১৫ সেপ্টেম্বর রাত ২টা ১৫ মিনিট। মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে পাঁচজনের কমান্ডো দল। দলের প্রত্যেকের মুখে কালো কালি মাখা। দুজনের হাতে লাইট মেশিনগান, একজনের হাতে একটা হেভি মেশিনগান, আর বাকি দুজনের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু রাইফেল। প্রত্যেকের বেল্টেই তিনটি কর গ্রেনেড।
এই নিয়েই খেলোয়াড়কে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার শামসুল আলম হয়ে সাধারণ শ্রমিক কবির মিয়া, মেডিকেল শিক্ষার্থী তাপস মৈত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সজল ওরফে মাহবুব চৌধুরী, ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী বদিউজ্জামান ওরফে বদিকে নিয়ে মধুমতীর পাশে শনিরচর গ্রামের একটা স্কুলে থাকা পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প দখল করে নিতে হবে।
বলছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবহে কাল্পনিক ঘটনার ওপর তৈরি প্রথম মোবাইল গেম হিরোজ অব ৭১ এর কথা। অ্যান্ড্রয়েড প্লাটফর্মে গেমটি তৈরি করে ফ্রিল্যান্সার গ্রুপ পোর্টব্লিস। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে অনুদান প্রাপ্ত এই গেমটি বরিশাল বিভাগের শনিচর গ্রাম হানাদার মুক্ত করার।
গেম বিষয়ে গেমটির ডেভলাপার প্রতিষ্ঠান পোর্টব্লিস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশা মুস্তাকিম বলেন, অ্যান্ড্রয়েড এবং উইন্ডোজ উভয় প্লাটফর্মের জন্যই আমরা এই সিক্যুয়াল গেমটির দুইটি পর্ব প্রকাশ করেছি। তবে তিন দফা আবেদন করেও অ্যাপল কর্তৃপক্ষের নীতির কারণে এর আইওএস সংস্করণ প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ চলতি বছর ২৬ মার্চ আমরা প্রকাশ করি গেমটির ‘প্রতিশোধ পর্ব’। এ জন্য আমরা উদ্ভাবনী প্রকল্প থেকে ২০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। আগামী বছর মার্চে আমরা হাজির হতে চেষ্টা করছি মুক্তিযুদ্ধের আবহে তৈরি ‘স্ট্র্যাটেজি গেম’ নিয়ে।
ব্যাটেল অব ৭১
৭ মার্চ, ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক। এরপর ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে পাক-সেনা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ। সবশেষে পতপত করে উড়তে শুরু করে লাল-সবুজের পতাকা।
এসবই ত্রিমাত্রিক ছবির ভিডিও-তে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি প্রথম অ্যাকশন ধর্মী ত্রিমাত্রিক গেম ব্যাটেল অব ৭১- এ। সম্পূর্ণ দেশীয় পটভূমির উচ্চমানের গ্রাফিক্স, সাউন্ড ইফেক্ট ও ভিডিও কোয়ালিটি সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিকমানের এই গেমটি তৈরি করেছে “ওয়াসিইউ টেকনোলজি লিঃ”। সম্প্রতি অবমুক্ত গেমটিতে বঙ্গবন্ধুর থ্রিডি অবয়ব ব্যবহার করা হয়েছে। এতে রয়েছে ১০ ধাপ। তুলে ধরা হয়েছে ১১টি সেক্টরের যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহের ওপর নির্মিত এই গেমটির প্রতি পর্বেই শিশুদের জন্য ঘটনা প্রবাহ গুলো লিখিত আকারে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানালেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফয়সাল কারিম। গেম তৈরির কথা প্রসঙ্গে তিনি ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা কাজ শুরু করি। ২০১৬ সালের অক্টোবরে গেমের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়। প্রথমে আমি আর ফারহান মিলে শুরু করলেও গেমটি আমরা ১৭ জন মিলে তৈরি করেছি। এরমধ্যে প্রধান প্রগ্রামার মাশরুর মাহমুদের বয়স মাত্র ১৪ বছর। গেমটির প্রধান থ্রিডি মডেল নির্মাতা সবুজ আল মামুন এবং প্রধান গেমস ডেভেলপার ফারহান মাহমুদ।
গেমটিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, সিলেটের টি গার্ডেন, কুষ্টিয়া রেজিমেন্ট, কুমিল্লা রেজিমেন্ট, রাঙ্গামাটি, মানিকগঞ্জ, ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুন, চট্টগ্রামের অপারেশন জ্যাকপট, যশোরের গোয়াল হাট যুদ্ধ এবং টাঙ্গাইলে মিত্রবাহিনীর এয়ার ড্রপ মিশনে অংশ নিতে হবে খেলোয়াড়কে। ৩০০ টাকার বিনিময়ে গেমটি সিডি প্যাকেটে সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের শেষের দিকে ব্যাটেল অব ৭১ দ্বিতীয় পর্ব মুক্তির পরিকল্পনা আছে বলে জানা তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের ১ম গেম: অরুণোদয়ের অগ্নিশিখা
আজ থেকে এক যুগ আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রথম ভিডিও গেম ‘আরুণোদয়ের অগ্নিশিখা’ নিয়ে প্রযুক্তির আঙিনায় আলো ছড়ায় সোম কম্পিউটার্স লিমিটেড। ত্রিমাত্রিক ইন্টারঅ্যাক্টিভ ইঞ্জিনে তৈরি তিন ধাপের গেমটি প্রযোজনা করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা হক রিনা। আখাউড়া, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের তিনটি যুদ্ধ গেমটির নকশা তৈরি করেন রাজীব আহমেদ। আর এর প্রোগ্রামারের দায়িত্ব পালন করেন হাসিনুর রেজা তপু।
সিডিতে গেমটি সেসময় বাজারে দারুণ সাড়া জাগায়। কিন্তু মেধাসত্ত্ব চুরির ফলে গেমটি আর বিকশিত হয়নি।
গেমটি নিয়ে আফরোজা হক জানালেন- আবেগ থেকে গেমটি প্রকাশ করা হয়। গেমের নিজস্ব ইঞ্জিন ত্রিমাত্রিক ইঞ্জিনটি তৈরি করে রাজশাহীর একটি প্রোগ্রামার গ্রুপ। শহীদ আজাদসহ সকল মুক্তিযুদ্ধা নিবেদন করা হয় গেমটি। গেমটি তৈরিতে ৬ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। সিডিতে প্রকাশ করার পর দেশ-বিদেশে বেশ বিক্রি হয়। কিন্তু পাইরেসি’র কারণে পুরো ব্যবসায় ঝুঁকির মুখে পড়ে। পারিবারিক ভাবে একটু চাপের মুখে পড়ে অবশেষে গেম ডেভেলপে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। বেশ কিছুদিন পর আবার গেমটিকে নতুন ভাবে তৈরি করতে কিছু অনুদানের চেষ্টা করে লাভ হয়নি। আমিও কর্মজীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করি। এখন আমার ছেলে শমিক আশফাকুল হক ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গেম ডেভেলপ করছে। সুযোগ হলে ওকে নিয়ে হয়তো আবার শুরু করতে পারি।
টাইমস স্পেশাল, তথ্যপ্রযুক্তির খবর